শেষের পাতা

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন দপ্তরে যত অনিয়ম

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

১৫ জুলাই ২০১৯, সোমবার, ৯:২৭ পূর্বাহ্ন

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে ভর করেছে অনিয়ম। সংস্থাটিতে অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতায় চলছে এর কার্যক্রম। এতে প্রশাসনিক জটিলতায় পড়েছে অধিদপ্তরটি। এখানে অভ্যন্তরীণ কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব রয়েছে। ক্ষুব্ধ হয়ে একটি গ্রুপ  চলতি বছরে আদালতেও গিয়েছেন। তাদের বিষয়টি প্রশাসনিক ট্রাইবুনাল পর্যন্ত গড়িয়েছে। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে যেকোনো সময় অধিদপ্তরে প্রশাসনিক অচলাবস্থা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল ভয়াবহ রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর দেশের কারখানাসমূহের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে সরকার টপ প্রায়োরিটি হিসেবে সরকারের তৎকালীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে মাত্র ৫ মাসের মাথায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৩ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর অধিদপ্তরে উন্নীত করতে সম্মতি প্রদান করে। নব প্রতিষ্ঠিত অধিদপ্তরের জনবল সংকট নিরসনে এবং মেধাবী ও চৌকষ কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য ৩৩ তম বিসিএস থেকে প্রায় দুই শতাধিক পরিদর্শক নিয়োগ করে সরকার। অধিদপ্তরের জনবল সংকট ও মানসম্পন্ন কর্মকর্তার অভাব পূরণে সরকারের এ সিদ্বান্ত দেশে ও বিদেশে দারুণ ভাবে প্রশংসিত হয়। কিন্তু শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন রাজধানীর কাওরান বাজারে নব প্রতিষ্ঠিত এ অধিদপ্তর বর্তমানে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিধি বহির্ভূত ভাবে পদোন্নতির প্রস্তাব, জ্যেষ্ঠতা সংক্রান্ত জটিলতা, গুরুত্বপূর্ণ পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন, বৈদেশিক ট্রেনিং এ মনোন্নয়নে বৈষম্য এবং বিভাগীয় মামলা প্রদান করে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করাসহ নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও স্বেচ্ছাচারিতায় চরম অভিযোগ ওঠেছে।

বিধি বহির্ভূতভাবে শ্রম পরিদর্শকদের পদোন্নতির প্রস্তাব: নন ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী (জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা-২০১১-এর বিধি বিধি ১০(১) অনুযায়ী অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা ছাড়া পদোন্নতি দেয়া যাবে না। কিন্তু বিধিমালাকে আমলে না নিয়ে প্রস্তাবিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা দিয়ে ৫১ জন পরিদপ্তরকালীন দোকান ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক (শ্রম পরিদর্শক) কে পদোন্নতির প্রস্তাব গত ৩রা জুন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত খসড়া তালিকার উপর ৩৩ তম বিসিএস হতে শ্রম পরিদর্শক পদে নিয়োগ প্রাপ্তদের আপত্তি ছিল এবং তারা এ আপত্তির আবেদন করেছিল। কিন্তু তাদের আপত্তি আমলে নেয়নি কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ৫১ জন শ্রম দর্শক তৎকালীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন পরিদপ্তরের ১৫তম গ্রেডের ৩য় শ্রেণীর কর্মচারি ছিলেন। ২০১৪ সালে তাদের পিএসসির সুপারিশ ছাড়াই নিয়ম বর্হিভূত ১৫তম গ্রেড থেকে ১০ গ্রেডের শ্রম পরিদর্শক করে অধিদপ্তর প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল। এসকল দোকান পরিদর্শকদের মধ্যে ২০১৩ সালের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ডিসেম্বরে নিয়োগ পাওয়া দোকান পরিদর্শকরা পদ নাম পরিবর্তনের প্রায় দুইমাস পরে দোকান পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করে। অথচ নিয়ম হচ্ছে দ্বিতীয় শ্রেণীর গেজেটেড পদের নিয়োগ প্রদানের ক্ষমতা পিএসসির হাতে। অধিদপ্তর কর্তৃক বিতর্কিত নিয়োগ কৃতদের আবার বিধি বর্হিভূত প্রমোশনের প্রস্তাবের ফলে ২০১২ সালের ৩৩ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিযোগকৃতরা জ্যেষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

