বিশ্বজমিন

বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, বাড়ছে হুমকি

এএনএম মুনিরুজ্জামান

২২ এপ্রিল ২০১৯, সোমবার, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ন

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা হুমকি- বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তার ওপর যেসব ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, তা নিয়ে বিশ্বের প্রায় সব দেশই এখন একমত। বাংলাদেশও এখানে ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতপক্ষে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যেসব দেশ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির সম্মুখীন, বাংলাদেশ সেগুলোর মধ্যে একটি।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি জলবায়ু থেকে উদ্ভব হলেও এটি মনুষ্যসৃষ্ট। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধি ও ব্যাপকহারে নগরায়ন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে বিপজ্জনক মাত্রায় বৃদ্ধি করেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে পানির তাপ বিস্তার হলো এর অন্যতম প্রধান কারণ। অপরটি হলো গ্লেসিয়ার ও বরফপৃষ্ঠ ব্যাপকহারে গলে যাওয়া। বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১১-৩৮ ইঞ্চি বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকাকে বড় ধরণের ভাঙ্গন দেখা দিলে, এই উচ্চতা ২৩ ফুট বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে একেবারে মহাপ্রলয়ের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে।


এক্ষেত্রে বিশ্বের নি¤œভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বড় একটি অংশ সাগরে মিইয়ে যাবে। ফলে প্রচুর মানুষ স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্যকল্পে মালদ্বীপ ও পাপুয়া নিউগিনির মতো দ্বীপরাষ্ট্র স্রেফ হারিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা সবচেয়ে বেশি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার শিকার হবে। উপকূলীয় অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবচেয়ে বেশি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি মেগাসিটির ৮টি ও বহু আর্থিক প্রাণকেন্দ্র (যেমন: নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও মুম্বই) এমন সব উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত যেগুলো হয়তো আংশিক বা পুরোপুরি ডুবে যাবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা ভয়ঙ্কর ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। রটরড্যাম ও সাংহাই-এর মতো বন্দরনগরী আক্রান্ত হলে বিশ্বের সরবরাহ ব্যবস্থাও হুমকিতে পড়বে।

বিশ্বের ছোট ছোট উন্নয়নশীল দ্বীপরাষ্ট্রসমূহ অস্তিত্বের সংকটে পড়বে। জলাভূমি হারিয়ে যাওয়ায় অনেক দেশের ভূখ-ের আকার ছোট হয়ে যাবে। ডুবে যাওয়ার আগে এসব দেশের অস্তিত্ব এমনিতেই হুমকিতে পড়বে, কেননা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে গেলে কোনো দ্বীপ ডুবে যাওয়ার আগেই সেটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সমুদ্রসীমা নিয়ে দেশে দেশে বিরোধ দেখা দেবে। বর্তমান বেইজলাইন ও শোরলাইনে প্রায় নিশ্চিতভাবেই পরিবর্তন আসবে। এসব ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তনেই জাতিসংঘের কনভেনশন্স অন দ্য ল’ অব দ্য সি (ইউএনসিএলওএস) প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ থেকে বিভ্রান্তি তৈরি হবে, ফলে সমুদ্রসীমা ও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে প্রবেশাধিকার নিয়ে বিরোধ দেখা দেবে। এতে আন্তঃদেশীয় সম্পর্ক বিনষ্ট হবে। শান্তি নিশ্চিত করা আরও দুরূহ হয়ে পড়বে।
মানুষ বসবাস করছে এমন অঞ্চলে সমুদ্র হানা দিলে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪০-৫০ শতাংশই উপকূলে বসবাস করে। ফলে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার হার হবে ব্যাপক। দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তঃদেশীয় অভিবাসন ঘটবে বিশাল আকারে। যেটি নিশ্চিতভাবেই জনসংখ্যার ভারসাম্য বিনষ্ট করবে। সম্পদের অভাব ঘটবে, যার ফলে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও অভিবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেবে। সবচেয়ে ভয়াবহ দৃশ্যকল্পে রাষ্ট্রের কাঠামোই ধসে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যেসব দেশ ইতিমধ্যেই বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যা অতিক্রম করছে, সেসব দেশ এই অভিবাসনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মানুষের জীবিকা আক্রান্ত হবে। বিভিন্ন ধরণের শস্য আর উৎপাদন করা যাবে না। কিংবা লবণাক্ত পানির কারণে শস্যের গুনগত মান হ্রাস পাবে। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পানির গভীরতা পরিবর্তন ও পানির রসায়নে পরিবর্তনের কারণে শ’ শ’ জাতের মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একইভাবে বিলুপ্ত হবে বহু সামুদ্রিক প্রজাতি, কেননা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে তাদের মেটাবলিজম, কার্যক্ষমতা, বাস্তুসংস্থান ও বৃদ্ধির হার প্রভাবিত হবে।

