প্রথম পাতা

স র জ মি ন পিপলস লিজিং

২০৩৬ কোটি টাকা কীভাবে ফেরত আসবে কেউ জানে না

এম এম মাসুদ

১২ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ১০:০৩ পূর্বাহ্ন

বন্ধ ঘোষণা করা পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড (পিএলএফএসএল)-এ ২০৩৬ কোটি টাকা আমানত রেখেছিলেন ৬০০০ গ্রাহক। এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ঘোষণা করায় এই আমানত ফিরে
পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত গ্রাহকরা। বুধবার প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিক বন্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও বলা হয় গ্রাহকের জমা আমানতের চেয়ে সম্পদ বেশি থাকায় সেই আমানত ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। তবে কবে কিভাবে গ্রাহক আমানত ফিরে পাবেন এর কোন তথ্যই তারা পাচ্ছেন না। বন্ধ ঘোষণার পর দিন গতকাল প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে সরজমিন দেখা যায় অনেক গ্রাহকের ভিড়। তাদের সবারই একই প্রশ্ন জমা রাখা আমানত কবে, কিভাবে ফেরৎ পাওয়া যাবে। মতিঝিলে সিটি সেন্টারে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়ে দেখা যায় কয়েকজন লোক অফিসের সামনে বসে আছেন। রিসিপশনে ছিলেন একজন কর্মী।

সামনে সোফায় বসা তিন-চারজন লোক। ভেতরের দরজা বন্ধ। রিসিপশনে থাকা কর্মী জানান, অফিসে কোনো কর্মকর্তা নেই। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান আছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যার অফিসে নেই। গতকাল প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। তবে নিচের সারির কিছু কর্মকর্তাকে পাওয়া গেলেও তারা কথা বলতে রাজি হননি। বরং নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়েই তারা উদ্বিগ্ন।
আমানতকারীসহ পিপলস লিজিংয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। এই বয়সে কোথায় চাকরি খুঁজবেন বা কিভাবে জীবনযাপন করবেন এ নিয়েই চিন্তিত অধিকাংশ কর্মচারী। এছাড়া আমানতকারীদের টাকা কিভাবে ফেরত দেয়া হবে এ বিষয়ে কোন উত্তর দিতে পারেননি পিপলস লিজিংয়ের কেউ।

পিপলস লিজিংয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, অফিসে অনেক আমানতকারী এসেছেন। আবার ফিরেও গেছেন। তাদের কিভাবে সান্তনা দেব, আমাদের অফিসেই কর্মীর সংখ্যা ২৫০ জন। আমানতকারীদের পাশাপাশি আমরাও এখন হতাশায় রয়েছি।

অফিসে অপেক্ষায় থাকা হাকিম নামের একজন আমানতকারী বলেন, আমাদের একটি সমিতির ৩০ লাখ টাকা পিপলস লিজিংয়ে ফিক্সড ডিপোজিট করা হয়, যার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ডিসেম্বরে। এর মধ্যে ছয় মাস পার হয়ে গেছে। কিন্তু আমানতের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। অনেকবার সময় দিয়েছে। কিন্তু টাকা দিচ্ছে না। পত্রিকায় দেখলাম, পিপলস লিজিং বন্ধ করে দেয়া হবে। তাহলে আমাদের আমানতের টাকার কী হবে? আমাদের টাকা কীভাবে দেবে। আমরাতো সব নিয়ম মেনেই আমানত রেখেছি। আমাদের কষ্টের টাকা। আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকে যাব। এ রকম অনেক আমানতকারী পিপলস লিজিংয়ের মতিঝিল অফিসে এসে ভিড় করছেন।

মিরপুর ১২ থেকে এসেছেন আয়েশা খাতুন। তিনি বলেন, আমার জীবনের শেষ সম্বল ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা পিপলস লিজিংয়ে রেখেছিলাম। এই প্রতিষ্ঠানের টাকা রেখে এত বড় বিপদে পড়বো আমি চিন্তাও করতে পারিনি। এখন কোথায় গেলে টাকাটা ফিরে পাব, কিভাবে পাব এবং কত দিনে পাব এ নিয়ে অন্ধকারের মধ্যে রয়েছি। দুই বছর আগে চাকরি হারিয়ে এই টাকাটা এখন আমার একমাত্র সম্বল। টাকা ফেরত পেতে সাংবাদিকদের কাছে সহযোগিতা চান আয়েশা খাতুন।

শোয়েব মিয়া নামের আরেক আমানতকারী জানান, এই প্রতিষ্ঠানে এখন আমার ৯ কোটি টাকা রয়েছে। শুধু এখানেই নয়। আমার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ আরো অন্যান্য লিজিং কোম্পানিতেও আছে। কিন্তু এই রকম অবস্থা দেখে এখন হতাশ। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতেও রাখা টাকা তোলার জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু তারাও টাকা দিতে পারছে না। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো আবার বন্ধ হয়ে যায় কি না তা নিয়ে চিন্তায় আছি।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবসায়ন হতে যাওয়া এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আটকে পড়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যাক্তি আমানতকারীদের ২ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। অবশিষ্ট ৭০০ কোটি টাকা ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহকের। অবসায়নের কারণে এইসব ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানিক আমানতকারীরা কবে নাগাদ আমানতের টাকা ফেরত পাবেন তা বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষও বলতে পারছে না। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে, আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতেই মূলত পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন হচ্ছে। এ নিয়ে গ্রাহকদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকারের অনুমতিক্রমে এবং হাইকোর্টের নির্দেশের আলোকে পিপলস লিজিং অবসায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে এখনও আমানতের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ বেশি রয়েছে। ফলে আমানতকারীদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

