প্রথম পাতা

কী করবেন বিএনপির এমপিরা?

কাফি কামাল

১৭ এপ্রিল ২০১৯, বুধবার, ১০:২০ পূর্বাহ্ন

কী করবেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি দলীয় প্রার্থীরা? সংসদীয় বিধি অনুযায়ী সংসদে যেতে চাইলে আগামী ৩০শে এপ্রিলের মধ্যেই তাদের শপথ নিতে হবে। কিন্তু ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন ও এর ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। একই সঙ্গে সংসদে যোগ না দেয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে দলটির। এদিকে সংসদে যোগ দিতে এলাকাবাসীর চাপ রয়েছে নির্বাচিতদের ওপর। সরকারের   তরফে চাপ এবং লোভের গুঞ্জনও রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। অন্যদিকে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে শপথ নিয়ে   দল এবং জাতির কাছে বেঈমান হিসেবে পরিচিত হওয়ার পাশাপাশি আশঙ্কা রয়েছে কর্মী-সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার। এমন পরিস্থিতিতে কি করবেন বিএনপির নির্বাচিত এমপিরা?

প্রথম দিকে গুঞ্জন ছিল নির্বাচনের বৈরি পরিবেশ-পরিস্থিতি নিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নেতাকর্মীদের ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হলে এবং দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন মুক্তি পেলে সংসদে যেতে পারেন বিএনপির এমপিরা। কিন্তু নির্বাচনের তিনমাস পরও কর্মী-সমর্থকদের ক্ষোভ বেড়েছে বৈ কমেনি। এখন পর্যন্ত কারামুক্তিও পাননি দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। অন্যদিকে শপথ নেয়ার সময় যত কমে আসছে ততই কৌতুহল বাড়ছে শপথ নিয়ে। সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের কারও কারও বক্তব্যসহ গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে তা দলের জন্য বিব্রতকর হয়ে উঠছে কখনো কখনো। বিশেষ করে গণফোরাম মনোনীত দুই এমপির শপথ নেয়ার পর বিএনপিতে একটি জটিলতা তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে সোমবার রাতে গুলশানে একটি বৈঠকে বসেছিলেন বিএনপি প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিতরা। সেখানে পাঁচ নেতা দলের মহাসচিব মির্জা  ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে তাদের ওপর এলাকাবাসীর চাপসহ নানা বিষয় তুলে ধরেন। তারা সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে নিজেদের আগ্রহের কথাও প্রকাশ করেন। তবে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সংসদে না যাওয়ার অঙ্গিকারও করেন।

এটাকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচনা করছেন রাজনৈতিক মহল। বিপরীতে নির্বাচিতদের ধৈর্য্য ধরার এবং দলের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন মহাসচিব। সরকারের কোন ধরনের কৌশলে বিভ্রান্ত না হতে সতর্কও করেছেন তাদের। এ নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেননি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যিনি নিজেও একাদশ জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ীদের একজন। নির্বাচিতরা বলছেন, প্যারোলে মুক্তি কোনোভাবেই খালেদা জিয়ার জন্য সম্মানজনক নয়, তাদের প্রত্যাশিতও নয়। তারা প্রত্যেকেই খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি প্রত্যাশা করেন। তারা মনে করেন, খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেলেই দলের পক্ষে অন্যান্য বিষয় সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। বৈঠকের আলোচ্য বিষয়বস্তু নিয়ে প্রশ্নের জবাবে অংশ নেয়া পাঁচ নেতাই বলেছেন, তারা দলের তরফে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করেন। কেউ কেউ বলেছেন, পরে তারা আবারও বৈঠক করবেন। কেউ কেউ বলছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে তারা কোনো পদক্ষেপই নেবেন না।

বৈঠকের পর বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও চাপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে নির্বাচিত হারুনুর রশীদ বলেন, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমাদের ডেকেছিলেন। কিছুদিন ধরে পত্রপত্রিকায় আমাদের শপথ গ্রহণ নিয়ে নানা খবর প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে ডেকে সতর্ক করা হয়েছে। যাতে আমাদের কেউ বিভ্রান্ত না হন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে না যান। হারুন বলেন, আমাদের কয়েকজন আগে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন আবার কয়েকজন এবারই প্রথম নির্বাচিত হয়েছেন। যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের ওপর এলাকার মানুষের চাপ আছে এটা সত্য। কেউ কেউ তাদের বক্তব্যে সেটা তুলে ধরেছেন। কিন্তু আমরা নির্বাচিত হয়েছি দলীয় প্রতীকে, দলের সমর্থনে। এখানে দলের সিদ্ধান্তই প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আমরা এখন পর্যন্ত একমত যে, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কোন সিদ্ধান্ত নেব না। ব্রাহ্মনবাড়িয়া-২ আসন থেকে নির্বাচিত উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া বলেন, সোমবারের বৈঠকে বিভিন্ন দিক নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আমরা সবাই একমত যে, ব্যক্তিগত নয়- দলীয় সিদ্ধান্ত যা হয় তাই করব। এক প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ এই নেতা বলেন, আমরা প্রথমেই চাই দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি। এটাই মেইন। তারপর অন্য জিনিষ। তিনি মুক্তি পেলে সংসদে যাওয়া বা অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি না পেলে তারা কি বিচ্ছিন্নভাবে শপথ নেবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে উকিল আবদুস সাত্তার বলেন, আমরা তো বিচ্ছিন্নভাবে যেতে চাই না, একসাথে যেতে চাই। তাই আপনারাও দোয়া করেন যেন একটি ভালো সিদ্ধান্ত আসে। দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা সোমবার রাতে বসেছিলাম। আমাদের মূল এজেন্ডা ছিল সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকা। আমরা যেন কেউ বিচ্ছিন্ন না হই। যা করার একসঙ্গেই করি। বৈঠকে সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে এলাকাবাসীর চাপের কথা সবাই তুলে ধরেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সংসদে না যাওয়ার পক্ষেই রয়েছে দলের সিদ্ধান্ত। ফলে আগামীতে আমরা যাবো কিনা সেটা মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতারাই বলতে পারবেন।

