এক্সক্লুসিভ

সমুদ্র পরিবহন খাতে দুর্দিন, ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে শিপিং কোমপানিগুলো

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

১০ মে ২০১৯, শুক্রবার, ৮:৫৬ পূর্বাহ্ন

আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন খাতে দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অন্য দেশগুলো যখন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে তখন ক্রমশ কমছে জাহাজের সংখ্যা। ফলে কমে যাচ্ছে কর্মসংস্থান। সরকারি ও বেসরকারি মেরিন একাডেমি এবং ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে বেকার বসে আছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী।
বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের শিপিং মাস্টার জাকির হোসেন জানান, ২০১৪ সালে সর্বশেষ সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন জাতীয় পতাকাবাহী জাহাজ ছিল ৬৩টি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে জাহাজের সংখ্যা কমে এখন ৪১টি। এর মধ্যে সমপ্রতি বিএসসির (বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন) বহরে নতুন জাহাজ যুক্ত হয়েছে ছয়টি।

তিনি জানান, দেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিপিং কোমপানি ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছে। এইচআরসি শিপিং ১০টি জাহাজ পরিচালনা করলেও এখন তাদের একটি জাহাজও নেই। সিএলএ কন্টেইনার লাইনারের ১০টি জাহাজের মধ্যে টিকে আছে ২টি। সিলভিয়া শিপিং-এর ১০টি জাহাজের মধ্যে একটিও নেই। এ ছাড়া রতনপুর স্টিল, ট্রান্স ওশান ক্রিস্টাল শিপিং সহ অনেক নামিদামি প্রতিষ্ঠান জাহাজ পুরাতন হওয়ায় তা স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছে। পরে তারা আর নতুন কোনো জাহাজ ক্রয় করেনি।

জাকির হোসেন চৌধুরী জানান, এসআর শিপিং, বসুন্ধরা গ্রুপ, ক্রাউন সিমেন্ট, আকিজ গ্রুপ, ভ্যানগার্ড শিপিং, মেঘনা শিপিংসহ বিভিন্ন শিপিং কোমপানির বেসরকারি পর্যায়ে জাতীয় পতাকাবাহী ৩৪টি জাহাজ আন্তর্জাতিক সমুদ্র পরিবহন ব্যবসায় নিয়োজিত রয়েছে।

তিনি বলেন, একটি জাহাজ সমুদ্রে চালু অবস্থায় দৈনিক খরচ পড়ে প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার ডলার। যেসব প্রতিষ্ঠান জাহাজ কিনেছে, তাদের অনেকের এ খাতে ব্যবসার তেমন অভিজ্ঞতা ছিল না। আর যেসব লোকবল নিয়োগ দেয়া হয় তারাও তেমন দক্ষ নয়। তাছাড়া কার্গো জাহাজ না পাওয়া, পর্যাপ্ত ভাড়া না পাওয়া, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, দুর্নীতিসহ নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে এই খাত। ক্রমাগত লোকসান দিতে দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে বেশির ভাগ শিপিং কোমপানিই।

বাংলাদেশ সি-ফ্যারার্স ইউনিয়নের সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন বলেন, ১৯৭৮-৭৯ সালে বাংলাদেশের নাবিকের সংখ্যা ছিল ১২ হাজার। এর মধ্যে সার্বক্ষণিক জাহাজে কর্মরত অবস্থায় থাকতো সাত হাজার ৫০০। বর্তমানে নাবিকের সংখ্যা তিন হাজার ৭০০। এর মধ্যে জাহাজে কর্মরত অবস্থায় আছে মাত্র এক হাজার ৩৫০ জন।

সূত্র জানায়, জাহাজের সংখ্যা কমার কারণে কর্মসংস্থানে ধস নামার পাশাপাশি নাবিক রিক্রুটিং এজেন্ট এবং নাবিকদের নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই সেক্টরে কাজের সুযোগ কমে গেছে। অনেক ম্যানিং এজেন্ট (নাবিক রিক্রুটিং এজেন্ট) নাবিক নিয়োগের মাধ্যমে মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত ছিল। এর পাশাপাশি অদক্ষ লোকদের ক্যাপ্টেনসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ার কারণে তাদের হাতে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে অনেক জাহাজ। অনেক নাবিক বিদেশি পতাকাবাহী জাহাজে কাজ করতে গিয়ে জড়িত হয়েছে নানা অনৈতিক কাজে। জাহাজ থেকে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে অসংখ্য। এসব কারণে বিদেশি জাহাজগুলো এখন আর বাংলাদেশের নাবিকদের নিয়োগ করতে চায় না।

জাহাজে কর্মসংস্থান না থাকায় বিপাকে পড়েছে বিভিন্ন মেরিন প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাহাজের ইঞ্জিনিয়ারিং শাখায় ক্রু পদে যোগ দিতে যাওয়া এক যুবক বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ২০১৩ সালে ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অপেক্ষায় আছি জাহাজে যোগ দেয়ার জন্য। অনেক চেষ্টা তদবিরের পর ২০১৭ সালে রোস্টারভুক্ত হয়েছি। এখন কাজে যোগ দেয়ার জন্য ধরনা দিচ্ছি সরকারি শিপিং অফিসে।

নৌ পরিবহন অধিদপ্তরে সাইন অন এবং সাইন অফ করতে আসা জাহাজের বিভিন্ন পদে চাকরিরত তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একবার জাহাজ থেকে নামার পর দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হয় তাদের। এ সময় কাজ না পেয়ে তাদের চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ক্ষোভের সঙ্গে তারা জানান, দিন দিন জাহাজে কাজের পরিধি কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সমুদ্র পরিবহন সেক্টরে চরম বিপর্যয়ের শংকা দেখছেন তারা।

নাবিক রিক্রুটিং এজেন্ট হক অ্যান্ড সন্স লিমিটেডের ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, নাবিক রিক্রুটের সংখ্যা আগের তুলনায় কমে গেছে। এর কারণ হচ্ছে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়া। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান শিপিং সেক্টর থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। শিপিং সেক্টরের উন্নতির স্বার্থে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেও এগিয়ে আসতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের সচিব খালেদ মাহমুদ বলেন, জাহাজের সংখ্যা কমে যাওয়ায় নাবিকদের কাজের ক্ষেত্রও কমে যায়। বিএসসিতে ইতিমধ্যে ছয়টি জাহাজ যুক্ত হয়েছে। নতুন জাহাজ যুক্ত হওয়ায় নতুন করে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status