শেষের পাতা

ফের আন্দোলনে পাটকল শ্রমিকরা

স্টাফ রিপোর্টার

১৬ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ১০:২৪ পূর্বাহ্ন

ফের আন্দোলনে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা। নয় দফা দাবিতে ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘট কর্মসূচি পালন শুরু করেছেন তারা। দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজপথ-রেলপথ অবরোধ করেন শ্রমিকরা। এতে বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে জানান, শ্রমিকরা নতুন রাস্তা মোড়ে অবস্থান নিয়ে খুলনা-যশোর মহাসড়ক, নতুন রাস্তা মোড় থেকে সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ড সড়ক, বিআইডিসি সড়ক এবং রেলপথ অবরোধ করে রাখে। এ ছাড়া তারা বিক্ষোভ মিছিল, টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও সমাবেশ করে। শ্রমিকদের আন্দোলনে খুলনার শিল্পাঞ্চল আবারো উত্তাল হয়ে উঠেছে। মহাসড়কে থাকা যাত্রীরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে।

বকেয়া মজুরি পরিশোধ এবং মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ৯ দফা দাবিতে বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের ডাকে খুলনার ক্রিসেন্ট, প্ল্যাটিনাম, খালিশপুর, দৌলতপুর, স্টার, ইস্টার্ন, আলিম এবং যশোরের জেজেআই ও কার্পেটিং জুট মিলের শ্রমিকরা এ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছেন।

আন্দোলনরত শ্রমিক নেতারা বলেন, সরকার ঘোষিত জাতীয় মজুরি ও উৎপাদনশীলতা কমিশন-২০১৫ সুপারিশ বাস্তবায়ন, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পি এফ গ্রাচ্যুইটি ও মৃত শ্রমিকদের বীমার বকেয়া প্রদান, টার্মিনেশন, বরখাস্ত শ্রমিকদের কাজে পুনর্বহাল, শ্রমিক-কর্মচারীদের নিয়োগ ও স্থায়ী করা, পাট মওসুমে পাটক্রয়ের অর্থ বরাদ্দ, উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিলগুলোকে পর্যায়ক্রমে বিএমআরই করাসহ নয় দফা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের দাবিগুলো এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় আমরা রাজপথে আবার নামতে বাধ্য হয়েছি।

শ্রমিক নেতারা জানান, ৬ই এপ্রিল ঢাকায় বিজেএমসি’র কর্মকর্তাদের সঙ্গে শ্রমিক লীগ নেতাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দফা বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়ায় বিকালে আবারো বিজেএমসি’র চেয়ারম্যানসহ অন্যদের নিয়ে ছোট পরিসরে বৈঠক করা হয়। কিন্তু সেখানেও দাবি মেনে নেয়ার কোনো সিদ্ধান্ত তারা দিতে পারেন নি। সরকার টাকা দিলে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি দেয়া হবে বলে জানান কর্মকর্তারা। কিন্তু কবে নাগাদ ওই টাকা পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত নয়। যার কারণে তারা আবারো আন্দোলনে নেমেছেন।

রাষ্ট্রায়ত্ত ক্রিসেন্ট জুটমিলের সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, মজুরি ও মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ৯ দফা দাবিতে শ্রমিকদের ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘট শুরু হয়েছে। দাবি মানা না পর্যন্ত এ কর্মসূচি চালিয়ে যাবো।
বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের খুলনা-যশোর অঞ্চলের আহ্বায়ক মো. মুরাদ হোসেন বলেন, সোমবার থেকে ১৮ই এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা করে টানা ৯৬ ঘণ্টা পাটকল ধর্মঘট এবং সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করা হবে। এরপর বিরতি দিয়ে আগামী ২৫শে এপ্রিল গেটসভা এবং ২৭, ২৮ ও ২৯শে এপ্রিল ৭২ ঘণ্টার পাটকল ধর্মঘটসহ প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা করে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে।

বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি)সূত্র জানায়, খুলনাঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের ৬৪ সপ্তাহের বেতন ও মজুরি ৪৪ কোটি ২০ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। এর মধ্যে শুধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে ১২ কোটি ৩৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। শ্রমিকদের মজুরি বকেয়া রয়েছে ৩১ কোটি ১৮ লাখ ৫৮ হাজার টাকা।
এদিকে পাটকল শ্রমিকদের ধর্মঘট শুরু হওয়ায় ভোর ৬টা থেকে খুলনা রেলওয়ে স্টেশন থেকে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি। একই সঙ্গে নগরীর দৌলতপুর নতুন রাস্তা মোড়ে শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করায় খুলনা-যশোর মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।

খুলনা স্টেশন মাস্টার মানিক চন্দ্র সরকার বলেন, সকাল ৬টা থেকে ট্রেন ছাড়া সম্ভব হয়নি। অবরোধ সকাল ৮টা থেকে শুরু হলেও যাত্রী ও ট্রেনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ভোর ৬টা থেকেই ট্রেন ছাড়া বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে ভোর ৬টার কমিউটার, সাড়ে ৬টার কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস, সোয়া ৭টার রূপসা এক্সপ্রেস, সকাল ৮টা ৪০-এ চিত্রা এক্সপ্রেস, ৯টা ১০-এ রকেটসহ দুপুর ১২টা পর্যন্ত কোনো ট্রেনই ছাড়া সম্ভব হয়নি।

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে: ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ই এপ্রিল টানা ৯৬ ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ রেখে ধর্মঘট পালন ও প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা রাজপথ-রেলপথ অবরোধ। এরপর বিরতি দিয়ে ২৫শে এপ্রিল প্রত্যেক মিলে শ্রমিক সভা এবং ২৭, ২৮ ও ২৯শে এপ্রিল টানা ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘট এবং প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা রাজপথ-রেলপথ অবরোধ। গত ১২ই এপ্রিল সন্ধ্যায় পিপলস গোল চত্বরের শ্রমিক সভা থেকে শ্রমিক নেতারা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ৯ দফা দাবির ভিত্তিতে গত ৬ই এপ্রিল ঢাকায় বিজেএমসির প্রধান কার্যালয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সভা সফল না হওয়ায় শুক্রবার বিআইডিসি রোডের পিপলস গোল চত্বরে ধর্মঘট, রাজপথ রেলপথ অবরোধ, বিক্ষোভ মিছিলসহ ৯ দিনের আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।

উল্লেখ্য, জাতীয় মজুরি কমিশন-২০১৫ এর রোয়েদাদ, পাটক্রয়ের অর্থ বরাদ্দ, বদলি শ্রমিক স্থায়ীকরণ, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের সব বকেয়া পরিশোধ, শ্রমিকদের প্রতি সপ্তাহে মজুরি পরিশোধসহ বকেয়া মজুরি প্রদান, খালিশপুর ও দৌলতপুর জুট মিলের শ্রমিকদের বিজেএমসির অন্যান্য মিলের ন্যায় সব সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ ৯ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে গত কয়েক বছর ধরে আন্দোলন করে আসছে। সর্বশেষ চলতি মাসের ২, ৩ ও ৪ঠা এপ্রিল দেশের সব পাটকলে একযোগে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘট ও ৪ ঘণ্টা করে রাজপথ ও রেলপথ অবরোধ কর্মসূচি পালন করে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা। শ্রমিকদের ধর্মঘট ও অবরোধের কারণে মিলসহ শিল্পাঞ্চল খুলনা প্রায় অচল হয়ে পড়ে। ৯ দফা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকে পাটকলের শ্রমিকরা। এ সময় খুলনা-যশোর মহাসড়কের পাবলা পুলিশ বক্স ভাঙচুর ও ৪ পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আন্দোলন চলাকালে ৩রা এপ্রিল বিজেএমসির পক্ষ থেকে শ্রমিক নেতাদের আলোচনায় ডাকা হয়। ৬ই এপ্রিল ঢাকায় বিজেএমসির কার্যালয়ে বিজেএমসির চেয়ারম্যান শাহ নাসিমের সঙ্গে ৯ দফা দাবি নিয়ে বৈঠকে বসেন পাটকল শ্রমিক লীগ নেতারা।