বহু কৃষিজমি হারিয়ে যাওয়ায় খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। লবনাক্ত পানির কারণে অবশিষ্ট কৃষিজমির মান হ্রাস পাবে। ফসলের প্রত্যাশিত উৎপাদন কমে যাবে। মেকং ও লোহিত সাগরের বদ্বীপ অঞ্চল ডুবে যাওয়ায় চালের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মানুষের মধ্যে এই খাদ্য অনিরাপত্তা দেশের অভ্যন্তরে ও সীমান্তের বাইরে এক অস্থিতিশীল নিরাপত্তা পরিস্থিতির জন্ম দেবে। একইভাবে বিনষ্ট হবে নৌ নিরাপত্তা। সুপেয় পানি দূষিত হবে লবনাক্ত পানির আগ্রাসনে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জ্বালানি অবকাঠামো বিশেষভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন। পারমাণবিক চুল্লিতে সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহের প্রয়োজন পড়ে। এ কারণেই সেগুলো উপকূলীয় অঞ্চলের নিকটে স্থাপন করা হয়। পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র ডুবে যেতে পারে। চুল্লির কার্যক্ষমতা প্রভাবিত হতে পারে। এক্ষেত্রে জাপানের ফুকুশিমা বিদ্যুত কেন্দ্র একটি বড় উদাহরণ। ২০১১ সালের সুনামিতে এটি ভেসে যায়। বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, ফলে চুল্লির সাধারণ কার্যক্ষমতা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে সমুদ্র ও বাতাসে ক্ষতিকর বিকিরণ বা রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়ে।
বন্দর, রেল ও সড়ক নিরাপত্তা, ট্রান্সমিশন অবকাঠামো- সবই ভীষণভাবে আক্রান্ত হবে। উপকূলীয় শহর ও রাষ্ট্রগুলোর সামর্থ্য নিদারুণভাবে হ্রাস পাবে। জনগণের দোরগোড়ায় মৌলিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়াও কঠিন হয়ে যাবে। আর নাগরিকদের সেবার অভাব যেকোনো রাষ্ট্রের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়।

এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে সামুদ্রিক প্রাণিরা সূর্যের আলো ও অক্সিজেনের অভাব সহ নানা হুমকির মুখে পড়বে। এতে সামগ্রিক সামুদ্রিক প্রাণিজগৎ বিপন্ন হবে। মাটির রসায়নে পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় উদ্ভিদজগত আক্রান্ত হবে।

পর্যটন শিল্পে এর প্রভাব হবে বিপর্জয়ের মতো। ক্যারিবিয়ান দেশগুলোতেই ১৪৯টি লাখ লাখ ডলার মূল্যের রিসোর্ট হারিয়ে যাবে। সমুদ্র সৈকতঘেঁষা সম্পত্তির দাম যাবে বেড়ে। জমি চাহিদা ও জোগানে পার্থক্য এত বেশি থাকবে যে, খুব অল্প মানুষের আশ্রয় সুবিধা থাকবে।
এই সবগুলোই মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাত ছড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। বিভিন্ন ধরণের নিরাপত্তাহীনতার কারণে মানুষ অপরাধ ও সহিংসতার দিকে বেশি করে ঝুঁকবে।

রাশিয়ায় এক খরার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে পণ্যের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আর তাতেই তিউনেশিয়ায় দাঙ্গা বেধে যায়। যা শেষ অবদি আরব বসন্তে রূপ নেয়। তাই, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে সুদূরপ্রসারি ও বহুমাত্রিক। বিশেষ করে সুপেয় পানির অভাব দেখা দিলে নতুন ধরণের সংঘাত দানা বাঁধতে পারে। আর পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। যেমনটা আঁচ পাওয়া যায় সিন্ধু নদের পানি নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান বিরোধ থেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের অধিকতর ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে দুর্বল সুশাসন থাকার প্রবণতা দেখা যায়। ফলে এই দেশগুলোতে পরিস্থিতি সহজেই মারাত্মক রূপ নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টি হতে পারে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে উলটো দিকে ধাবিত করা সম্ভব নয়। কিছু ফলাফল ঠেকানো যাবে না। এগুলো অবধারিত। সুতরাং, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ঠেকানোর চেষ্টা না করে, বাস্তবসম্মত পন্থা হবে এ থেকে সম্ভাব্য ক্ষতির মাত্রা কমানোর চেষ্টা করা।
(মেজর জেনারেল (অব) এএনএম মুনিরুজ্জামান বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট। এই নিবন্ধটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বিশেষজ্ঞ হিসেবে লেখকের দেওয়া বক্তব্যের সংক্ষেপিত ও অনূদিত সংস্করণ।)
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status