শেষের পাতা

কলকাতার ডায়েরি

নেতাদের ভুল স্বীকার করতে নির্দেশ মমতার

পরিতোষ পাল

১৪ জুলাই ২০১৯, রবিবার, ৯:৪০ পূর্বাহ্ন

লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানে উদ্বিগ্ন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজে সংগঠনের দায়িত্ব্ব নিয়ে দলের শুদ্ধিকরণে উদ্যোগী হয়েছেন। নির্বাচনের পরে দলে পর্যালোচনার সময় দলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের আচার-আচরণ ও জনসংযোগের অভাব নিয়ে বহু অভিযোগ সামনে উঠে এসেছে। সেগুলোর অধিকাংশই যে ভিত্তিহীন নয়, তার প্রমাণ তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী নিজেও পেয়েছেন। আর তাই দলের শুদ্ধিকরণে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে তিনি পরামর্শদাতা হিসেবে সঙ্গে নিয়েছেন দেশের অন্যতম নির্বাচন কৌশলী বলে পরিচিত প্রশান্ত কিশোরকে। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হয়ে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে প্রশান্ত কিশোর তাদের সাফল্য এনে দিয়েছেন। সামপ্রতিক লোকসভা নির্বাচনেই প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা অন্ধ্র প্রদেশে ওয়াই এস আর কংগ্রেসকে জয়ী করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। আর এবার প্রশান্ত কিশোরকে ডেকে আনা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। মমতার ভাইপো তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ই পিসিকে বুঝিয়েছেন প্রশান্ত কিশোরের সাহায্য নেবার জন্য। একাধিকবার প্রশান্ত কিশোর মমতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক করেছেন অভিষেকের সঙ্গেও। এমন কি বিভিন্ন জেলার নেতৃত্বকে নিয়ে মমতা যে বৈঠক করছেন তাতেও হাজির থাকছেন প্রশান্ত কিশোর। এই প্রশান্ত কিশোরের পরামর্শেই নাকি মমতা দলের নেতা ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে অপ্রিয় নির্দেশ দিয়ে চলেছেন।

কয়েকদিন আগেই দলের নেতাদের কাটমানি  (বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ কেটে রাখা বা ঘুষ নেয়া) ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এর ফলে দলের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ তৈরি হলেও মমতা কোনো কথাই বলছেন না। রাজ্যের প্রায় সর্বত্র কাটমানি ফেরতের দাবিতে তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের ঘেরাও করে মুচলেকা আদায় করা হচ্ছে। অনেকে অর্থ ফেরতও দিচ্ছেন। এই পরিস্থিতির মাঝেই গত শুক্রবার দলের বিধায়কদের ভুল সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছেন।

মমতার পরামর্শ, কোনো ভুল হয়ে থাকলে এড়িয়ে যাবেন না। ভুলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জনসংযোগের মাধ্যমে তা শুধরানোর চেষ্টা করুন। বিধায়কদের অনেকের আচার-আচরণ, বিলাসী জীবনযাপন যে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার অন্যতম কারণ, তা বুঝিয়ে এদিন মমতা বলেছেন, সাধারণভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। বিধায়কদের সহজ-সাধারণ জীবনযাপন করতে হবে। বিধায়কদের অনেকের ঔদ্ধত্য যে ‘নেতিবাচক’ বার্তা দিয়েছে, তাও সংশোধনের চেষ্টা করতে পরামর্শ দিয়েছেন মমতা। মানুষের অভাব-অভিযোগ শুনে তা দ্রুত প্রতিকারের চেষ্টা করতেও বলেছেন তিনি।
এদিকে দলের নেতা ও কর্মীদের পুলিশ প্রশাসনের উপর ভরসা না করারও নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনের উপর নির্ভরতার ফলে সাধারণ মানুষের কাছে যে ভুল বার্তা গিয়েছে সে কথাও মমতা দলকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।

বিজেপির ছাঁকনি নীতি
লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই অন্যদল থেকে নেতা-কর্মী ভাঙিয়ে আনা শুরু হয়েছে। বিজেপিতে যোগ দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক নেতাই নির্বাচনে জিতে সংসদ সদস্যও হয়েছেন। আর নির্বাচনের পরে অন্যদল, বিশেষ করে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার যে জোয়ার দেখা গিয়েছে তাতে দলের অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব। পুরনো নেতা-কর্মীরা নতুনদের মেনে নিতে পারছেন না। বীরভূমেই বিধায়ক মণিরুল ইসলামকে দলে নেয়া নিয়ে স্থানীয় স্তরে বিক্ষোভও হয়েছে। এরপরেই টনক নড়েছে দলীয় নেতৃত্বের। দলের মেন্টর হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের পক্ষ থেকেও বিজেপি নেতাদের বেনোজল সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। এর পরেই চালু করা হয়েছে ছাঁকনি নীতি।

বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ দলে বেনোজল প্রবেশ ঠেকাতে বিশেষ সিলেকশন কমিটি তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যদলের নেতা-কর্মীদের কারা বিজেপিতে যোগ দিতে পারবেন তাদের বাছাই করবেন এই কমিটি। দলে নতুন আসা অন্য দলের নেতা-কর্মীরা কী কাজ করবেন তাও ঠিক করে দেবেন এই কমিটি। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ছাঁকনি ব্যবস্থার মাধ্যমে দলের মধ্যে নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব মেটানোর বার্তাই দেয়া হয়েছে। কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সভাপতি অমিত শাহ এই পরামর্শ দিয়েছেন।

এদিকে কাটমানিতে অভিযুক্তদের দলে নেয়া হবে না বলেও ঘোষণা করেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়। রাজ্যের দলীয় সাংসদ এবং বিধায়কদের বৈঠকে কৈলাস দাবি করেছেন, তৃণমূলের অনেক নেতা-মন্ত্রীই এখন বিজেপিতে যোগ দিতে ইচ্ছুক। তবে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কাটমানিখোরদের দলে নেয়া হবে না। তাই সিলেকশন কমিটি করা হয়েছে।

দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও বলেছেন, যারা কাটমানি নিয়েছে, বিজেপিতে তাদের এন্ট্রি এখন কাট। তৃণমূল কংগ্রেসের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক অর্বাচীনদের প্রতিটি কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজনই বোধ করছি না। তবে সততার প্রশ্ন তুলে বিজেপিকে খোঁচা দিয়ে কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নান বলেছেন, এক সময় বিজেপি যাকে ভাগতে বলেছিল, তাকেই এখন সসম্মানে দলে নিয়েছে। তিনিই এখন ঠিক করছেন, অন্য কাকে দলে নেবেন বা নেবেন না। তারপরে আর এসব কথা মানায় না।

গাছে পেরেক পুঁতলেই জরিমানা
পশ্চিমবঙ্গে গাছে পেরেক লাগানোর বিরুদ্ধে চালু হতে যাচ্ছে নতুন আইন। বিধি অনুসারে গাছের গায়ে পেরেক পোঁতা হলে জরিমানা করা হবে। বিধানসভার চলতি বর্ধিত বাজেট অধিবেশনে পুর দপ্তর রাস্তা, হাসপাতালসহ প্রকাশ্য জায়গায় থুতু ফেলা বন্ধে আইনে সংশোধনী এনেছে। এই আইনের আওতাতেই বিধি তৈরি করে পুর-এলাকায় গাছের গায়ে পেরেক পোঁতা বন্ধ করার ব্যবস্থা হচ্ছে।

বিধি নিয়ে বিধানসভায় কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, গাছের গায়ে পেরেক পুঁতে বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রবণতা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। অথচ আমরা বলে থাকি, একটি গাছ একটি প্রাণ। পথে পথে ছোট-বড় গাছে পেরেক পুঁতে বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে দেয়া আমাদের সকলেরই নজরে পড়লেও কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন ছাড়া কেউই প্রতিবাদ জানান না। গাছকে পেরেক পুঁতে ক্ষত-বিক্ষত করা যে অন্যায় সেই সচেতনতাই নাগরিকদের মধ্যে তৈরি হয়নি। তাই যারা এগুলো লাগান তাদের কেউ বাধাও দেন না।

তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতারা এ নিয়ে ভাবিত নন। সরকারি স্তরে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই।
এক পরিবেশকর্মী জানান, গাছ কাটা ঠেকাতে আইন থাকলেও গাছের গায়ে পেরেক দিয়ে বিজ্ঞাপন সাঁটা মোকাবিলায় কোনো বিধি নেই রাজ্যে। গাছে পেরেক লাগানোর প্রবণতা রোধে প্রশাসনিক স্তরে সার্বিক পদক্ষেপও নেয়াও হয়নি কখনো। তবে এই প্রথম গাছে পেরেক পোঁতা বন্ধে পুর আইনের আওতায় বিধি তৈরি করতে চলেছে রাজ্য।

কলকাতায় পাখিদের জন্য বানানো হবে বাসা
নগর উন্নয়নের জন্য কলকাতা ও শহরতলি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে পাখি। শোনা যায় না তাদের কিচিরমিচির। তারা বাসা তৈরির জায়গা খুঁজে পাচ্ছে না। আর তাই কলকাতা ও শহরতলির বিভিন্ন এলাকাকে পাখিদের বাসযোগ্য করে তুলতে বাসা বানিয়ে দেয়া হবে।