একটি বীমা কোম্পানির নারী কর্মকর্তা আকলিমা বেগম বলেন, পুঁজিবাজারে ১৭ লাখ টাকা হারিয়েছি। তখন ভাবলাম আর শেয়ার ব্যবসা নয়। এবার ব্যাংক টাকা রাখব। এখানে এসেও ধরা খেলাম। তিনি বলেন, ২০১৭ সালের শুরুতে পিপলস লিজিংয়ে ১২.৬ শতাংশ সুদে ৮ লাখ টাকা ডিপোজিট করি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এই রকম দেউলিয়া হয়ে যাবে তা কখনও ভাবিনি। স্বামীর টাকা এখানে ডিপোজিট করেছি। এখন টাকা ফেরত না পেলে আমার সংসার ভেঙে যাবে।
অন্যদিকে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায় আখতার কামাল চৌধুরী নামে এক ব্যাক্তি ৫২ লাখ টাকা ১২ শতাংশ সুদে ডিপোজিট করেন। প্রতিষ্ঠানটির অবসায়নের খবরে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন। এখানে এসে কোনো ঊর্ধতন কর্মকর্তার দেখা না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন তিনি।

বন্ধের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই অনেক আমানতকারী পিপলস লিজিংয়ের অফিসে আসছেন। কিন্তু তথ্য জনানোর মত কোনো কর্মকর্তা অফিসে নেই। প্রতিষ্ঠানটির এমডি সামি হুদার বক্তব্য নেয়ার জন্য গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইলে ফোন দেয়া হলেও কল রিসিভ করেননি।

পিপলস লিজিংয়ের আমানতকারী বাবলা বলেন, আমি ১৪ লাখ টাকা আমানত রেখেছি। পিপলস লিজিং বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এমন খবর শোনার পর প্রথমে গুলশান শাখায় যাই। কারণ আমার ডিপোজিট ওই শাখায় করা। কিন্তু গত দুদিন ধরে তাদের অফিসে কোনো কর্মকর্তা নেই। মতিঝিল শাখায় এসে দেখি একই অবস্থা। সকালে অফিসে এসেছি কথা বলার মত কাউকে পাইনি। একজন অপারেশন ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা হলো উনি বলেন, ধৈর্য ধরেন অবশ্যই টাকা পাবেন। আমার অনেক কষ্টের টাকা জমিয়ে ডিপোজিট রেখেছি, এখন যদি ফেরত না পাই তাহলে মাঠে মারা যাব।
আরেক আমানতকারী কাদের সরকার জানান, বেশি সুদ দেয়ায় ২০১৭ সালে ৮৪ লাখ টাকা আমানত ছিল। অনেক দিন টাকা তোলা যাচ্ছে না। কিছু দিন আগে ১০ লাখ টাকা উঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর থেকে অনেকবার চেষ্টা করেও বাকি টাকা আর ফিরে পাইনি। এখন বন্ধ হয়ে গেলে টাকা ফেরত পাবো কি না আতঙ্কে আছি।

পিপলস লিজিংয়ের কর্মকর্তা শামীম রেজা জানান, আমি মাঠ লেভেলে কাজ করি। কথা বলার মত কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। তবে বড় আতঙ্কে আছি আমরাও। কারণ আমাদেরই এখন চাকরি থাকবে না। তিনি বলেন, কোম্পানির অবসায়নের বিষয়টা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউ অফিসে আসছে না।

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আতঙ্ক: আমানতকারীদের পাশাপাশি শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। যে কারণে পানির দরে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রি করে দিতে চাচ্ছেন অনেক শেয়ারহোল্ডার। কিন্তু ক্রেতার অভাবে হতাশ হতে হচ্ছে তাদের। নামমাত্র অর্থে শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব দিলেও ক্রেতার অভাবে বিক্রি করতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটির শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছিল ৩ টাকা ৩০ পয়সা। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার ৩০ পয়সা দাম কমে ৩ টাকা লেনদেন শুরুর দাম দাঁড়ায়। তবে প্রথমে কোম্পানিটির শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব আসে তিন টাকা ৩০ পয়সা। কিন্তু এ দামে কেউ শেয়ার কিনতে চায়নি। যে কারণে কয়েক দফা দাম কমে এক পর্যায়ে ৩ টাকা দরে ১ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব আসে। এ দামেও কেউ কোম্পানিটির শেয়ার কিনতে চায়নি। ফলে কোম্পানিটির শেয়ারের ক্রেতাশূন্য থেকে গেছে। এ নিয়ে টানা তিন কার্যদিবসের শেয়ার বিক্রি করতে ব্যর্থ হলেন পিপলস লিজিংয়ের শেয়ারহোল্ডারা।

আবদুর রহমান নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, পিপলস লিজিং বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এ কারণে কেউ কোম্পানিটির শেয়ার কিনতে চাচ্ছেন না। শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক শেয়ারবাজারে।

পিপলস লিজিংয়ের কারণে সার্বিক শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাকিল রিজভী।

উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ২৪ নভেম্বর পিপলস লিজিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে অনুমোদন লাভ করে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারবাজারে তালিকাভূক্ত হয়। মোট শেয়ারের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ৬৮ শতাংশ, উদ্যোক্তাদের ২৩ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিতে মোট আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ৩৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। বাকি ৭০০ কোটি টাকা রয়েছে ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহকদের আমানত। প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৪৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণের বড় অংশই নিয়েছে কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status