দেশ বিদেশ

ভেঙে পড়ছে সমাজ শৃঙ্খল

তৌহিদুল হক

২৩ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ৯:২২ পূর্বাহ্ন

অপরাধ কিংবা সমাজ নিয়মবহির্ভূত আচরণ যেকোনো সমাজে হতেই পারে। বা এমনটাও বলা যায়, অপরাধপ্রবণতা মানুষের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যও বটে। আধুনিক অপরাধ তত্ত্বগুলোতে এ কথন উল্লেখ্য যে, একটি সমাজের মানবিক বৈশিষ্ট্য বিচার করতে হবে কোন ধরনের অপরাধ হচ্ছে তা দিয়ে নয়। বরং কীভাবে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তা দিয়ে। অর্থাৎ অপরাধের প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলোর মধ্যেই সমাজের কার্যাদির পুরোচিত্রটি খুঁজে পাওয়া যাবে।

চলতি সময়ে বাংলাদেশে ধর্ষণ, হত্যা ও অপহরণ বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনা বাংলাদেশে সামাজিক অপরাধের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে। ফেনীর নুসরাত জাহান রাফি’র ঘটনা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদরাসা কিংবা স্কুলের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ এবং ছাত্র অপহরণ ও হত্যার ঘটনা এদেশে যে একেবারে নতুন তা নয় তবে সংখ্যা বেড়েছে, একই সঙ্গে অপরাধের প্রক্রিয়ায় নতুন কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে।

তবে অপরাধগুলো সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেভাবে পরিকল্পনার ছক আঁকা হয়েছে তা থেকে উপলব্ধি করা যায় বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যাদি কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে। রাফি ফেনীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিশেষ করে প্রশাসন, পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ অনেকেই সহযোগিতা চেয়েছে কিন্তু পেয়েছে বিপরীত চিত্র। বরং পাল্টা দোষারোপ করা হয়েছে রাফি ও তার পরিবারকে।  যেখানে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি জনপ্রতিনিধি হিসেবে মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে সেখানে পাশে দাঁড়িয়েছে তবে বন্ধু হিসেবে নয়। বরং নির্যাতনকারী ও অপরাধের বন্ধু হিসেবে। স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা বাংলাদেশের সমাজ প্রক্রিয়ায় মানুষকে নতুন করে আঘাত হেনেছে।

রাফি’র ঘটনাটি একদিনে ঘটেনি। ঘটনা বিশ্লেষণে ও তদন্তে যে বিষয়টি স্পষ্ট হলো- অনেক দিন ধরে ঘটনার সূত্রপাত এবং এরই পরম্পরায় এলাকার লোকজনেরও জানার কথা। জেনেছে সবাই কিংবা কিয়দংশ, ব্যবস্থা নেয়নি। সমাজের অসুস্থ অপরাধপ্রবণ ব্যক্তির আচরণ নিয়ন্ত্রণে যাদের কাজ করার কথা তারা নির্বিকার ছিল, ছিল অপরাধীর পাশে।
সাংস্কৃতিক সামাজিকীকরণের মাধ্যমে একটি সমাজের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সুস্থতা এবং সামঞ্জস্য স্থাপনের ক্ষমতা একই সঙ্গে সাবলীলতা তৈরি হয়। অর্থাৎ সমাজ তাকে যেভাবে বেড়ে ওঠার ইঙ্গিত দেয় সেই ভাবে বেড়ে ওঠে। যাতে সমাজে বেড়ে ওঠার সময় তৈরি হওয়া অসংগতি মোকাবিলায় ভূমিকা পালনে সামর্থ্য হয়। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের সাংস্কৃতিক আদল বজায় রেখেই নাগরিকদের বেড়ে ওঠার সুযোগ ও ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে হবে।  ভিকটিম নারীদের সহযোগিতার জন্য সমাজে নাগরিক উদ্যোগ অপরিহার্য। কিন্তু আমাদের দেশে নাগরিক উদ্যোগও রাজনৈতিক কারণে বিভাজিত। নাগরিক অর্থাৎ যাদের ওপর রাজনৈতিক দলের ভরসা রয়েছে কিন্তু নাগরিক সমাজের ভরসা নেই। যে কারণে, বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে কিংবা পরিচালিত কর্মসূচিতে অপরাধীর বিচার সাময়িক তৃপ্তির সুযোগ তৈরি করে, দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বয়ে আনে না।

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ মানুষ তাদের ওপর আস্থা ও ভরসা রাখতে পারছে না। এই না পারার মূল কারণ স্থানীয় আভিজাত্য, দাম্ভিকতা, রাজনৈতিক প্রভাবের বড়াই, অন্যায় করে পুনরায় নির্বাচিত ও নেতা থাকার দৃষ্টান্ত। একটি কথা খুব জোর দিয়ে বলতে চাই, যে সমাজে অপরাধীর পুনঃসম্পর্ক স্থাপনে বাধা পেতে হয় না, বাধা পেতে হয় ভিকটিমের; সেই সমাজের কার্যক্ষমতা ও মনুষ্য যোগ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এরই আলামত বাংলাদেশের সমাজে বর্তমানে লক্ষণীয়।  যদিও ক্ষেত্রবিশেষে দু’একটি ঘটনার বিচারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের উজাড় করে দিতে চায়। কিন্তু এই কার্যাবলীর উদারতা বেশি দূর গড়ায় না। কারণ মানুষ মনে করে এই উদ্যোগ লোকদেখানো ও সাময়িক উত্তেজনায় ভরপুর। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সাধারণ মানুষের এই ধরনের বিশ্বাস দীর্ঘস্থায়ী অনীহা তৈরি করছে। যে কারণে সমাজে একাকিত্বসহ মানবিক দূরত্ব সর্বোপরি স্বার্থপরতার নোনাজল সর্বস্তরে ব্যাপৃত। এর ফলে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের ক্ষণে ক্ষণে মৃত্যু হয়।

আমাদের দেশে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার কিংবা পুনর্বাসনের জন্য নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলো ভিকটিমের চাহিদানুযায়ী সেবার ক্ষেত্র উন্মোচন করতে পারছে না। এই না পারার  পেছনে মূল কারণ হলো- রাষ্ট্রকে খুশি করার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে। বরং কাজ করতে হবে ভিকটিমের ক্ষতের মেজাজ ও অবস্থানুযায়ী। এর উল্টো হলে যে ধরনের বিপত্তি দেখা দেয়, বর্তমান বাংলাদেশে সেটাই হচ্ছে।  দ্রুত ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে সামাজিক অপরাধগুলোর বিচার দ্রুত সময়ের মধ্যে নিশ্চিতকরণসহ সামাজিক সম্পর্কগুলো আরো সাবলীল ও প্রাণবন্ত করার জন্য সরকারের উচিত হবে সামাজিক ক্ষেত্রগুলোতে বিনিয়োগ করা। এই বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি যেদিকেই যাক না কেন, বাংলাদেশের মানুষ সমাজ জীবনে শৃঙ্খলার আবর্তে নিজ জীবনকে প্রকাশ করার অফুরান সুযোগ পাবে।
লেখক: অপরাধ ও সমাজ গবেষক এবং সহকারী অধ্যাপক
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status