শেষের পাতা
বাজেট নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে: সিপিডি
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৪ জুন ২০১৯, সোমবার, ৯:৪৩ পূর্বাহ্ন
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, আগামী অর্থবছরের (২০১৯-২০) প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে। একই সঙ্গে নিয়মিত করদাতাদের নিরুৎসাহিত করবে। সেই তুলনায় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন বিত্তশালীরা। কারণ বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগসহ নানা সুবিধা দেয়া হয়েছে। যা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের পরিপন্থি। গতকাল রাজধানীর গুলশানে হোটেল লেকশোরে ‘সিপিডি বাজেট ডায়ালগ ২০১৯: অ্যান অ্যানালাইসিস অব দ্য ন্যাশনাল বাজেট ফর ২০১৯-২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটি।
এতে সভাপতিত্ব করেন সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ ছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মোকাব্বির খান, বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ব্যবসায়ী নেতা এম আকরাম, তাবিথ আউয়াল, মনজুর আহমেদ, হেলাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সিপিডির প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সংলাপ পরিচালনা করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, এবারের বাজেটে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের জরুরি সংস্কারের বিষয়টি বাজেটে জোরালোভাবে উঠে আসেনি। এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারসংক্রান্ত সংস্কারের উদ্যোগও তেমন নেই। এসব সংস্কার ছাড়া বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের কড়া সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজেটে দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে। আর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন বিত্তশালীরা। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি ও এ সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। তবে সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা সব ক্ষেত্রে মানা হয়নি। ইশতেহারে সরকার কৃষকদের বন্ধকমুক্ত ঋণ দেয়ার দেয়ার কথা বলেছিল। তবে বাজেটে সে বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মোট বাজেটের যত অংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তার চেয়ে কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনেও কম বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হলেও তাতে কোনো নতুনত্ব নেই। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। বাজেটে সরকার ‘কৃষি বীমা’ চালুর যে প্রস্তাব করেছে, সেটিকে সাধুবাদ জানিয়ে এটির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানায় সিপিডি। ২০০৯-১০ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করে সিপিডি বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটের আকারে বরাদ্দ কমেছে। ওই সময় মোট বাজেটের ১২ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল। আগামী অর্থবছরে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে মোট বাজেটের ১১.৭ শতাংশ।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কোনো সরকারই নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনী ইশতেহারকে গুরুত্ব দেয়নি। এবারের বাজেটেও সেটাই হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে যত আলোচনা হয়, সেখানে শুধু বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হয়। বরাদ্দের অর্থ খরচ করার পর কী ফল পাওয়া গেল, তা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। এ দেশে ব্যাপক দারিদ্র্যবিমোচন হয়েছে, এটা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু দারিদ্র্যবিমোচনের সঙ্গে সঙ্গে আয়-বৈষম্যও বেড়েছে। বেড়েছে সামাজিক বৈষম্য। এটি নিয়ে আলোচনা কম হয়। ভর্তুকি দিচ্ছি, করে ছাড় দিচ্ছি, ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিচ্ছি, এই ধরনের সুবিধার কারণেই সমাজে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।
