বাংলারজমিন

নীলফামারীতে ইটভাটা গিলে খাচ্ছে আবাদি জমি

নীলফামারী প্রতিনিধি

২১ মে ২০১৯, মঙ্গলবার, ৮:২৫ পূর্বাহ্ন

বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ইটভাটা মালিকরা। কোনো কিছুতেই দমানো যাচ্ছে না তাদের দৌরাত্ম্য। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা আদায় করেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না ইটভাটাগুলো। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যে যার মতো করে ইটভাটা দিয়ে অদৃশ্য শক্তির বলে পার পেয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। কোনো কোনো ভাটা মালিক আদালতের আদেশ বলে, কেউবা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই, কারো বা কোনো কাগজপত্রই নেই, নেই রেজিস্ট্রেশন। তবুও বহাল তবিয়তে চলছে ইটভাটা। রাতের আঁধারে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ, বাঁশের মুড়া, ভাঙা বোতাম, স’মিল থেকে আনা কাঠের গুঁড়া, পুরনো টায়ার-টিউব, ইউরিয়া সার, সয়াবিন তেলের বর্জ্যসহ নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হচ্ছে ভাটার জ্বালানি কাজে। নিয়মনীতি উপেক্ষা করে অপরিকল্পিতভাবে জেলার যত্রতত্র গড়ে ওঠা ইটভাটিগুলো চোখের পলকে গিলে খাচ্ছে সোনাফলা আবাদি জমি। জমির টপ-সয়েল কেটে ইটভাটাটিতে ব্যবহার করায় উর্বরতা হারিয়ে উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে হাজার হাজার একর জমির। এখানে ওখানে অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছে না। ইটভাটা মালিকদের হাত এতটাই লম্বা যে, তাদের নাগাল পাওয়া যেন দুঃসাধ্য। এ ছাড়া প্রতিদিন শ’ শ’ অবৈধ ট্রলি ও ট্রাক্টরে অতিরিক্ত ইট ও মাটি পরিবহনের ফলে ভেঙে চৌচির হচ্ছে এলাকার কাঁচা-পাকা রাস্তাঘাট। কিন্তু দেখার বা বলার যেন কেউ নেই। কুণ্ডলী পাকানো কার্বন-ডাই-অক্সাইড মিশ্রিত কালো ধোঁয়া পরিবেশের মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইটভাটার ঝাঁঝালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম জনপদ। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ। বিনষ্ট হচ্ছে জমির ফসল। ধানে পড়েছে চিটা। কলাগাছ, জলপাই গাছসহ এলাকার সবুজ গাছগুলো পাতা পুড়ে যাচ্ছে বিষাক্ত ছাইয়ের কবলে পড়ে। ভাটার আশেপাশে বসবাসকারী পরিবারগুলোর অবস্থা আরো করুণ। নিয়মকানুনের  তোয়াক্কা না করে উর্বর ও ৩ ফসলি জমির ওপর গড়ে উঠেছে ইটভাটা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোটা জেলায় ৫৫টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যক ভাটা রয়েছে সৈয়দপুর উপজেলায় ৩২টি। নীলফামারী জেলা সদরে রয়েছে ১১টি। ডোমার উপজেলায় ৪টি, জলঢাকা উপজেলায় ৭টি এবং কিশোরীগঞ্জ উপজেলায় ৩টি। যার বেশির ভাগই অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত হওয়ায় এলাকার পরিবেশ, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি ও ফসল বিনষ্ট হওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। নীলফামারী সদর উপজেলার গোড়গ্রাম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেয়াজুল ইসলাম জানান, তার ইউনিয়নে ৬টি ভাটা রয়েছে। ভাটার কারণে এলাকার পরিবেশই শুধু নয় নীলফামারী- দেবীগঞ্জ সড়কের বেহাল দশা। গোটা সড়ক ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। এ ছাড়া পিকনিক স্পট নীলসাগরের কাছে মেসার্স এমএসবি ব্রিকসসহ আধা কিলোমিটারের মধ্যে এমকে ব্রিকস ও আরএমবি ব্রিকস নামে আরো ২টি, গোড়গ্রাম স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও গোড়গ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে বিওবি ব্রিকস নামের একটি। এ ছাড়া আধা কিলোমিটারেরও কম দূরত্বে উত্তর মাছপাড়া গ্রামে টিএবি ব্রিকস-১ ও হাজীগঞ্জ বাজারের কাছে টিএবি নামে আরো একটি ভাটা রয়েছে (যদিও সরকারি তালিকায় এটির নাম নেই)। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভাটাগুলো থেকে প্রতিদিন গড়ে ৭০ থেকে ৮০টি ট্রলি ও ট্রাক্টরে করে ইট ও মাটি পরিবহনের কারণে গোটা ইউনিয়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে। বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হওয়ায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও পড়েছে চরম বিপাকে। এদিকে গোড়গ্রাম ইউনিয়নের এমকেবি ব্রিকস ও আরএমবি ব্রিকস ইটভাটার বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণ জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করে এ থেকে পরিত্রাণ চেয়েছেন। স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সশ্লিষ্টদের মাসোহারা দিয়ে নাকের ডগায় ইটভাটাগুলো অনিয়মের রামরাজত্ব কায়েম করেছে। অভিযোগ রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের একাধিক প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় বরাবরই পার পেয়ে যাচ্ছে ইটভাটাগুলো। অতি সমপ্রতি টিএবি, আরএমবি ব্রিকস ও বিওবি ব্রিকস নামের ৩টি ভাটায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিওবি ব্রিকস ভাটা মালিক দেয়াল দিয়ে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দেয়ায় আসছে বর্ষায় শত শত বিঘা জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ভূমি মালিকরা। এদিকে জেলা প্রশাসককে অভিযোগ করায় এলাকাবাসীকে পুলিশ দিয়ে হুমকি দেয়ার অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। অথচ এত কিছুর পরও হাত গুটিয়ে বসে আছে সংশ্লিষ্টরা। ওদিকে  সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের কৃষক এলাহী বকস, আবুল হোসেন, রফিকুল ইসলাম ও  তোফাজ্জল হোসেনসহ অনেকেই স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ করে জানান, কামারপুকুরের ইটভাটাগুলো গড়ে ওঠেছে উর্বর আবাদি দো-ফসলি ও তিন-ফসলা জমিতে। ইট তৈরির জন্য ভাটা মালিকরা নামমাত্র টাকা দিয়ে দুই/ তিন ফিট গভীর করে মূলতঃ জমির টপ-সয়েল কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। কৃষকরা অভিযোগ করেন কিছু কৃষক ইটভাটায় জমি দেয়ার কারণে জমিগুলো ডোবায় পরিণত হয়েছে। এর ফলে পাশের উর্বর জমিগুলো ভেঙে পড়ছে ওই  ডোবায়। ফলে বাধ্য হচ্ছেন অন্য কৃষকরা ইটভাটায় জমি দিতে। অনেকে মনে করেন, এটা একটা ইটভাটা মালিকদের কৌশল।

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status