এক্সক্লুসিভ

শরীরে ছ্যাঁকার দাগ নিয়ে হাসপাতালে লিমা

ওমর ফারুক সুমন, হালুয়াঘাট (ময়মনসিংহ) থেকে

১২ জুলাই ২০১৯, শুক্রবার, ৮:০৬ পূর্বাহ্ন

পনের বছরের গৃহকর্মী লিমা। বর্বর, অমানবিক নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছে। হাসপাতালের বিছানায় ছটফট করছে যন্ত্রণায়। চোখ বুজলেই ভেসে উঠে নির্যাতনের চিত্র। রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানার কচুক্ষেত এলাকার চৈতালী ১/ডি ব্লকের নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তা তানভীরের বাসায় কাজ করতো লিমা। চার মাস আগে প্রতিবেশী আছিয়া কাজের কথা বলে তাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। হালুয়াঘাট উপজেলার দর্শারপাড় গ্রামের হাবিবুর রহমানের মেয়ে এই লিমা। তানভীরের স্ত্রী গৃহকত্রী সীমা ওরফে মাহা নানা অজুহাতে তার ওপর চালাতো নির্যাতন। গৃহকর্ত্রী লিমা জানায়, আয়রন গরম করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাঁকা দিতো ওই মহিলা। খুন্তি গরম কইরা শরীরের বিভিন্ন জায়গাসহ লজ্জাস্থানে ছ্যাঁকা দিতো। এ সময় পায়ের নখ, দাঁত উপরে ফেলেন বলেও জানায় নির্যাতিত মেয়েটি। লিমা জানায়, টানা দু’মাস শরীরের বিভিন্ন অংশে গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে নির্যাতন করেছে। প্রায়ই লোহার রড দিয়ে তাকে পেটানো হতো। মেরে ভেঙে ফেলা হয়েছে সামনের পাটির একটি দাঁত। বাড়ি আসার পর লিমার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গত বুধবার হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে তার পরিবার। পরে তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ তলায় ২০নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। মেয়ের ওপর এমন নির্যাতনের অভিযোগ করে বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘চার মাস আগে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বেতনে কাজের কথা বলে লিমাকে ঢাকায় এক আর্মি অফিসারের বাসায় নিয়ে যায় পাশের গ্রামের আছিয়া (জুয়েলের মা)। প্রথম এক-দেড় মাস ভালোভাবেই চলছিল। গত রমজান শুরুর আগে লিমা বাড়ি চলে আসতে চায়। কিন্তু মীম ম্যাডাম কিছুতেই তাকে দিতে রাজি হয়নি। তিনি বলেন, সেই থেকে শুরু হয় মেয়ের ওপর অত্যাচার। কারণে-অকারণে নির্যাতন করা হতো মেয়েকে। কাউকে কিছু না জানিয়ে গত মঙ্গলবার হালুয়াঘাটের একটি বাসে করে মেয়েকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয় তারা।

প্রথমে মেয়েকে দেখে আমরা চিনতেই পারিনি। মাথার চুল কাটা। সারা শরীরে পোড়া দাগ, আর ঘা। গত বুধবার মেয়েকে হালুয়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। মেয়ের ওপর যে অমানুষিক অত্যাচার করা হয়েছে তার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, আমি এই ঘটনায় থানায় মামলা করবো। নির্যাতনের বিষয়ে লিমা বলেছে, ‘আন্টির বাসায় যাওয়ার পর দুই মাস ভালোই ছিলাম। গত রমজান মাস থেকে শুরু হয় মারধর।

বাড়ি আসার কথা বললে আরো বেশি মারতো। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আন্টিকে বলি আমার বেতন দিয়া দেন আমি বাড়িত যামুগা। এমন কথায় সে ইস্ত্রি গরম করে আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাঁকা দেয়। তালা দিয়ে মেরে আমার দাঁত ফালাইয়া দিছে, খুন্তি গরম কইরা আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাঁকা দিছে। এমনকি লজ্জার স্থানেও ছ্যাঁকা দেয় আন্টি। আমার মাথা ফাটাইয়া চুল কাইট্টা দেয়। আন্টির মাইর শেষ অইলে তার ছেলে ওয়াদা ও আরেক কাজের মেয়ে পিংকীকে আমাকে মারার জন্য বলতো। তারা আমাকে অনেক মারছে। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আমি বারবার কইতাম আন্টি আমারে কয়ডা বড়ি (ট্যাবলেট) আইন্না দেন আমি আর সহ্য করতে পারতাছি না। আমারে কোনো দিনও একটা বড়িও আইন্না দেয়নি। রমজানের ঈদের দিনও আমাকে পেট ভইরা ভাত খাইতে দেয় নাই।’ ঢাকা থেকে কীভাবে বাড়ি এসেছে জানতে চাইলে লিমা জানায়, ‘৯ই জুলাই আমার শরীরটা খুব খারাপ ছিল। অনেক কৌশলে বাসা থেকে পালানোর চেষ্টা করি। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে তারাই আমাকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের একটি বাসে তুলে দেয়।

সেখান থেকে আমি বাড়ি চলে আসি।’ স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডা. মুশফিকা বলেন, মেয়েটির গায়ের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। আমরা তাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিয়েছি। এদিকে নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে থাকা লিমার বিষয়ে জানতে পেয়ে হাসপাতালে খবর নিতে গিয়ে হালুয়াঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিপ্লব কুমার বিশ্বাস বলেন, নির্যাতিতা কিশোরীর পরিবার যদি অভিযোগ দেয় পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এ ব্যাপারে গৃহকর্ত্রী মীমের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ভাই পরিচয়ে কাজল নামে একজন বলেন, মাসিক ৫ হাজার টাকা বেতনে ১ বছরের জন্য চুক্তি করে আছিয়ার মাধ্যমে এই বাসায় আসে লিমা। আমার বোনের বাসায় ছিল কয়েক মাস। লিমা নিজের গায়ে নিজেই আঘাত করেছে বলে তিনি জানান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status