সেই বৈঠকে শ্রমিকদের স্বার্থ আদায় না হওয়ায় বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান শ্রমিক নেতারা। ৭ই এপ্রিল বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগ, রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ নেতারা জরুরি বৈঠকে বসেন। বৈঠকে জাতীয় মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন, প্রতি সপ্তাহে মজুরি প্রদান, বদলি শ্রমিকদের স্থায়ীকরণ, অবসরপ্রাপ্তদের সব বকেয়া পরিশোধের দাবিতে নতুন আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হয়।

নরসিংদীতে শ্রমিক ধর্মঘট
নরসিংদী প্রতিনিধি জানান, মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের ডাকে নরসিংদীর ইউএমসি জুটমিলস ও ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুটমিলসে গতকাল থেকে শুরু হয়েছে ৯৬ ঘণ্টার শ্রমিক ধর্মঘট। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি দীর্ঘদিনেও মেনে না নেয়ায় ইউএমসি জুট মিলসের উত্তেজিত শ্রমিকরা বিভিন্ন স্লোগানে মিল গেটের সামনে জামতলায় অবস্থান করাসহ বিক্ষোভ সমাবেশ অব্যাহত রেখেছে। এ সময় শ্রমিকরা রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত মিল গেট সংলগ্ন আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে রাখে। ইউএমসি জুট মিলস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সফিকুল ইসলাম মোল্লা জানান, ইতিপূর্বে বহুবার মাসব্যাপী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে দ্রুত শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মজুরি কমিশনসহ ৯ দফা দাবি মেনে নেয়ার আহ্বান জানানো হলেও অজ্ঞাত কারণে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেয়া হয়নি। তাই বাধ্য হয়েই তারা দেশব্যাপী কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘট পালন করছেন।

অচিরেই শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মজুরি কমিশনসহ ৯ দফা দাবি মেনে নেয়া না হলে আগামীকাল থেকে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করে নরসিংদী জেলাকে অচল করে দেয়া হবে বলে শ্রমিক নেতারা জানান। বিক্ষোভ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন- সিবিএ সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন, সাবেক সিবিএ সভাপতি আনিসুর রহমান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, শ্রমিক নেতা কাউছার খানসহ অন্য শ্রমিক নেতারা।

সিরাজগঞ্জে ৯৬ ঘণ্টার শ্রমিক ধর্মঘট
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সারা দেশের ন্যায় সিরাজগঞ্জ জাতীয় জুট মিলের শ্রমিকরা ৯৬ ঘণ্টার ধর্মঘট কর্মসূচি পালন শুরু করেছে। সোমবার সকাল থেকে তারা মিলের উৎপাদন কাজে যোগদান না করে এ আন্দোলন শুরু করে। এসময় তারা তাদের শ্রম আইনের আওতায় ৯ দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবিতে মিল অভ্যন্তরে সমাবেশ করে। একই সঙ্গে তারা বিজেএমসির অসাধু কর্মকর্তাদের কারণে মিলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন।
সিরাজগঞ্জ জাতীয় জুট মিল শ্রমিক লীগের সভাপতি আরঙ্গ আজিজ স্বপন ও সাধারণ সম্পাদক শরিফুল ইসলাম জানান, প্রধানমন্ত্রী নিজে সিরাজগঞ্জ জাতীয় জুট মিল চালু করেছেন। কিন্তু শ্রমিকদের চুসে খাচ্ছে বিজেএমসি। তাই বিজেএমসি’র রাহুগ্রাস থেকে মিলকে রক্ষা করে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ও পাওনা পরিশোধ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।

সিরাজগঞ্জ জাতীয় জুট মিলের উপ-মহাব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম জানান, মিলের অচলাবস্থা অবসানের জন্য সরকারের দ্রুত উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করছে। ফলে মিলের উৎপাদন ব্যবস্থা কমে যাচ্ছে।


   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status