প্রথম পাতা

সম্পাদকীয় নোট

এক মিডিয়া পণ্ডিতের বিদায়

১১ জুলাই ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:২৭ পূর্বাহ্ন

অকালে চলে গেলেন একজন সাদা মনের চমৎকার মানুষ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। আমরা সবসময় তার বহমান অনিন্দ্য সুন্দর জীবনের গুণগ্রাহী ছিলাম, তার বেদনাবিধূর মরণের পরেও থাকবো। মানুষ হিসেবে তিনি হয়তো নিশ্চয় কোনো রাজনৈতিক দলের নীতি আদর্শের অনুসারী থাকতে পারেন।

কিন্তু এটুকু বলতে পারি, তাকে কখনও অন্ধ হতে দেখিনি। সংবাদ মাধ্যমের বিশিষ্ট বরণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। কিন্তু কখনও ব্যক্তিস্বার্থে দূরে থাক, নিজের আবেগ, চিন্তা-চেতনাকে অন্যের অনুভূতির প্রতি উদাসীন থেকে প্রাধান্য দিতেন না। ভিন্নমতের প্রতি নিরাপত্তা ও সুরক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে এখানেই তিনি ব্যতিক্রম ছিলেন। এখানেই তাকে আলাদাভাবে চেনা যায়। শত মানুষের ভিড়ে তিনি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকবেন।

বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর একজন স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকবেন।  
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর নোবেল জয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের ভাই। এই পরিচয় দিতে প্রয়োজনের তুলনায় যেন তিনি বেশিই সতর্ক ছিলেন। এমনকি যাকে তারা ঘনিষ্ঠভাবে  দেখেছেন, তারাও একবাক্যে মানবেন যে, বিতর্ক যখন যেমনই হোক, তিনি সকল পরিস্থিতিতে যুক্তি ও তথ্যনিষ্ঠ থাকতে সচেষ্ট ছিলেন। কোনো ধরনের স্বার্থের টানাপড়েনে জড়িয়ে তিনি মেধাবৃত্তিক, বুদ্ধিজাত সিদ্ধান্তের বাইরে যেতেন না।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। গণতান্ত্রিক ঘাটতির গভীরতা তাকে সর্বক্ষণ পীড়িত করেছে। তবে তার রক্তক্ষরণ কখনও প্রতিষ্ঠিত সৌজন্য ও শিষ্টাচারের সীমা অতিক্রম করতে দেয়নি। কারণ তিনি বাকসংযম প্রদর্শনের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি সাংবাদিকতাকে ভালোবেসে ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত এলেও তিনি কখনও তার নীতি ও আদর্শকে জলাঞ্জলি  দেননি। তিনি গণমাধ্যম কর্মী ছিলেন। গণমাধ্যমের শিক্ষক, প্রশিক্ষক ছিলেন।  

একথা মানতেই হবে যে, বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা এবং তার জবাবদিহির অতন্দ্র প্রহরী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও তিনি তার লেখালেখির জগৎকে প্রধানত বাকস্বাধীনতার সীমায় বৃত্তাবন্দি রাখার সযতন প্রয়াস চালিয়েছেন। তার প্রমাণ প্রথম আলো, মানবজমিনসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তার  লেখাগুলো। তার প্রকাশিত ২৫টির বেশি বইয়ের বিষয়বস্তুও সেই সাক্ষ্য দেবে।  
এমন একজন নিবেদিতপ্রাণ মিডিয়া গবেষকের প্রস্থান বাংলাদেশ তথা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের অঙ্গনে একটা শূন্যতা তৈরি হলো, যা খুব সহজে পূরণ হওয়ার নয়।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এমন যুক্তিবাদী, জ্ঞানমনস্ক, পাণ্ডিত্যপূর্ণ কণ্ঠস্বর খুব বেশি নেই। তার সঙ্গে তুলনা করা চলে এমন পেশাজীবী বিরল।  সেই সঙ্গে আমরা যদি একজন মানুষ হিসেবে তিনি কতোটা বিনম্র, সদালাপী এবং ভিন্নমতের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন,  সেসব বিবেচনায় নেই তাহলে মানতে হবে  যে, আমরা একজন নিভৃতচারী আলোকবর্তিকাকে হারালাম। মিডিয়ার মানুষ হয়েও কীভাবে একজন মিডিয়ায় নিজেকে প্রকাশে নির্মোহ থাকতে পারেন, তিনি তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।  

তিনি বেঁচে থাকবেন তার প্রতিটি শব্দে, কর্মে ও কর্মক্ষেত্রে। বিশেষ করে বেশকিছু বিষয়ে পথিকৃতের আসনটি তারই। বিশেষ করে বিটিভিতেই তিনি টকশো চালু করেছিলেন একবিংশ শতাব্দী শুরুর আগেই।

এটাও লক্ষণীয় যে, চট্টগ্রাম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি সক্রিয় ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু সে রাজনীতি কিংবা তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কখনও তার নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ দূরে থাক, এতটুকু প্রভাব ফেলতে পারেনি।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের কোনো লেখা বা বলা কখনও অনভিপ্রেত বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এমনটা বোধকরি কেউ বলতে পারবেন না। তাকে একজন নিরপেক্ষ পণ্ডিত হিসেবেই আমরা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই। যিনি আমাদের জন্য নীতি ও নৈতিকতা  রেখে গেছেন, যা অনুকরণীয়।  

মনে পড়ে, সমপ্রচার নীতিমালার বাতিল চেয়ে ২০১৪ সালের ১৪ই আগস্ট তিনি প্রথম আলোয় একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যাতে সরকার ও সাংবাদিক উভয়ের জন্য বার্তা ছিল।

তিনি লিখেছিলেন: ‘টকশোতে আলোচকেরা স্বাধীনভাবে তাঁদের মতামত প্রকাশ করেন। তা অব্যাহত থাকতে দিতে হবে। মতামতের কাউন্টার মতামত থাকতে পারে। সেটা এখনো প্রতি টকশোতে দর্শক-শ্রোতারা শুনছেন। তবে খবর ও টকশোতে ভুল তথ্য  দেয়ার কোনো সুযোগ রাখা উচিত নয়। কেউ ভুল তথ্য দিলে এবং তার প্রতিবাদ পাওয়া  গেলে তা পরদিন ঠিক একই অনুষ্ঠানে প্রচার করতে হবে। ভুল তথ্য প্রচারের জন্য আলোচক ও উপস্থাপককে ক্ষমা চাইতে হবে। তবে মতামত বা বিশ্লেষণ দেয়ার ব্যাপারে আলোচকেরা শতভাগ স্বাধীন।’

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এমন বহু পাণ্ডিত্যপূর্ণ মনোভঙ্গির মধ্যে বেঁচে থাকবেন।
যিনি আলোর ঘাটতির মধ্যেও নিরপেক্ষ, অকুতোভয়, সৎ থাকতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ এবং সফল। তিনি মহৎ প্রাণ। আদর্শস্থানীয়। তার মৃত্যু নেই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status