অন্যদিকে ঠাকুরগাঁও-৩ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপি নেতা জাহিদুর রহমান বলেন, বিএনপির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত আমরা পাঁচজন সোমবার রাতে একটি হোটেলে বসেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং কে কি চিন্তা করছি সে ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করা। পরে আমরা দলের চেয়ারপারসনের গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে যাই। সেখানে আমাদের দলের মহাসচিবের সঙ্গেও আমরা আলোচনা করি। জাহিদুর রহমান বলেন, বিএনপি সংসদে যোগ না দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা এখন পর্যন্ত সে সিদ্ধান্তে একমত রয়েছি। কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের ওপর এলাকার ভোটারদের চাপ রয়েছে। তারা চান আমরা সংসদে গিয়ে তাদের পক্ষে, চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলের পক্ষে, দেশের পক্ষে কথা বলি। আমরা এলাকাবাসীর এই চাপের কথা দলের উর্ধ্বতন মহলকে জানিয়েছি। আমাদের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হলো দেশনেত্রী খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি পেলে আমরা সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেব।

সংসদে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারের তরফে কোন সুনির্দিষ্ট আমন্ত্রণ বা খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ব্যাপারে কোন শর্ত আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে জাহিদুর রহমান বলেন, আমাদের সামনে আগামী ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত সময় আছে। এক বিবেচনায় সময় খুবই কম, আরেক বিবেচনায় এখনও অনেক সময়। দেশনেত্রীর জামিনের বিষয়টি এখন একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পরিণত রয়েছে। আমরা আশা করছি, সরকার চাইলে বিবেচনা করতেই পারে। আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তারা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। তবে সরকারের সঙ্গে আমাদের এ নিয়ে কোন আলাপ-আলোচনা হয়নি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে মুক্তি না পেলে কি করবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটা নিয়ে এখন পর্যন্ত আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা আরো বসবো। যা করবো, সবাই একসাথেই করবো এবং চিন্তাভাবনা করেই করবো। তবে নিজের অবস্থান পরিস্কার করে বগুড়া-৪ আসন থেকে নির্বাচিত এমপি মোশাররফ হোসেন বলেন, নির্বাচনের পর আমরা নির্বাচিতরা মামলা-হামলাসহ নানা কারণে কখনো একসঙ্গে বসতে পারিনি। ফলে আমরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হতে একটি চা চক্রে বসেছিলাম। তিনি বলেন, সংসদে এমপি হিসেবে শপথ নেয়ার সময় শেষ হয়ে আসছে। এটা আমরা যেমন জানি, আমাদের দলের শীর্ষ নেতৃত্বও জানেন।

মোশাররফ হোসেন বলেন, সংসদীয় এলাকার মানুষের দাবি আছে। তারা বলছে, কষ্ট করে ভোট দিয়েছি, নির্বাচিত করেছি এখন সংসদে যান। এলাকার উন্নয়নের কথা বলেন। এলাকাবাসীর সুখে-দুঃখে পাশে থাকেন। কিন্তু সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। আমরা মনে করেছিলাম, সবাই বসলে হয়তো একটি পথ বেরিয়ে আসবে আলোচনায়। কিন্তু তেমন কোন পথ আসেনি। তিনি বলেন, আমরা চেয়েছিলাম, আমাদের দেশনেত্রী নিঃশর্ত জামিনে মুক্তি পান। কারণ প্যারোলে মুক্তির অনেক শর্ত থাকে, সেটা দেশনেত্রীর জন্য সম্মানজনক নয়। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ৭৪ বছর বয়স্ক নারী যেখানে বন্দী সেখানে আমাদের স্বার্থ কোনোদিন বড় হতে পারে না। মোশাররফ বলেন, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে এলাকাবাসীর কাছে আমার মূল্যায়ণ আছে। কিন্তু সেটা বৃহত্তর অর্থে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। আমি বিএনপি করি- দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে, ধানের শীষ প্রতীক দিয়েছে, দলের লোকজন আমার পক্ষে ভোট করেছে, দলের সমর্থকরা আমাকে ভোট দিয়েছে বলেই আমি নির্বাচিত হতে পেরেছি। এটা আমি বিশ্বাস করি, অনুভব করি। তাই দল সিদ্ধান্ত দিলে সংসদে যাবো, নইলে যাবো না। অন্যদের কথা আমি বলতে পারবো না, তবে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে আমি সংসদে যাবো না। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আমি নিজে জাতীয় বেঈমান হতে চাই না ও আমার উত্তরপুরুষদের বেঈমানের সন্তান হিসেবে পরিচিত করাতে চাই না।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status