এক্সক্লুসিভ

সিলেটে আবু সিনা ছাত্রাবাসের স্থলে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে বিভক্তি

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে

২৫ এপ্রিল ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:০৩ পূর্বাহ্ন

সিলেটে আবু সিনা ছাত্রাবাসের স্থলে হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিতর্ক’। নাগরিক সমাজের মধ্যে এ নিয়ে দেখা দিয়েছে দ্বিধা-বিভক্তিও। কেউ চাচ্ছেন হাসপাতাল। আবার কেউ চাচ্ছেন শতবর্ষী এ স্থাপনা সংরক্ষণ করে জাদুঘর নির্মাণ করতে। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে উত্তাপ ছড়াচ্ছে সিলেটে। আবু সিনা ছাত্রাবাসের শতবর্ষী স্থাপনা ভেঙে ফেলতে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছিল সেটি এখন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে। ওদিকে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ঐতিহ্যের স্মারক রক্ষা করে হাসপাতাল নির্মাণের কথা জানিয়েছেন। সিলেটের আবু সিনা ছাত্রাবাস হচ্ছে চৌহাট্টা থেকে রিকাবীবাজার সড়কের বামপাশে। এটি সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রাবাস হিসেবে পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতিও জড়িত এ ভবনের সঙ্গে। এ ভবনের প্রাঙ্গণেই চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। একটি অংশ এরই মধ্যে ভেঙে ফেলা হয়েছে। সম্পূর্ণ ভবন ভেঙে ২৫০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

গত বছরের জানুয়ারিতে এই হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যদিও এই ভবনের গা ঘেঁষেই রয়েছে ১০০ শয্যার শহীদ ডা. শামসুদ্দিন সদর হাসপাতাল নামে আরেকটি সরকারি হাসপাতাল। পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী ভবনটি ভাঙার খবরে নগরবাসীর মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও ক্ষুব্ধ। কারণ দেড় শতাধিক বছরের পুরনো একটি ভবন ভাঙা হচ্ছে অথচ তাদের কিছুই জানায়নি গণপূর্ত বিভাগ। তবে প্রত্নতত্ত্বের তালিকায় নেই এই ছাত্রাবাস। সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেন এমন কয়েকজন জানিয়েছেন, প্রাচীন জনপদ সিলেটে বর্তমানে পুরনো ভবন নেই বললেই চলে। ১৮৬৯ ও ১৮৯৭ সালে দুটি প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে সিলেটের প্রায় সব পাকা স্থাপনাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। শুধু টিকে যায় ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’। তাই ঐতিহাসিক একমাত্র স্থাপনা হিসেবে এটিকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন তারা। ইতিহাস ঘেটে জানা গেছে- সিলেটের প্রথম সংবাদপত্র ‘শ্রীহট্ট প্রকাশ’-এর প্রেস ছিল এই ভবনে। শ্রীহট্ট প্রকাশ প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নথি ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৩৬ সালে এই বাড়িতে স্থাপিত হয় সিলেট সিভিল হাসপাতাল। ১৯৪৮ সালে হাসপাতাল স্থানাস্তরের পর ভবনটিতে সিলেট মেডিকেল স্কুলের যাত্রা হয়। যা ১৯৬২ সালে মেডিকেল কলেজে উন্নীত হয়।

