শেষের পাতা

সিলেট-আখাউড়া রেলপথে পদে পদে মৃত্যু ঝুঁকি

ইমাদ উদ দীন, মৌলভীবাজার থেকে

২৭ জুন ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:৩৩ পূর্বাহ্ন

শুধু ঠিকঠাক আছে রেল সড়ক। আর সবই শুধু নেই নেই। রেললাইন, ফিসপ্লেট, ক্লিপ, হুক, স্লিপার, নাট, বল্টু, সিগন্যাল সহযোগী যন্ত্রাংশ সবই আছে কেবল নামমাত্রই। মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিন, জরাজীর্ণ বগি, শিডিউল বিপর্যয়- এটা হলো এই অঞ্চলের রেল বিভাগের চলমান ও দৃশ্যমান দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এ থেকে উত্তরণ কেবল আশ্বাসের ফুলঝুরি। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, অঙ্গহানি, কিছুদিন হৈচৈ। তারপর সবই আগের মতো যেই সেই। কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজ এলাকার উপবন ট্রেন দুর্ঘটনাস্থলের আশেপাশে এখনো চোখে পড়ে চরম ঝুঁকিপূর্ণ জরাজীর্ণ রেললাইন। ত্যানা (পুরাতন কাপড়), সুতলি, প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে আটকানো হয়েছে ফিসপ্লেট ও নাট-বল্টু। অধিকাংশ স্থানে স্লিপারের সঙ্গে রেললাইন আটকানোর হুক ও ক্লিপ নেই। জয়েন্ট পয়েন্ট ও ক্রসিং পয়েন্টের ফিসপ্লেট ও নাট-বল্টু থ্রেটহীন অকার্যকর।

কোনো যন্ত্রের সাহায্য ছাড়া হাত দিয়েই সহজেই খোলা যাচ্ছে নাট। ট্রেন চলাচলের সময় জয়েন্ট পয়েন্টগুলো ফাঁক হয়ে যাচ্ছে। ট্রেনের বগিগুলোও অনেকটা কাত হয়েই ওই স্থান দিয়ে চলে। এমন নাজুক অবস্থায় রেললাইন কোনো রকম জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে। গতকাল দুইজন মন্ত্রী আসলেন। সরজমিন দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করলেন। তাদের পরিদর্শনের পরও পরিবর্তন হলো না ওই এলাকার রেললাইনের ছোট ছোট দৃশ্যমান সমস্যার। বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজের আশেপাশের অনেক জায়গায় রেললাইনের নানা ত্রুটি দেখিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীদের ক্ষোভের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন- এটা তো রেললাইন নয় যেন একটি মরণ ফাঁদ। তা না হলে এতদিন থেকে এই লাইনটি এত ত্রুটি নিয়ে চলছে কি ভাবে? এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কোনো মাথাব্যথা নেই কেন? অভিযোগ দিলেও তারা তা আমলে নেন না কেন? খোদ রেলমন্ত্রী আসলেন। তার সঙ্গে বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী এখানে আসলেন।

এত কিছুর পরও দুর্ঘটনার আশেপাশে এখনো ত্যানা, সুতলি আর পলিথিন ব্যাগ দিয়েই আটকানো হয়েছে নাট-বল্টু আর ফিসপ্লেট। সংশ্লিষ্ট বিভাগের লোকজন আন্তরিক থাকলে অত্যন্ত এই ছোট ছোট দৃশ্যমান ত্রুটিগুলো সমাধান করতে পারতেন। তাদের কি পরিমাণ অবহেলা ও উদাসীনতা আমাদের বলা অভিযোগগুলোর বাস্তবতাই এটা। গণমাধ্যম কর্মীদের ওই ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইনে দাঁড়িয়ে একথাগুলো ক্ষোভের সঙ্গে বলছিলেন বরমচাল ইসলামাবাদের মনসুর আহমদ, শিপু আহমদ, ফয়সল আহমদ, জহির আলী, ইউপি সদস্য শাহানুর আহমদ সাধন, উত্তর ভাগের মো. নজরুল ইসলাম প্রমুখ। তারা জানালেন, আগে ট্রলি দিয়ে প্রতিদিনই রেল বিভাগের লোকজন লাইন চেক করতেন। এখন আর এই দৃশ্য নেই। এখন রেল তল্লাশিদের রেললাইনের কোথাও কোনো ত্রুটির কথা জানালেও তারা তা আমলে নেন না। ওদের অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় রেল বিভাগের কোনো অভিভাবকই নেই। তারা ইচ্ছে করেই মানুষকে দুর্ঘটনায় ফেলতে চাইছে। ইসলামাবাদ নন্দনগর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ আব্দুল মন্নান মিয়া, টিটু মিয়া, দক্ষিণ নন্দনগরের কামাল হোসেন, জাকারিয়া আলম, কালা মিয়া, ফুলেরতল বাজারের ব্যবসায়ী মফিজ আলী, মাধবপুরের আব্দুল জলিল রেললাইনের দুরবস্থা দেখিয়ে বলেন- সব নেই নেইর মধ্যে এভাবে কি করে ট্রেন চলাচল করে তা কিছুতেই বোধগম্য নয়। এই জরাজীর্ণ ট্রেন, ইঞ্জিন আর লাইন সব মিলিয়ে আল্লাহ ভরসা করে এই অঞ্চলের ট্রেনগুলো চলে। তারা ক্ষোভের সঙ্গে প্রশ্ন রেখে বলেন- এভাবে আর কত? যখন প্রতিদিনই বড় ধরনের দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও অঙ্গহানি ঘটবে তখনই হয়তো কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সিলেট-আখাউড়ায় রেললাইন এখন দিন দিন চরম ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