আলোচনায় পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান বলেন, বাজার প্রভু’র চাহিদা অনুযায়ী অর্থনীতিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। তার এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিএনপি সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, “বাজার প্রভু” কারা? ওরাই “বাজার প্রভু” যারা সংসদে আছেন, ব্যবসায় আছেন, রাজনীতিতে আছেন। যারা ভোট চুরি করে ক্ষমতায় বসে আছেন। এই চক্রের মধ্যেই বসে আছে “বাজার প্রভু”।
অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের সমালোচনা করে প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আপনারাই বইয়ে পড়ান, উন্নয়নের পথে বৈষম্য তৈরি হয়। কিন্তু এই ধরনের বৈষম্য দূর করতে বাজেটের মাধ্যমে বিশাল সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। তবে এমন কোনো সমাজ নেই যেখানে বৈষম্য নেই।
বাজেটে বরাদ্দ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “বাজার প্রভু”র চাহিদা অনুযায়ী অর্থনীতিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। দুই মাঠ নিয়ে খেললে দুই রকম খেলাই হবে, এক রকম নয়। আমরা হাওর-বাঁওড়সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাজেট তৈরি করি, বরাদ্দ দিই। তারাই বলেন, ১০ বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে। আর আপনারা লেক শোর হোটেল, প্রেস ক্লাব ও অফিসে চা খেতে খেতে আলোচনা করেন। মাঠের ভিন্নতার কারণে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য নিরসন। এ জন্য অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। আপনারা যা-ই বলেন, দেশে বর্তমানে হতদরিদ্র মানুষের হার ৫ শতাংশের বেশি নেই। সেই হিসাবে দেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ লাখ। ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলেও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
পরে ‘বাজার চাহিদা’র বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, তিনি (পরিকল্পনামন্ত্রী) বলেছেন, বাজার হচ্ছে প্রভু। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ “বাজার” নয়। ওরাই “বাজার প্রভু” যারা সংসদে আছেন, ব্যবসায় আছেন, রাজনীতিতে আছেন। যারা ভোট চুরি করে ক্ষমতায় বসে আছেন। এই চক্রের মধ্যেই বসে আছেন ওরা।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রবৃদ্ধি উৎসের সূচকগুলো এত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাহলে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি কোথা থেকে আসলো? এত প্রবৃদ্ধি আসলে এক ধরনের বুদ?বুদ। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রবৃদ্ধির হিসাবটি এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সময় এখন বাংলাদেশের। কিন্তু ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।
আমীর খসরু বলেন, জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক থাকলে তিন তিনবার ভোট চুরি করতে হতো না। ভোটের আগের দিন একবার, ভোটের রাতে একবার, ভোটের দিন একবার চুরি করেছে। য?দি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে তাহলে, জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিন। একজন মানুষ যিনি ব্যবসায়, আবার সংসদে, আবার রাজনীতিতেও, যারা ভোট চুরি করেছেন তারা সব এক জায়গায়। এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সরকারের মূল প্রবৃদ্ধির বিষয়টা হবে প্রাইভেট সেক্টরের ব্যবসার মাধ্যমে। বিএনপির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে প্রাইভেট সেক্টরের লাভ দিয়ে। দেশে এখন মেগা প্রজেক্টের নামে ১২ কোটি টাকার প্রজেক্ট দেয়া হচ্ছে ৫০ কোটি টাকায়। জাহাজ ভাড়া বেশি দিচ্ছে। ছয় কোটির জায়গায় ৯ কোটি দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো মরতে বসেছে, মরতে দেন। দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় এসব ব্যাংকের ঘাটতি মেটাতে হবে কেন?
