দেশ বিদেশ

বড় হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম থেকে

১৬ এপ্রিল ২০১৯, মঙ্গলবার, ১০:১৫ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রাম বন্দরের যাত্রা শুরু মূলত ১৯৭৭ সালেই। তখনো এটি ছিল কন্টেইনার পোর্ট। শুরুতেই মাত্র ৬টি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল এই বন্দর। চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমা ছিল তখন মাত্র ৫ নটিক্যাল মাইল। আর স্থলসীমায় ছিল মাত্র একটি কন্টেইনার টার্মিনাল।

অথচ ৪০০ বছর আগে থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছিল এই বন্দর। ১৮৮৮ সালের ২৫শে এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার কার্যকর হয়। আর সেদিনটিকে বন্দর দিবস হিসেবে পালন করা হয়। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই বন্দর ক্রমেই হয়ে উঠে অর্থনীতির চাকা।

ফলে ২০১১ সালে আলফা, ব্রেভো এবং চার্লি নামে তিনটি অ্যাংকারেজে বিভক্ত করে চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমা বাড়ানো হয় ৭ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত। এরপর কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের সক্ষমতা বেড়ে যায় আরো কয়েকগুণ। তাতে কন্টেইনার টার্মিনাল বাড়ানোর চাহিদা আরো বেড়ে যায়। শুরু হয় বন্দরের জলসীমা ৫০ নটিক্যাল মাইল এবং স্থলে বে টার্মিনাল নির্মাণসহ ২২টি উন্নয়ন খাত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। যা দিয়ে মোকাবিলা হবে ২০৩৬ সাল পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকা।

আর চট্টগ্রাম বন্দর বর্তমানের চেয়ে বড় হবে ১৩ গুণ, ১৯৭৭ সালের চেয়ে ৩০ গুণেরও বেশি বড় হবে। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বাড়বে ৫০ গুণেরও বেশি। এমন তথ্যই জানালেন চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ।
তিনি জানান, মাত্র ৬টি কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম বন্দর ২০১৮ সালে সর্বশেষ ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬টি কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে সক্ষম হয়েছে। যার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ছিল ২০ ফুট লম্বা (টিইইউস) হিসেবে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ২০২টি।

২০০৯ সালেও চট্টগ্রাম বন্দর লয়েডস লিস্টের শীর্ষ শত কন্টেইনার পোর্টের তালিকায় ছিল ৯৮তম। নয় বছরের মাথায় ২৭ ধাপ টপকে বর্তমানে উঠে এসেছে ৭১তম স্থানে। এখন আমাদের উদ্যোগ ২০৩৬ সাল পর্যন্ত মোকাবিলার জন্য। বন্দরের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি, অর্জন ও সফলতার মধ্যেও সক্ষমতা বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিরন্তর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানান বন্দর চেয়ারম্যান কমডোর জুলফিকার আজিজ।
তিনি বলেন, জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসাল্টিংয়ের গবেষণা বলছে ২০৩৬ সালে ২০ ফুট দীর্ঘ ৫৬ লাখ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে চট্টগ্রাম বন্দরকে। প্রতি বছর চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হিসাবে এনে এ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তারা।

জাহাজ জট ও কন্টেইনার জট দূর করে বন্দরকে আরো গতিশীল করতে তাই ২৫ হাজার কোটি টাকার ২২টি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত এক দশকে বন্দরে কোনো টার্মিনাল না বাড়লেও এখন কর্ণফুলীর মোহনায় বে টার্মিনাল, পতেঙ্গায় কন্টেইনার টার্মিনাল, লালদিয়া টার্মিনাল ও কর্ণফুলী কন্টেইনার টার্মিনাল নামে চারটি স্বতন্ত্র টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছে।

যাত্রা শুরু থেকে যে বন্দরে চারটি কি গ্যান্ট্রিক্রেন এসেছে, সেই বন্দরে এখন একসঙ্গে আনা হয়েছে ছয়টি কি গ্যান্ট্রিক্রেন। বন্দরে কন্টেইনারজট কমাতে ৩৭ একর জায়গার ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে নতুন ওভারফ্লো কন্টেইনার ইয়ার্ড। আবার সাউথ কন্টেইনার ইয়ার্ড চালু করে তাতে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে নিলাম পণ্যের কন্টেইনার। বন্দরকে সমপ্রসারণ করতে সীতাকুন্ড এলাকায়ও আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হচ্ছে।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, ‘সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও ২০১৭ সালে আমরা কন্টেইনার ও কার্গো পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে ১২৯ বছরের রেকর্ড ভেঙেছি। বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে বেশ কিছু টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অপারেশন কাজে গতি আনতে সংগ্রহ করা হচ্ছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও।