রেললাইনের সঙ্গে সংযুক্ত ক্লিপ-হুক, ফিসপ্লেট, নাট-বল্টু, স্লিপার ক্রমেই দুর্বল হয়ে কার্যক্ষমতা হারাচ্ছে। রেললাইনের ভেতর নেই পর্যাপ্ত পাথর। আর ওই রেলপথের নানা স্থানে বৃটিশ আমলের নির্মিত রেলসেতু ও কালভার্টসমূহের উপর জীর্ণশীর্ণ কাঠের স্লিপারের সঙ্গে পেরেক দিয়ে বাঁশের ফালি স্থাপন করে কোনোরকম আটকানো হয়েছে রেললাইন। ফলে, ট্রেন চলাচলের সময় ওই সব স্থান চরম দুর্ঘটনার আশঙ্কা ও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। প্রতিবছরই ম্যানটেনেন্স কাজ করার কথা থাকলেও তা শুধু কাগজে কলমে। এই সেকশন দিয়ে ঘণ্টায় ৬০ কি.মি. বেগে প্রতিদিন যাত্রীবাহী আন্তঃনগর, লোকাল ও মালবাহী মিলিয়ে প্রায় ১০-১২টি ট্রেন ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে। রেল বিভাগের অনেক কর্মকর্তা ও কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন- চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে দেশের অন্যতম পুরনো রেলপথ সিলেট-আখাউড়া। এখন অনেকটাই নড়বড়ে রেল সেতু ও লাইন। দ্রুত মেরামত কিংবা নির্মাণ না হলে ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা। জানা যায়, সিলেট আখাউড়া রেলপথের ১৭৯ কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ২৫-৩০টি সেতু ও কালভার্ট চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর বাকিগুলো আছে ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায়।

এ ছাড়া অনেক স্টেশন বন্ধ রয়েছে কিংবা জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনোরকম টিকে আছে। এগুলো দ্রুত মেরামত না করলে যেকোনো সময় ভেঙে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। সম্প্রতি সিলেট- আখাউড়া রেললাইনে বেড়ে চলা দুর্ঘটনায় চরম উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় এ অঞ্চলের যাত্রীরা। সিলেটবাসীর জোর দাবি যেন দ্রুত এই জরাজীর্ণ রেললাইনটির (সার্বিক) মেরামত ও নির্মাণ করার। এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল বড়ছড়া ব্রিজের ট্রেনের দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শনের পর সংক্ষিপ্ত পথসভায় বলেন- বিএনপি-জামায়াত জোটের সময় রেল বিভাগের কোনো উন্নয়ন হয়নি। মন্ত্রী বলেন- এই সরকারের আমলে আলাদা মন্ত্রণালয় হয়েছে। দৃশ্যমান নানা উন্নয়ন হয়েছে ও হচ্ছে। এ সময় স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে বরমচাল স্টেশনে ২টি আন্তঃনগর ট্রেন স্টপিজের আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে আরো স্টপিজ বাড়ানোর কথাও বলেন। ঢাকা-সিলেট রেললাইন ডুয়েল গেজ হবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন- এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৬টি আধুনিক রেলস্টেশন স্থাপন করা হবে। এ জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত করতে ইতিমধ্যেই ১৬ হাজার ১৪৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) নির্বাহী কমিটি অনুমোদন করেছে। দ্রুত তা বাস্তবায়নের কাজও চলছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status