সরকারদলীয় সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, সিপিডির বিশ্লেষণে আমরা সমৃদ্ধ হই। তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পানিভর্তি গ্লাসের অর্ধেক খালি না দেখে অর্ধেক পূর্ণ দেখলে জাতি উপকৃত হবে।
বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহান বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ। অবলোপন ধরলে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছে, নানা রকম লুকিয়ে রাখা ঋণ যদি এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় তাহলে সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে। যা বিপজ্জনক।
বাজেটের নানা দিক সমালোচনা করে তিনি বলেন, একটা বাজেট সরকারের চরিত্রকে স্পষ্ট করে দেয়। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ। অতি ধনী মানে ২৫০ কোটি টাকার ওপরে যাদের সম্পদ। গরিব বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, দরিদ্র ও ধনীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে, এটা কমানোর ব্যাপারে বাজেটে কিছুই বলা নেই।
এতে সভাপতিত্ব করেন সিপিডি চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। এ ছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মোকাব্বির খান, বিএনপির সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান, ব্যবসায়ী নেতা এম আকরাম, তাবিথ আউয়াল, মনজুর আহমেদ, হেলাল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে সিপিডির প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সংলাপ পরিচালনা করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান।
সিপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, এবারের বাজেটে ব্যাংকসহ আর্থিক খাতের জরুরি সংস্কারের বিষয়টি বাজেটে জোরালোভাবে উঠে আসেনি। এ ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বিচারসংক্রান্ত সংস্কারের উদ্যোগও তেমন নেই। এসব সংস্কার ছাড়া বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটের কড়া সমালোচনা করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজেটে দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে। আর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবেন বিত্তশালীরা। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করলে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি ও এ সংশ্লিষ্ট খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। তবে সরকার তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা সব ক্ষেত্রে মানা হয়নি। ইশতেহারে সরকার কৃষকদের বন্ধকমুক্ত ঋণ দেয়ার দেয়ার কথা বলেছিল। তবে বাজেটে সে বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মোট বাজেটের যত অংশ স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ ছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তার চেয়ে কমেছে। জলবায়ু পরিবর্তনেও কম বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হলেও তাতে কোনো নতুনত্ব নেই। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। বাজেটে সরকার ‘কৃষি বীমা’ চালুর যে প্রস্তাব করেছে, সেটিকে সাধুবাদ জানিয়ে এটির দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানায় সিপিডি। ২০০৯-১০ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করে সিপিডি বলছে, প্রস্তাবিত বাজেটের আকারে বরাদ্দ কমেছে। ওই সময় মোট বাজেটের ১২ শতাংশ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল। আগামী অর্থবছরে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে মোট বাজেটের ১১.৭ শতাংশ।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি কোনো সরকারই নির্বাচিত হওয়ার পর নির্বাচনী ইশতেহারকে গুরুত্ব দেয়নি। এবারের বাজেটেও সেটাই হয়েছে। তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে যত আলোচনা হয়, সেখানে শুধু বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা হয়। বরাদ্দের অর্থ খরচ করার পর কী ফল পাওয়া গেল, তা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। এ দেশে ব্যাপক দারিদ্র্যবিমোচন হয়েছে, এটা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু দারিদ্র্যবিমোচনের সঙ্গে সঙ্গে আয়-বৈষম্যও বেড়েছে। বেড়েছে সামাজিক বৈষম্য। এটি নিয়ে আলোচনা কম হয়। ভর্তুকি দিচ্ছি, করে ছাড় দিচ্ছি, ব্যাংকের ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিচ্ছি, এই ধরনের সুবিধার কারণেই সমাজে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে।
আলোচনায় পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নান বলেন, বাজার প্রভু’র চাহিদা অনুযায়ী অর্থনীতিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। তার এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন বিএনপি সরকারের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, “বাজার প্রভু” কারা? ওরাই “বাজার প্রভু” যারা সংসদে আছেন, ব্যবসায় আছেন, রাজনীতিতে আছেন। যারা ভোট চুরি করে ক্ষমতায় বসে আছেন। এই চক্রের মধ্যেই বসে আছে “বাজার প্রভু”।
অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের সমালোচনা করে প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, ‘আপনারাই বইয়ে পড়ান, উন্নয়নের পথে বৈষম্য তৈরি হয়। কিন্তু এই ধরনের বৈষম্য দূর করতে বাজেটের মাধ্যমে বিশাল সামাজিক নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা হয়েছে। তবে এমন কোনো সমাজ নেই যেখানে বৈষম্য নেই।
বাজেটে বরাদ্দ সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “বাজার প্রভু”র চাহিদা অনুযায়ী অর্থনীতিতে বরাদ্দ দেয়া হয়। দুই মাঠ নিয়ে খেললে দুই রকম খেলাই হবে, এক রকম নয়। আমরা হাওর-বাঁওড়সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে কথা বলে বাজেট তৈরি করি, বরাদ্দ দিই। তারাই বলেন, ১০ বছরে অনেক উন্নতি হয়েছে। আর আপনারা লেক শোর হোটেল, প্রেস ক্লাব ও অফিসে চা খেতে খেতে আলোচনা করেন। মাঠের ভিন্নতার কারণে দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র্য নিরসন। এ জন্য অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। আপনারা যা-ই বলেন, দেশে বর্তমানে হতদরিদ্র মানুষের হার ৫ শতাংশের বেশি নেই। সেই হিসাবে দেশে হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০ লাখ। ব্যাংক কমিশন গঠনের প্রস্তাব চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলেও জানান পরিকল্পনামন্ত্রী।
পরে ‘বাজার চাহিদা’র বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, তিনি (পরিকল্পনামন্ত্রী) বলেছেন, বাজার হচ্ছে প্রভু। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্বজনতোষণ পুঁজিবাদ “বাজার” নয়। ওরাই “বাজার প্রভু” যারা সংসদে আছেন, ব্যবসায় আছেন, রাজনীতিতে আছেন। যারা ভোট চুরি করে ক্ষমতায় বসে আছেন। এই চক্রের মধ্যেই বসে আছেন ওরা।
মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রবৃদ্ধি উৎসের সূচকগুলো এত প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাহলে ৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি কোথা থেকে আসলো? এত প্রবৃদ্ধি আসলে এক ধরনের বুদ?বুদ। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, প্রবৃদ্ধির হিসাবটি এখন রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, সময় এখন বাংলাদেশের। কিন্তু ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে না। মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে।
আমীর খসরু বলেন, জনগণের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক থাকলে তিন তিনবার ভোট চুরি করতে হতো না। ভোটের আগের দিন একবার, ভোটের রাতে একবার, ভোটের দিন একবার চুরি করেছে। য?দি জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে তাহলে, জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিন। একজন মানুষ যিনি ব্যবসায়, আবার সংসদে, আবার রাজনীতিতেও, যারা ভোট চুরি করেছেন তারা সব এক জায়গায়। এদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সরকারের মূল প্রবৃদ্ধির বিষয়টা হবে প্রাইভেট সেক্টরের ব্যবসার মাধ্যমে। বিএনপির লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে প্রাইভেট সেক্টরের লাভ দিয়ে। দেশে এখন মেগা প্রজেক্টের নামে ১২ কোটি টাকার প্রজেক্ট দেয়া হচ্ছে ৫০ কোটি টাকায়। জাহাজ ভাড়া বেশি দিচ্ছে। ছয় কোটির জায়গায় ৯ কোটি দিচ্ছে। ব্যাংকগুলো মরতে বসেছে, মরতে দেন। দেশের সাধারণ মানুষের টাকায় এসব ব্যাংকের ঘাটতি মেটাতে হবে কেন?
সরকারদলীয় সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদ বলেন, সিপিডির বিশ্লেষণে আমরা সমৃদ্ধ হই। তবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পানিভর্তি গ্লাসের অর্ধেক খালি না দেখে অর্ধেক পূর্ণ দেখলে জাতি উপকৃত হবে।
বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য রুমিন ফারহান বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা মন্দ ঋণ। অবলোপন ধরলে ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছে, নানা রকম লুকিয়ে রাখা ঋণ যদি এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় তাহলে সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকার ওপরে। যা বিপজ্জনক।
বাজেটের নানা দিক সমালোচনা করে তিনি বলেন, একটা বাজেট সরকারের চরিত্রকে স্পষ্ট করে দেয়। বাংলাদেশ এমন একটা দেশ, অতি ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ। অতি ধনী মানে ২৫০ কোটি টাকার ওপরে যাদের সম্পদ। গরিব বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ। তিনি বলেন, দরিদ্র ও ধনীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়ছে, এটা কমানোর ব্যাপারে বাজেটে কিছুই বলা নেই।