১৯৭১-৭২ সালে এই মেডিকেল কলেজ বর্তমান স্থান নগরীর কাজলশাহতে স্থানান্তরিত হয়। আর ভবনটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যার ‘আবু সিনা ছাত্রাবাস’ নামকরণ করা হয়। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সিলেটে জেলা হাসপাতাল নির্মানের উদ্যোগ নেন। এর ফলে আবু সিনা ছাত্রাবাসের স্থলে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর সম্প্রতি এর কাজ শুরু হয়। আর কাজ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সিলেটে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পুরনো স্থাপনা হিসেবে আবু সিনা ছাত্রাবাসকে সংরক্ষণে দাবি তোলা হয়। সিলেটের শত নাগরিকদের পক্ষ থেকে এই আপত্তি তোলার পর আবু সিনা ছাত্রাবাসস্থল পরিদর্শন করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও। এদিকে- পুরাতন স্থাপনাকে ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণের দাবি জানানোর পর সিলেটে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে অনেকেই অবস্থান নেন। এমনকি হাসপাতাল নির্মাণের দাবি জানিয়ে সিলেটে একাধিক মানববন্ধন করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে আয়োজিত এ মানববন্ধন থেকে দ্রুত হাসপাতাল নির্মাণের দাবি করা হয়। সিলেট গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, আবু সিনা ছাত্রাবাস ভেঙ্গে ফেলতে দাপ্তরিক কাজ ইতিমধ্যে শেষ করা হয়েছে। নিলাম সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন ভেঙে ফেলার চূড়ান্ত অনুমতি দিতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেলেই নিলামদাতা আবু সিনা ছাত্রাবাস  ভেঙে ফেলার কাজ শুরু করবেন। অনুমতি এখনো না আসার কারণে নির্মাণ কাজ ধীর গতিতে চলছে। এই অবস্থায় ঐতিহ্যবাহী আবুসিনা ছাত্রাবাস ভবন সংরক্ষণ ও সংস্কারের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে ‘সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজ’। কয়েক দিন আগে তারা জেলা প্রশাসকের

 মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর এই স্মারকলিপি প্রেরণ করেন। জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম স্মারকলিপিটি গ্রহণ করেন। ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ ও অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে স্মারকলিপিতে বলা হয়- সিলেট নগরীর কেন্দ্রস্থলে ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের দক্ষিণপ্রান্তে দেড়শত বছর প্রাচীন স্থাপত্য প্রধানমন্ত্রীর  দোহাই দিয়ে ভেঙে ফেলতে চাইছে একটি স্বার্থান্বেষী মহল। ভবনটির স্থাপত্যমূল্য ও ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হলে, তা সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য প্রধানমন্ত্রী অনতিবিলম্বে নির্দেশ প্রদান করবেন । ‘সিলেটের ঐতিহ্য রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ নাগরিক সমাজের মুখপাত্র প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রাহক ডা.  মোস্তফা শাহজামান চৌধুরী বাহার স্বাক্ষরিত এই স্মারকলিপিতে এই ভবন বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের করা গবেষণাপত্র ও ভবন সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংযুক্ত করে দেয়া হয়। স্মারকলিপি প্রদানকালে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ বেদানন্দ ভট্টাচার্য, সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ই ইউ এমাদুল্লাহ শহীদুল ইসলাম, সাম্যবাদী দলের সভাপতি ধীরেন সিংহ, জাসদ যুগ্ম সম্পাদক জাকির আহমদ, নাগরিক মৈত্রীর সমন্বয়ক সমর বিজয় সী শেখর, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম, সেভ দ্য হেরিটেজ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট, প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হাই আল হাদী, চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সিলেট-এর সংগঠক রুবাইয়াৎ আহমেদ প্রমুখ। এদিকে- সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা জায়গায় জেলা হাসপাতালের নির্মাণ কাজ অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করে পূর্ণোদ্যমে শুরু করার দাবি জানিয়েছেন। কয়েক দিন আগে সিলেট উন্নয়ন ও ঐতিহ্যের স্মারক সংরক্ষণ পরিষদের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে জেলা হাসপাতালের নির্ধারিত জায়গা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে সবার পক্ষ থেকে তিনি এ দাবি জানান। আশফাক আহমদ ওই জায়গায় অবস্থিত আবুসিনা ছাত্রাবাস নামে পরিচিত সিলেট  মেডিকেল স্কুলের স্মারক কিভাবে সংরক্ষণ করা যায় সেবিষয়টি বিশেষজ্ঞ কমিটির মাধ্যমে চূড়ান্ত করার দাবিও জানান।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status