অনলাইন

যে কারণে জাবির ভিসিজোটের পরাজয়

শাহাদাত হোসাইন স্বাধীন, জাবি থেকে

২৩ জুন ২০১৯, রবিবার, ১০:৫১ পূর্বাহ্ন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অভ্যন্তরীণ কোন্দলে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ভরাডুবির পর এবার সিনেট সিন্ডিকেটে হেরে গেছেন জাবির ভিসিপন্থি প্রার্থীরা। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কেন বারবার হেরে যাচ্ছেন জাবির ভিসিপন্থিজোট।

জানা যায়, গত ১৭ই জুন অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার থাকার পরও সিনেট প্রতিনিধির পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে চারজন এবং সিন্ডিকেট  প্রতিনিধির দু’জন প্রার্থীর মধ্যে ১ জন ভিসি সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হন। সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরও ভিসিজোটের বারবার হেরে যাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির মধ্যে ‘অবিশ্বাস-সন্দেহ’ চরম আকার ধারণ করেছে।

গত জানুয়ারীতে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার থাকার পরও গড়ে ৫০ ভোটে  হেরেছিল ভিসি প্যানেল। অনুসন্ধানে পরাজয়ের কারণ হিসেবে উঠে আসে সম্পাদক প্রার্থী নিয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাসা ভাড়া ভাতা কমানো নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ, সিনিয়র শিক্ষকদের ডিঙিয়ে জুনিয়র শিক্ষকদের ‘এ’ টাইপ বাসা বরাদ্দ, প্রশাসনে জুনিয়রদের পদায়ন নিয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের অসন্তোষ। বিপরীতে আওয়ামী লীগের একাংশসহ গঠিত ত্রিদলীয় ‘সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ’ সভাপতি, সম্পাদকসহ ১০টি পদে জয়লাভ করেন।

পরিস্থিতির চাপে পড়ে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর শরাণাপন্ন হন। প্রধাননমন্ত্রীর কার্যালয়ের সমঝোতায় আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ অংশ ভিসির সঙ্গে এক হলে লিখিতভাবে ভিসিজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বিদ্রোহী অংশের সঙ্গে ভিসি ফারজানাপন্থি অংশের অবিশ্বাস-সন্দেহ এখনো রয়ে গেছে। যার সর্বশেষ প্রতিফলন হচ্ছে সিনেট সিন্ডিকেট নির্বাচনে জোটের হার।

সম্প্রতি ভিসিপন্থি এক শিক্ষকের মন্তব্যে এই সন্দেহ আরও সূদৃঢ় হয়েছে। ভিসিপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক আলী আজম তালুকদার নির্বাচনের হার নিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা যারা আগে থেকে ভিসির সঙ্গে ছিলাম তাদের এবং নতুন যোগ দেয়া শিক্ষকদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি অবশ্যই রয়েছে। এ ঘাটতির কারণেই হয়তো নির্বাচনে আমাদের ভরাডুবি। ভিসি এ বিষয়ে এখনই সচেতন না হলে সামনে তাকে আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।

তবে সম্প্রতি যোগ দেয়া অংশের নেতা অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার অবশ্য এই দাবি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, যেসব শিক্ষক এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তারা আসলে নিজেদের দুরাবস্থা ঢাকতে চাচ্ছেন। আমাদের মধ্যে বিশ্বাস-যোগ্যতার কোনো ঘাটতি নেই।

প্রতিক্রিয়ায় ভিসিপন্থি একজন প্রভোস্ট জানান, শিগগিরই দলের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আলী আজম তালুকদারের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানানো উচিত। একজনের ব্যক্তিগত মন্তব্যের জন্য দল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না।

তবে বিভিন্ন অনুসন্ধান বলছে, সমঝোতার পরও অস্বস্তিতে দু’পক্ষের শিক্ষক নেতারা। নানা সময় শিক্ষক নেতারা গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে সে অস্বস্তির কথা জানানও দেন।  যোগ দেয়া শিক্ষক নেতারা আশা করছিলেন যোগ দেয়ার পর সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। প্রশাসনিকভাবে তারা মূল্যায়িত হবেন। কিন্তু আদতে সেটা ঘটেনি। অন্যদিকে সূত্র বলছে, তাদের মূল্যায়ন করতে গেলে সঙ্কটকালীন সময়ে ভিসির সঙ্গে শিক্ষকদের অসন্তোষে পড়তে পারেন ভিসি। এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে  দেখছেন বিশ্লেষকরা।

