শেষের পাতা

শবেবরাতের রাতে ৬ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা

৮ বছরেও বিচার হয়নি

শাহনেওয়াজ বাবলু

২১ এপ্রিল ২০১৯, রবিবার, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ন

আট বছর আগে শবেবরাতের রাতে সাভারের বড়দেশী গ্রামের কেবলাচরে ডাকাত সন্দেহে ছয় ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল দুর্বৃত্তরা। হত্যাকাণ্ডের আট বছর পরও এই মামলার বিচার কার্য শেষ হয়নি। এই হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে ছয়জন পলাতক, ৫৩ জন জামিনে এবং এক আসামি মৃত্যুবরণ করেছেন। এ মামলায় ১৪ আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এ পর্যন্ত শতাধিক কার্যদিবসে সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ আসামি সরকার দলীয় লোক হওয়ায় এই বিচার কার্য শেষ হচ্ছে না। এমনকি এই মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তা সাক্ষ্য দিতে আসেন না। আর এই হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার পাবেন কিনা এই নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন নিহতের স্বজনরা।

এদিকে সরকার পক্ষের আইনজীবী জানান, চার্জশিটভুক্ত ৯২ জনের সাক্ষীর মধ্যে ৫২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। তবে সাক্ষীদের মধ্যে যারা অনুপস্থিত রয়েছেন তাদের সাক্ষ্যগ্রহণ ছাড়াই বিচার কার্য চালানো হবে বলে জানানো হয়। নিহত ৬ জনের মধ্যে একজনের নাম ইব্রাহিম খলিল। তিনি মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ইব্রাহিমের মা মারা গেছে ৫ মাস হল। তার বাবা মো আবু তাহের ব্যবসা করেন। গতকাল তিনি বলেন, আমার দুই ছেলের মধ্যে ইব্রাহিম বড় ছিল। আট বছর হল আমার ছেলে খুন হয়েছে। এখনো ছেলের বিচার পাইনি। খুনীরা সবাই সরকার দলের লোক হওয়ায় তারা পার পেয়ে যাচ্ছে। ছেলের শোকে আমার স্ত্রীও মারা গেল। আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।  

নিহত আরেকজন শামস রহীম শাম্মাম ছিলেন বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। তিনি ধানমন্ডির ম্যাপললিফ স্কুলের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র ছিলেন। একমাত্র সন্তানকে হারানোর ব্যাথা এখনো ভুলতে পারেন না শাম্মামের বাবা-মা। শাম্মামের বাবা এডভোকেট আনিসুল হক চন্দন কান্নাজড়িতে কন্ঠে বলেন, আমার ছেলেটাকে এভাবে মেরে ফেলা হলো। আজ আট বছর পার হবার পরেও বিচার পাচ্ছি না। এর সাথে অনেকেই জড়িত আছে। আমরা চাইলেও কারো নাম বলতে পারছি না। আমি দুনিয়ার কারো কাছে বিচার চাই না। আল্লাহর কাছে পুত্র হত্যার বিচার চাই।    

এদিকে শবে বরাত এলেই শোকে কাতর হয়ে যান কামরুজ্জামান অন্তুর মা। সারারাত কান্নাকাটি করেন আর আল্লাহর কাছে ছেলে হত্যার বিচার চান। ছেলেকে হারিয়ে এখনো শোকাতুর অন্তুর বাবা আব্দুল কাদেরও। গতকাল তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার ছেলেকে তারা নৃশংশভাবে হত্যা করেছে। সরকারই যখন মামলার বাদী তখন বিচারের দাবিতে সরকারের দিকেই তাকিয়ে আছি। বাঙলা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন কামরুজ্জামান।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী শাকিলা জিয়াসমিন মিতু জানান, মামলাটি বর্তমানে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলায় তিনজন তদন্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। এর মধ্যে একজন মতিউর রহমানের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়ে গেছে। আর দুজন তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য বাকি রয়েছে। তারা আদালতে সাক্ষী দিতে না আসায় মামলার বিচার কাজে বিলম্ব হচ্ছে। এ ছাড়া সব আসামি জামিনে মুক্ত রয়েছেন।

শাকিলা জিয়াসমিন বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাদের সাক্ষ্য শেষ হলেই মামলাটিতে আসামিপক্ষের আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তিতর্ক শুনানি হবে। এর পরই রায় নির্ধারণ করা হবে। আগামী ২৮শে এপ্রিল মামলার সাক্ষীর দিন নির্ধারণ করা আছে। বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মদ অভিযোগ করে বলেন, পুলিশ এ মামলায় সহায়তা করছে না। তারা মামলাটি ভিন্ন খাতে নিতে চেয়েছিল। এজন্য তারা সাক্ষীদের আদালতে আনতে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ মামলায় অনেক আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে বলে আমি আশাবাদী।
২০১১ সালের ১৭ই জুলাই শবে বরাতের রাতে সাভারের আমিন বাজারের বরবেশী গ্রামের কেবলারচরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কামরুজ্জামান অন্তু, শামস রহীম শাম্মাম ও ইব্রাহিম খলিল, তৌহিদুর রহমান পলাশ, টিপু সুলতান, সিতাব জাবীর মুনিবকে। ওই ঘটনায় নিহতদের সঙ্গে থাকা তাদের বন্ধু আল আমিন গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান।

ওই ঘটনার পর ডাকাতির অভিযোগে আল আমিনসহ নিহতদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় একটি ডাকাতির মামলা করেন স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী আবদুল মালেক। ওই সময় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় গ্রামবাসীকে আসামি করে সাভার মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে মামলাটি তদন্ত শেষে ২০১৩ সালের ৭ই জানুয়ারি র‌্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ উদ্দিন আহমেদ ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ অভিযোগপত্রের পরে মামলাটি বিচারের জন্য এই আদালতে এলে ২০১৩ সালের ৮ই জুলাই ৬০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এ ছাড়া ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া আল আমিনকে একই ঘটনায় করা ডাকাতি মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ হত্যার ঘটনায় সাভার থানা পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হলে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একই সঙ্গে থানা পুলিশের ভূমিকা তদন্তে চার সদস্যের কমিটি করে পুলিশ সদর দপ্তর। ওই কমিটি তথ্যানুসন্ধানের পর মত প্রকাশ করে, ওই ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা ছিল ‘অপেশাদার ও দায়িত্বহীন।’

অন্যদিকে ওই ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন ন্যাশনাল ফোরাম ফর প্রটেকশন অব হিউম্যান রাইটসের মহাসচিব আইনজীবী তাজুল ইসলাম ২০১২ সালের জুলাইয়ে একটি রিট আবেদন করেন। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। চূড়ান্ত শুনানির পর হাইকোর্ট বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। বিচার বিভাগীয় তদন্তে নিহত ব্যক্তিরা ডাকাত নয় বলে প্রতিবেদন দেয়া হলে সাভার থানার পুলিশ থেকে তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি। কিন্তু সিআইডির তদন্ত সন্তোষজনক না হওয়ায় হাইকোর্ট ২০১২ সালের ৭ই আগস্ট র‌্যাবের কাছে তদন্তভার হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়। র‌্যাবকে চার মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। র‌্যাবের তদন্তের আগে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার মো. সিরাজুল হক মামলাটির তদন্ত করে আসছিলেন। তারও আগে সাভার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মতিয়ার রহমান মিয়া মামলাটির তদন্ত করেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status