শেষের পাতা

হত্যাকাণ্ডের এক মাস পর মামলা রেকর্ড

পুলিশ বলেছিলো পোস্টমর্টেম ছাড়া মামলা হবে না

রুদ্র মিজান

২১ জুন ২০১৯, শুক্রবার, ৯:৪৫ পূর্বাহ্ন

রাতের আঁধারে ‘পিটিয়ে হত্যা’ করা হয়েছে রবিউল ইসলামকে। তার শরীর জুড়ে ছিলো সেই আলামত। পিঠে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। ঢাকা মেডিকেল কর্তৃপক্ষ সুপারিশ করেছিলো লাশের পোস্টমর্টেমের। তারপরও পোস্টমর্টেম করানো হয়নি। এমনকি হত্যাকাণ্ডের পর বারবার থানা পুলিশের দ্বারস্থ হলেও মামলা নেয়া হয়নি। থানা পুলিশ জানিয়েছে, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ছাড়া মামলা হবে না। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হয়েই মামলা রেকর্ড করতে হবে। আইনজীবীরা বলেছেন, মামলা নিতে সময়ক্ষেপণ করে পুলিশ অন্যায় করেছে। এ বিষয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। রবিউলের মৃত্যুর এক মাস পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে মিলেছে হত্যার আলমত। নিহতের স্বজনদের দৌড়ঝাঁপে এক মাস পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেয়ে মামলা রেকর্ড করে পুলিশ। কিন্তু এই হত্যা মামলায় এখনও কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এই অবস্থায় এই হত্যা মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন নিহতের স্বজনরা। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।

গত ২৯শে এপ্রিল রাজধানীর বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় রবিউলের লাশ। পটুয়াখালী জেলা সদরের টাউনজৈনকাঠী গ্রামের  আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার পুত্র রবিউল (২১) ঢাকার বাড্ডা এলাকায় থাকতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছর ধরে বাড্ডার গুদারঘাট এলাকায় আত্মীয় মামুন মৃধার বাড়িতে ছিলেন। ঘটনার দিনও মামুনের বাসার পাশ থেকেই তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, এই হত্যাকাণ্ডে মামুন মৃধা ও তার স্বজনরা জড়িত। রবিউলের মৃত্যুর পর তাড়াহুড়া করে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয় তার লাশ। মেডিকেল কর্তৃপক্ষ পোস্টমর্টেমের সুপারিশ করলেও কৌশলে তা করানো হয়নি। নিহতের চাচাতো ভাই সিরাজ ও চাচাতো বোন আসমাকে ডেকে এনে লাশটি তাদের কাছে হস্তান্তর করেন মামুন মৃধা। রবিউলের স্বজনরা জানান, রবিউলের মৃত্যর পর মামুন মৃধা ও তার ভাগ্নে সাহাদাতের আচরণ ছিলো রহস্যময়।

সিরাজ জানান, স্ট্রোক করে রবিউলের মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তাদের ডেকে আনেন মামুন মৃধা। খবর পেয়ে তারা ঢামেক হাসপাতালে যান। সেখানে পৌঁছার পর দ্রুত রবিউলের লাশ বুঝিয়ে দেয়া হয় তাদের। এসময় ঢামেক হাসপাতাল এলাকায় এম্বুলেন্সের মধ্যে প্যাকেট করা অবস্থায় ছিলো রবিউলের লাশ। রবিউলের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলা সদরের টাউনজৈনকাঠী গ্রামে লাশটি নিয়ে যাওয়ার পরই ঘটে বিপত্তি। লাশ দেখে স্বজন ও গ্রামবাসী বুঝতে পারেন তাকে হত্যা করা হয়েছে। খবর পেয়ে পটুয়াখালী সদর থানা পুলিশ লাশটি উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে। পরে লাশ দাফন করে স্বজনরা ছুটে আসেন ঢাকায়। বাড্ডা থানায় যান মামলা করার জন্য। এ বিষয়ে নিহত রবিউলের মামা মিজানুর রহমান জানান, বারবার থানায় গিয়েছেন। ওসির সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু ওসি প্রতিবারই বলেছেন, এখন মামলা হবে না। এটি হত্যাকাণ্ড কি-না তা নিশ্চিত হলে তবেই মামলা হবে। এজন্য পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। মামলা করতে ব্যর্থ হয়ে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন তারা।