প্রথম শ্রেণীর জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রিতা: অধিদপ্তরের ১ম শ্রেণীতে কর্মরত সহকারী মহাপরিদর্শকদের জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরাসরি নিয়োগকৃত ও বিসিএস থেকে নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়া হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নন ক্যাডার কর্মকর্তা ও কর্মচারী ( জ্যেষ্ঠতা ও পদোন্নতি) বিধিমালা-২০১১ অনুযায়ী বিসিএস হতে নিয়োগকৃত কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা দিয়ে মতামত প্রদান করে। মতামত প্রদানের প্রায় তিন মাস অতিক্রান্ত হলেও ১ম শ্রেণীর জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন হয়নি।

চলতি দায়িত্ব প্রদানে জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন: ১ম শ্রেণীতে কর্মরত সহকারী মহাপরিদর্শকদের জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়নে দীর্ঘ সূত্রিতার সুযোগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে উপমহাপরিদর্শক পদে জুনিয়রদের বিধি বহির্ভুত ভাবে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। ঢাকা, বুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী ও মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়গুলোতে সিনিয়রদের পরিবর্তে জুনিয়র কর্মকর্তাদের চলতি দায়িত্ব প্রদান করায় চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। চলতি দায়িত্ব পালনকারী কিছু কিছু সিনিয়র কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে, কিছু জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে বিভাগীয় মামলা জিইয়ে রেখে দীর্ঘদিন পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।

বৈদেশিক প্রশিক্ষণে মনোনয়নেও বৈষম্য: অধিদপ্তরের বৈদেশিক প্রশিক্ষণে মনোনয়নের প্রক্রিয়াটা পুরোটাই বৈষম্যমূলক। কোন নীতিমালা না মেনে পরিচিত গুটিকয়েক কর্মকর্তা বার বার বিদেশে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা ১৪ বার বিদেশ ভ্রমণ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জড়িত অসাধু কর্মকর্তা: বিধি বহির্ভূত ভাবে শ্রম পরিদর্শকদের পদোন্নতি দেয়ার জন্য অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখায় উপমহাপরিদর্শক (চ:দা:) মোর্তজা মোর্শেদকে সরিয়ে নরসিংদী জেলা কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক (চ:দা:) জোবেদা খাতুনকে পদায়ন করা হয়। জোবেদা খাতুন ২০১৩-২০১৪ সালের পুরোটা সময় অধিদপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার সময়ই ২০১৩ সালে পদোন্নতির প্রস্তাব প্রেরিতদের কমিশনের সুপারিশ ছাড়াই দোকান পরিদর্শকদের শ্রম পরিদর্শক পদে তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রদান করা হয়েছিল বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। ২০১৪ সালের নিয়োগ বিধিতে এসকল দোকান পরিদর্শকদের আপগ্রেডেশনের কথা উল্লেখ না থাকলেও তার জন্য নিয়োগ বিধিতে আলাদা বিধি যুক্ত করে প্রমোশনের ফিডার পদের মেয়াদ ৫ বছরের স্থলে ৩ বছর করেন এবং অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতা তালিকা ছাড়াই প্রস্তাবিত জ্যেষ্ঠতার তালিকার মাধ্যমে ২০১৪ সালে সহকারী মহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নানা অনিয়মের বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি) শিবনাথ রায়-এর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, এখানে কোনো অনিয়ম নেই। আমার হাত দিয়ে অনিয়মের বিষয় যাবে না। আমি এ বিভাগে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করি। চলতি দায়িত্ব আমি দেই না, মন্ত্রণায়ল দেয়। যারা এ বিভাগে দীর্ঘ দিন চাকরি করেছেন সঠিক নিয়মে তাদের পদোন্নতির বিষয়ে প্রস্তাব গেছে। যারা ক্ষুব্ধ হয়েছে তারা আদালতে গেছেন। যে কেউ আদালতে যেতে পারেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status