জানা যায়, যোগ দেয়ার পরও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ইফতারের দাওয়াতে ভিসি অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের নিয়ে যাননি। এই কারণে অনেক শিক্ষক অসন্তুষ্ঠ। এছাড়া প্রায় ১১৩ জন নতুন শিক্ষক যোগ দেয়ার পরও ভিসিপন্থি শিক্ষক সংগঠনের কিঞ্চিত নাম পরিবর্তন করা হলেও শীর্ষ পদে তাদের মধ্যে কাউকে রাখা হয়নি। এটাও একটা  ক্ষোভের কারণ।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ১৪৪৫ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প নিয়ে যোগ দেয়া শিক্ষকসহ ভিসিপন্থি অনেক সিনিয়র শিক্ষককে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা ব্যালোটে তার জবাব দিয়েছে বলে জানা যায়।

পরিবহনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিসিপন্থি শিক্ষকের আরেকটি মন্তব্যেও ভোটারদের অসন্তুষ্ট করে বলে জানা যায়। ভোটের দিন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া শিক্ষক বাস ছিল বিকেল ৫টায়। কিন্তু ভোট দেয়ার শেষ সময় ছিল মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত। নির্বাচনকালীন সময়ে ওই শিক্ষক  বিকেল ৫টার পর কোন বাস দিতে পারবেন না বলে ঘোষণা করেন বলে জানান এক শিক্ষক জানান। এই মন্তব্য অনেক ভোটার ভালভাবে নেয়নি বলে ধারনা করা হচ্ছে।

অন্যদিকে ভিসিপন্থি শিক্ষক পর্ষদের সম্পাদক নির্বাচনের সময় দেশের বাইরে ছিলেন। নির্বাচনে ভোট চেয়ে অনেক শিক্ষকদের কাছে শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠানোও হয়নি দলের পক্ষে।

তাছাড়া প্রার্থীতা বাছাইয়ে নিজেদের অসচেতনতার কথা স্বীকার করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভিসিজোটের একজন শিক্ষক।  তিনি বলেন, প্রতিপক্ষ দল ব্যাপক গোপনীয়তার মাধ্যমে দক্ষ একটি প্যানেল ঘোষণা করেছে। কিন্তু আমাদের প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দলীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।

এদিকে ভিসির একান্ত সচিব সানোয়ার হোসেনের ‘খবরদারি’ নিয়ে অনেক সিনিয়র শিক্ষক ক্ষোভের কথা জানান এই প্রতিবেদকের কাছে। তারা বলেন, আমরা রাজনীতির করছি যুগের চেয়ে বেশী সময় ধরে। কিন্তু একজন কর্মকর্তা হঠাৎ করে বাঘা বাঘা  নেতাদের চেয়ে প্রভাবশালী হয়ে  গেছে। এটা তো মেনে নেয়া যায় না।

এর পাশাপাশি প্রশাসনের রদবদলের শুরু থেকে থাকা ভিসিপন্থি জুনিয়র শিক্ষকদের প্রাধান্য দেয়াকে একটি বার্তা হিসেবে নিচ্ছেন সদ্য যোগ দেয়া শিক্ষকরা। জানা যায়, গত ২৩শে মে বিশ্ববিদ্যালয়ে মীর মশাররফ হোসেন ও আল বেরুনী হলের প্রভোস্টের  মেয়াদ শেষ হলে দু’জন ওয়াডেনকে চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়। যাদের দু’জনই সহযোগী অধ্যাপক। সদ্য যোগ দেয়া একাধিক সিনিয়র অধ্যাপক এই পদদ্বয়ের দাবিদার ছিলেন।

আরেকটি বিশ্লেষণ বলছে, এই নির্বাচনে ভিসিজোট মূলত কলা ও মানবিকী অনুষদের  ভোট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই অনুষদে প্রভাবশালী একজন অধ্যাপক নিজেকে জানান দিতে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি ভিসি পন্থিদের ভোট না দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলেন ভিসিপন্থি এক শিক্ষক দাবি করেন।

যোগাযোগ করা হলে ভিসিপন্থি বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক মান্নান চৌধুরী বলেন, আমরা কেন হেরেছি এটা আলোচনার বিষয়। আমাদের অনেক শুভাকাঙ্খীর কাছে আমরা ঠিকমত পৌঁছাতে পারি নি। নির্বাচনে আমরা সিরিয়াস ছিলাম না। ভবিষ্যতে আমরা সতর্ক থাকব।

ভিসিপন্থি এক অধ্যাপকের বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে দলের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের দলের সম্পাদক দেশের বাইরে আছেন, তিনি আসলে এই ব্যাপারে জানানো হবে।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status