তবে বাসা বলতে যা বোঝায় সেটি পাখিরা তৈরি করে বিভিন্ন জায়গা থেকে একটু একটু করে শুকনো ডালপালা, লতাপাতা, খড়কুটো সংগ্রহ করে। গাছের ডালে বা কোঠরে তৈরি করা বাসার মতো বাসা তৈরি করা সম্ভব নয়। পরিবর্তে গাছের ডালে ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে মাটির তৈরি হাঁড়ি। থাকবে আলাদা করে পানিরও ব্যবস্থা। রাজ্য বন দপ্তরের অধীনে যেসব গাছ ও পার্ক রয়েছে সেখানেই দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে পাখিদের কৃত্রিম বাসা।
এই কাজে ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে কিচির-মিচির প্রকল্প।

রাজ্যের নগর বিনোদন ও বনায়ন বিভাগের উপ বনপাল রবীন্দ্রনাথ সাহা বলেছেন, আমরা চাইলে নিজেরা পাখিদের বাসা বানানোর জন্য হাড়ি কিনে দিতে পারতাম। কিন্তু আমরা চাইছি, ছাত্রছাত্রীরা এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হোক। পাখিদেরও যে এই শহরে থাকার অধিকার রয়েছে সেই সচেতনতা গড়ে উঠুক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। আর সেজন্যই ছাত্রছাত্রীরা নিজেরাই হাড়ি কেনার টাকা দেবে। যে ছাত্র বা ছাত্রী মাটির হাঁড়ি কিনে দেবে তাকে বন দপ্তর একটি পরিচয়পত্র দেবে। সে হাঁড়িটিতে নিজের মতো করে স্লোগান লিখতে পারবে। হাঁড়িটিতে ছাত্র বা ছাত্রীর ছবিও লাগানো থাকবে। নিজের ইচ্ছেমতো তারা দেখে যেতে পারবে কোনো পাখি বাসা বেঁধেছে কিনা। পাখিপ্রেমীরা সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।  

মধু কবির বাড়ি নিয়ে জটিলতা
কলকাতার খিদিরপুরে ২০বি, কার্ল মার্কস সরণির বাড়িটিতে বিভিন্ন সময় মিলিয়ে ১৭ বছর কাটিয়েছিলেন অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এখানে কবি সৃষ্টি করেছিলেন ‘মেঘনাদবদ কাব্য’সহ অনেক উল্লেখযোগ্য রচনা। অথচ আজ এই বাড়ির স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই চলছে।

২০০৯ সালে বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ’ বলে ঘোষণা করার পরও অধিগ্রহণ করা যায়নি। উল্টো বর্তমান বাড়ির মালিক প্রশ্ন তুলেছেন  বাড়িটিতে মধুসূদনের থাকা নিয়েই। ফলে আইনি জটিলতায় জর্জরিত মধুসূদন দত্তের স্মৃতিবিজরিত বাড়িটি।
মধুসূদনের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত  ১৮৩১ সালে খিদিরপুরের বাড়িটি কিনেছিলেন। পরের বছরই মধুসূদন তৎকালীন হিন্দু কলেজে ভর্তি  হয়েছিলেন। ১৮৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি সেই বাড়িতেই ছিলেন এবং পরেও থেকেছেন, বিভিন্ন লেখায় তার উল্লেখ রয়েছে। তবে ১৮৬২ সালে বাড়ির একাংশ তিনি কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাই হরিমোহনের কাছে বিক্রি করেছিলেন। সেখান থেকে একের পর এক মালিকানা বদল হয়েছে।

বাড়িটির বর্তমান মালিকানা দাবি করেছেন স্থানীয় এক প্রমোটার সালাউদ্দিন। তিনি বাড়িটি ভেঙে বহুতল করতে চান বলে অভিযোগ। ২০০৯ সালে আদালতে মামলা করেন সালাউদ্দিন।

সালাউদ্দিনের দাবি, মধুসূদনের থাকার কোনো নথি পুরসভা আদালতে পেশ করতে পারেনি। প্রমাণ না দিতে পারলে তিনি কেন মেনে নেবেন যে, এটা মধুসূদনের বাড়ি এবং সেটা কেন ‘হেরিটেজ’ করে দেয়া হবে। তাই তিনি তার অবস্থান থেকে নড়বেন না।

নিয়ম অনুযায়ী ‘হেরিটেজ গ্রেড-২ এ’-তে বলা হয়েছে যে, ওই ধরনের কোনো বাড়ির ফাঁকা অংশে নতুন নির্মাণ করা যেতে পারে, কিন্তু তা  যেন কোনোভাবেই হেরিটেজ ঢাকা না দিয়ে দেয়। তা মানুষ যেন স্পষ্ট দেখতে পায়। তবে এখন অবশ্য কলকাতা পুরসভা বাড়িটি গ্রেড ২ এ থেকে ২ বি তালিকাভুক্ত করেছে। ফলে  প্রশাসন নিজের ইচ্ছামতো চাইলে ওই নির্মাণের পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করতে পারে।  তবে আইনি জটিলতা থেকে মুক্তি দেয়া যাচ্ছে না কবির বাড়িটিকে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status