অনলাইন

রবি ও দুখু’র পোড়খাওয়া শৈশব: আমাদের আলোঘর

আমিরুল মোমেনীন মানিক

২৩ মে ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৫ পূর্বাহ্ন

১.
শৈশব মানেই দুরন্তপনা। ঝলমলে স্মৃতির পুকুর। বিস্তৃত সবুজ মাঠ, ঘুড়ি ওড়ানো বিকেল বেলা, আঁকাবাঁকা নদী, রোদ-বৃষ্টি চুঁইয়ে পরা পাঠশালা-  গ্রামে বেড়ে ওঠা শহুরে মানুষের রক্ত মাংসে ভীড় করে থাকে এসব অনুসঙ্গ। শৈশবের স্মৃতিগুলো পরিণত বয়সের সম্পদ। সোনাঝরা স্মৃতিই হয়ে ওঠে অন্তঃবিহীন প্রেরণা। বিখ্যাত মানুষের বালকবেলার অসাধারণ স্মৃতিরোমন্থন পড়ে পড়ে আমরা মিলিয়ে নিই নিজেদের কৈশোরকে। যার শৈশব-কৈশর যত সমৃদ্ধ তিনি ততটা শক্তিমান হয়ে ওঠেন পরিণত বয়সে। একজন বিখ্যাত কবি এ জন্যই বলেছেন, শৈশবে যার ঘাত-প্রতিঘাতের স্মৃতি নেই, তার জীবনে
রোমাঞ্চকর কিছুই নেই।

২.
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলেবেলাটা ছিল অন্যরকম। ঘরভর্তি বইয়ের মধ্যেই কেটেছে তার শৈশব। দুরন্ত শৈশবে কত কিছুই না উঁকিঝুকিঁ দিতো মনে। ঘরের বারান্দার রেলিংগুলোকে ছাত্র ভাবতেন তিনি। তাই ওগুলেকে ইচ্ছেমতো বেত দিয়ে পেটাতেন। রবি ঠাকুর নিজেই তার ছেলেবেলার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবেÑ‘আমি জন্মেছিলাম সেকেলে কলকতায়। শহরের শ্যাকড়াগাড়ি ছুটছে তখন ছড় ছড় করে ধুলো উড়িয়ে, হেইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিতে পায়ে চলতি মানুষকে।’
ছোটবেলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গৃহশিক্ষক ছিলেন মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বড়রা স্কুলে যাচ্ছে দেখে একদিন রবীন্দ্রনাথ খুব কান্না জুড়ে দিলেন। ইশ্কুলে যাবার জন্য চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন তিনি। কোনভাবেই তার কান্না থামছে না দেখে কষে একটা চড় মারলেন শিক্ষক মাধবচন্দ্র। রেগে বললেন, এখন স্কুলে যাইবার জন্য যেমন কাঁদিতেছ, না যাইবার জন্য ইহার চেয়ে ঢের বেশি কাঁদিতে হইবে।
ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন ছোট্ট রবি। কিন্তু ইশ্কুলের প্রতি আর আগ্রহ থাকল না তার। গৃহশিক্ষকের ওই কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হলো। পড়াশোনার প্রতি উদাসীন ছেলেকে পাঠানো হলো বিলেতে। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। ডিগ্রী না নিয়েই ফিরে এলেন। বিদ্যালয়ের প্রতি অনাগ্রহী শিশু রবীন্দ্রনাথই যে একদিন বিশ্ব সাহিত্যের উজ্বল নক্ষত্র হবেন, তা কি জানতেন মাধবচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ?
কিন্ত রবি ঠাকুরের সাফল্য একদিনে আসেনি। অসম্ভব পরিশ্রমী এই মানুষটি শেষ বয়সে এসে কখনোই দুপুরবেলায় ঘুমাতেন না। এমনকি ভোর হবার আগেই জেগে উঠতেন। সারাদিন নিমগ্ন থাকতেন পড়া আর লেখালেখিতে।

৩.
কাজী নজরুল ইসলামের শৈশবজীবন উপন্যাসের মতোই। অনেক কষ্টে পাওয়া সন্তান বলে বাবা-মা নজরুলের নাম দেন দুখু মিয়া। বাবার দেখাদেখি ছোটবেলায় মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ শুরু করেন নজরুল। গ্রামে আসে যাত্রাদল। নজরুলের মন পড়ে থাকে গান-বাজনায়। যোগ দেন লেটো দলে। বেশ আয়ও করতে থাকেন তিনি। এরপর চলে আসেন আসানসোলে। রুটির দোকানে। সেখানে পরিচয় হয় রফিজউল্লাহ দারোগার সঙ্গে। তিনি নিয়ে আসেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে। সব মিলিয়ে দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলেন নজরুল। প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট না থাকলেও কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর অসাধারণ প্রতিভা দিয়ে জয় করলেন বাংলা সাহিত্যকে। পড়ালেখা ছাড়া এত বড় হলেন কি করে, নজরুলের বেলায় এ প্রশ্ন আসতেই পারে। কিন্তু নজরুল ছিলেন ভীষণ পড়ুয়া। কোথাও কোনো বই পেলে তা নিমিষে পড়ে শেষ করে ফেলতেন। এমনকি প্রয়োজনে বই
চুরিও করতেন শিশু নজরুল। সেই দশ বারো বছর বয়সেই নজরুল পবিত্র কোরআন, হাদীস, রামায়ণ, মহাভারত পড়ে শেষ করে ফেলেছেন। আরবি, ফারসির উপরও তিনি এভাবেই দখল অর্জন করেন। প্রখর স্মৃতিশক্তি তাঁর বিকাশের বড় একটা মাধ্যম। যা পড়তেন তাই মনে রাখতে পারতেন।

৪.
মানুষ তার ভাগ্য সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তাই শৈশবে কেউ-ই বলতে পারেন না বড় হয়ে তিনি কি হবেন। সেকালে রবীন্দ্র-নজরুলও কেবলমাত্র তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে সাহিত্যকে জয় করেছেন। বিভিন্ন শাখায় একালে যারা খ্যাতিমান হয়েছেন বা হচ্ছেন তারা কি পরিশ্রম ছাড়াই অর্জন করেছেন সব? কখনোই না। তাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নষ্টালজিক-পোড়খাওয়া অতীত। খ্যাতিমানদের শৈশবের সেই অবোধ ছন্নছাড়া সময়গুলোই গড়ে তুলেছে তাদের সুন্দর আগামী।
সুতরাং, বন্ধু নামো পথে/ কথা হবে যেতে যেতে।

লেখক পরিচিতি: প্রধান বার্তা সম্পাদক, চেঞ্জ টিভি. প্রেস এবং টক-শো উপস্থাপক, এশিয়ান টিভি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status