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে লাগোয়া স্থান পতেঙ্গায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ‘বে-টার্মিনাল’ নামক নতুন এ টার্মিনালের অনুমোদনও দিয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়। ৯০৭ একর জমির ওপর ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এ টার্মিনাল নির্মাণ কাজ শেষ হলে চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে গতিশীলতা আরো বাড়বে। ২০১৬ সালে এ প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে ১৭৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং ১২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের টার্গেট নির্ধারণ করে চলছে প্রকল্পের কাজ।

লালদিয়ায় ৮২০ মিটার দৈর্ঘ্যের জেটি এবং ৫৮ একর ব্যাকআপ এলাকা নিয়ে লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ২০১৭ সালে আগ্রহী পাঁচটি কোমপানিকে ইতিমধ্যে শর্টলিস্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ড্রাইডক জেটির পাশে ৬০০ মিটার জেটি ও ২৭ একর ব্যাকআপ এলাকা নিয়ে পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ করতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। এডিবির অর্থায়নে এ টার্মিনালের প্রথম পর্যায়ে ৮৭০ মিটার দীর্ঘ জেটি পুনর্নির্মাণের কাজ করা হবে।

মিরসরাইয়ে নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ ইকোনমিক জোনকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা দিতে সীতাকুন্ড ও মিরসরাইয়ের মধ্যবর্তী স্থানে নতুন একটি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি সমপন্ন করতে ডেনিশ প্রতিষ্ঠান রেম্বল গ্রুপের সঙ্গে গত ৪ঠা জানুয়ারি একটি চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
লাইটারেজ জাহাজ থেকে নদীপথে পণ্য আনা-নেওয়ার কার্যক্রম সহজ করতে বন্দরের বহির্নোঙরে একটি ফ্লোটিং হারবার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে ২০১৭ সালের ১৪ই ডিসেম্বর ডাচ প্রতিষ্ঠান পাবলিক ডোমেইন আর্কিটেকটেন-এর সঙ্গে চুক্তিও সমপাদিত হয়েছে।

এ ছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরকে পরিবেশবান্ধব করতে গ্রিন পোর্ট ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডসের আর্থিক সহায়তায় এক মিলিয়ন ইউরো খরচ করে আরও আধুনিক করা হচ্ছে বন্দরের ট্রেনিং সেন্টার। বন্দরের ব্যবস্থাপনা আরো আধুনিক করতে জাপানের কোবে বন্দরের সঙ্গে স্বাক্ষর করা হয়েছে এমওইউ। ২০১৭ সালে নির্মিত কার শেডকে বন্ডেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্তমান জলসীমা সাত নটিক্যাল মাইল। ২০১১ সালে আলফা, ব্রেভো এবং চার্লি নামে তিনটি অ্যাংকারেজে বিভক্ত করে বন্দরের এই সীমানা বাড়ানো হয়। প্রায় ৪০০ বছর আগে ৫ নটিক্যাল মাইল জলসীমা নিয়ে বন্দরটির যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদা, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বৃদ্ধির কারণে এই সমুদ্র বন্দরের জলসীমা আবারও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় থেকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার পর গেজেট হবে। আর এটি অনুমোদন পেলে বন্দরের জলসীমা চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উপকূলের উত্তরে কাট্টলী থেকে সীতাকুন্ড এবং দক্ষিণে আনোয়ারার গহিরা থেকে মহেশখালীর সোনাদিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. আবু জাফর বলেন, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ি ঘিরে এলএনজি টার্মিনাল ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রচুর জাহাজ আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। আর এমনিতে পণ্যবাহী জাহাজ আসার পরিমাণ তো বাড়ছেই। সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের জলসীমা বাড়ানোর বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। এ কারণে বন্দরের জলসীমা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status