এক্সক্লুসিভ

ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা

পিয়াস সরকার

২৪ এপ্রিল ২০১৯, বুধবার, ৮:৪১ পূর্বাহ্ন

দীর্ঘ ছয় বছর ধরে বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন তীব্র যন্ত্রণা। প্রতিটা মুহূর্ত কাটে এক অজানা আতঙ্কে। চোখের পাতা এক হলেই যেন ধেয়ে আসে মরণ যন্ত্রণা। চোখের সামনে ভেসে আসে দুঃসহ সেই স্মৃতি। নিলুফা বেগমের জীবনটাই যেন এক নরক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একাই বললেন তিনি। বলেন, ভোররাতে ঘুম আসলেও খানিক বাদেই তা ভেঙ্গে যায়। পায়ে অসহ্য ব্যথা বয়ে বেরাচ্ছেন ৬ বছর ধরে। সাভারের রানা প্লাজা তার জীবনকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, জীবন্মৃত হয়ে বেঁছে আছেন তিনি। তাইতো তিনি বলেন, এভাবে বেঁছে থেকে কি লাভ? তার চেয়ে দেয়াল চাপায় মারা গেলে এ যন্ত্রণা সইতে হতোনা।

নিলুফা চাকরি করতেন রানা প্লাজায়। ভবনের অষ্টম তলায় প্যান্টন অ্যাপারলেস কারখানায়। ছিলেন সুইং অপারেটর। ২০১৩ সালের ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় তার পায়ের উপর পড়েছিলো বিম। আটকা পড়েছিলেন প্রায় ৯ ঘণ্টা। সেই বিমের আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয় তার ডান পা। এরপর থেকে বিছানাই তার সঙ্গি। নিলুফার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। স্বামীর নাম শাহিদুল ইসলাম। পেশায় চা দোকানদার। তারা থাকেন সাভারের আমতলা বস্তিতে। তিন সন্তানের জননি তিনি। বড় ছেলে পড়েন নবম শ্রেণিতে। মোজো মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে। আর ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। এই দুই মেয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন মায়ের।

সকাল ৮টায় দুই মেয়ে সকালের রান্না সেরে চলে যায় স্কুলে। আর তাদের বাবা সকাল ১০টায় বেরিয়ে যান দোকানের উদ্দেশ্যে। তিন ছেলে মেয়ে ও স্বামী বাইরে চলে যাবার পর একাই অবস্থান করেন বাড়িতে। দুপুর নাগাদ ছেলে মেয়েরা ফেরে বাড়িতে। বাড়িতে এসে দুই মেয়েকেই করতে হয় বাড়ির কাজ। দুপুরের রান্না। দুপুরে বাবা খেতে আসেন। এরপর ছেলেকে নিয়ে যান দোকানে কাজে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে।

পায়ে ব্যাথা নিয়েই কেটে যাচ্ছিল নিলুফার জীবন। তবে ইদানিং ঘটছে নতুন বিপত্তি। পায়ে নতুন করে ধরেছে পচন। ডাক্তার দেখিয়েছেন। বলেছেন অস্ত্রোপচার করে পা কেটে ফেলতে। তবে পারছেন না টাকার অভাবে।

রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা পেয়েছিলেন ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এই টাকার অধিকাংশ চলে যায় তার চিকিৎসার পিছনে। এই টাকা থেকে তার স্বামী দিয়েছেন একটি চায়ের দোকান। সেখানে খরচ হয়ে যায় প্রায় ৮০ হাজার টাকা। এখন প্রতিদিন ৩শ’ থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকার ওষুধ প্রয়োজন হয়। যা মাস শেষে দাঁড়ায় প্রায় ১০ হাজার টাকায়। এই টাকার যোগান দেবার পর পরিবার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবারটির।
ইয়াসমিন সুলতানা। বাড়ি রংপুর পীরগঞ্জ উপজেলার দোহাটা গ্রামে। কয়েকটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে শেষে যোগ দেন রানা প্লাজার একটি পোশাক কারখানায়। ধীরে ধীরে মিলছিলো তার অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তুতার জীবনে নেমে আসে অশুভ ছায়া। পড়ে যান রানা প্লাজা ধ্বসের মাঝে। হাতে ও পায়ে আঘাত পান। চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছিলো প্রায় প্রায় বছর খানেক।

এরপর থেকেই ভাইয়ের বাসায়। সেখানে অসহায় হয়ে পড়ে আছেন। সহযোগিতা পেয়েছেন প্রায় লাখ দুয়েক টাকার মতো। তা পুরোটাই ব্যয় হয় চিকিৎসার পেছনে। এখন চলাফেরা সীমিত তার। তারপর করেন হাতের কাজ। এই দিয়ে ভাইয়ের সংসারে যদি একটু হেল্প করা যায়?

রানা প্লাজায় নির্মম দুর্ঘটনায় বাম হাত হারিয়েছেন লাবনি খানম। তিনি এখন থাকেন খুলনায় দৌলতপুরে। রানা প্লাজার পাঁচ তলায় ফ্যান্টম গার্মেন্টের চিকিৎসা কেন্দ্রের নার্স ছিলেন তিনি। সেদিনের দুর্ঘটনার কথা মানুষকে বলতে বলতে কিছুটা বিরক্ত। তারপরেও বলেন, দুর্ঘটনার আগের দিন ২৩শে এপ্রিল রানা প্লাজায় ফাটল ধরেছিলো। আমরা কাজে যাবো কি যাবো না এই নিয়ে দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম। রান্না প্লাজায় গেলেও আমরা সেদিন অফিসে যাই নাই। কিন্তু পরদিন বেতন যাতে না কাটে সেই ভয়ে ছিলেন তারা। এরপর পরদিন সকালে অফিসে প্রবেশের ১০ মিনিটের মাথায় ধ্বসে পড়ে ভবনটি। তার হাতের উপর ছিলো একটি বিম। হাত কেটেই তাকে বের করা হয় সেখান থেকে। এখন তিনি ঢাকা ছেড়ে এলাকাতে থাকেন।

নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জের নীলুয়া পাড়া গ্রামে থাকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া শিশু সবুজ। মাকে হারিয়ে দাদা বাড়িতে হয়েছে আশ্রয়। তার মা কাজ করতেন রানা প্লাজায় আর বাবা চালাতেন রিকশা। সেদিনের ঘটনায় মাকে হারিয়ে ফেলে সবুজ ইসলাম।  তার মায়ের স্মৃতি বলতে শুধুই এক টুকরা ছবি। যে ছবিতেও দাগ পড়েছে। ভালো করে বোঝা যায় না মুখটা। তখন তারা থাকতেন সাভারে। বাবা-মায়ের আদরের একমাত্র সন্তান সবুজ। মারা যাবার আগের দিন তাকে ভাত খাইয়ে গিয়েছিলো মা। ঘটনার পর থেকে তার মা নিখোঁজ। দেখতে পারেননি মায়ের লাশটাও।
এভাবেই দুঃখের সাগরে বাবার সঙ্গে মায়ের লাশ খুজতে কেটে যায় মাস ছয়েক। এরপর ফের বিয়ে করেন বাবা। আর সবুজকে রাখা হয় তার দাদা বাড়িতে। দাদা বাড়িতে বাবা মা ছাড়া সবুজের দিন কাটে বিষণ্নতায়। সবুজ মাঝে মধ্যেই রাতের বেলা আম্মা আম্মা বলে চিৎকার করে উঠে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status