দীর্ঘ এক মাস পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসে। রিপোর্টে ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসকরা নিশ্চিত করেছেন শারীরিক আঘাতে রবিউলের মৃত্যু হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলেও রহস্যজনকভাবে মামলা নিতে গড়িমসি করে থানা পুলিশ। অবশেষে গত ১লা জুন মামলা করার সুযোগ পান নিহতের পরিবার। নিহত রবিউলের চাচা মো. চান মিয়া বাদি হয়ে মামলা করেন। এতে আসামি করা হয়, মামুন মৃধা, মামুন মৃধার স্ত্রী মণি বেগম, তার ভাগ্নে সাহাদাত, সাহাদাতের স্ত্রী সুবর্ণা বেগম,  মানিক মিয়া ও মমতাজ বেগমকে। রবিউলের স্বজনরা জানান, রবিউল চাকরি করে মা-বাবাকে টাকা দিতো না। টাকা জমাতো মামুনের কাছেই। বাসায় বসবাস ও জমানো টাকা নিয়ে মামুনের সঙ্গে মনোমালিন্য ছিলো রবিউলের। এছাড়াও নানা কারণে খারাপ সম্পর্ক ছিলো মামুনের ভাগ্নে সাহাদাতের সঙ্গে। হত্যাকাণ্ডের আগে তাদের মধ্যে প্রায়ই বাকবিতন্ডা হতো বলে অভিযোগ করেন তারা।

নিহত রবিউলের স্বজনদের অভিযোগ, মামলা করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আসামিরা  প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। উল্টো মামলা করার কারণে তাদের হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে বলে জানান রবিউলের স্বজনরা। তারা মনে করেন মামুন ও রবিউলকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদঘাটন হবে।

থানা পুলিশের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন তারা। মামলার তদন্তভার মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে হস্তান্তরের জন্য গত ১৮ই জুন ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে আবেদন করেছেন মামলার বাদি চান মিয়া। হত্যাকাণ্ডের পর মামলা রেকর্ড না করার কারণে সম্পর্কে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রাথমিকভাবে এটি আমাদের কাছে দুর্ঘটনা মনে হয়েছে। তাই মামলা নিতে ডিলে হয়েছে। ওসি আরও বলেন, ওই ছেলে (রবিউল) অসুস্থ ছিলো। রাস্তা থেকে পড়ে মারা যেতে পারে। তাছাড়া লাশ নিয়ে ওরা পটুয়াখালী চলে গিয়েছিলো। যে কারণে সুরতহালও পটুয়াখালীতে হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি জানান, এখনও কাউকে আটক করা হয়নি। তবে এই মামলার আসামি মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। পোস্টমর্টেম ছাড়া মামলা রেকর্ড না করা প্রসঙ্গে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ নাজমুল হুদা বলেন, মামলা না নিয়ে ভিকটিমের স্বজনদের প্রতি পুলিশ অবিচার করেছে। ভিকটিমের স্বজনরা যদি সন্দেহ করে বা এ সংক্রান্ত কোনো আলামত থাকে তারা মামলা করতে পারে। এমনকি কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে স্বজনরা বাদি না হলেও পুলিশ বাদি হয়ে মামলা করবে। সেখানে পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে পোস্ট মর্টেম রিপোর্টে যদি বিষয়টি হত্যাকাণ্ড না বলে প্রতিবেদন আসে তখন আসামিরা সুবিধা পাবেন বলে মনে করেন এই আইনজীবী। একইভাবে সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, হত্যাকাণ্ড একটি আমলযোগ্য অপরাধ। এটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড এবং অনুসন্ধান শুরু করা পুলিশের আবশ্যিক দায়িত্ব। এছাড়াও আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা যায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status