বাংলারজমিন

যুদ্ধাহত নেত্রকোনার সালেহা আজও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি

কবীর হোসেন চান মিয়া, নেত্রকোনা থেকে

২৭ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ৯:২৫ পূর্বাহ্ন

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পিঠে বুলেটবিদ্ধ হয়ে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আজও বেঁচে আছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যকারী এক সাহসী নারী সালেহা বেগম।
নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের আব্দুর রহিম কাচু মিয়ার মেয়ে সালেহা বেগম স্মৃতিচারণ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার বয়স তখন ১০ কি ১১ বছর। আমাদের গ্রাম বাজিতপুরসহ বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বিভিন্ন বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতেন। আমি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণকারী নারী মুক্তিযোদ্ধা মিরাশী বেগমের সহচর হিসেবে কাজ করে আসছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল থানায় অবস্থানকারী মিলিটারিদের দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখা। তারা কোথায় যাওয়া-আসা করে এসব খোঁজখবর মুক্তিযোদ্ধা মিরাশী বেগম ও তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এখলাছ আহমেদ কোরাইশীর কাছে পৌঁছে দেয়া। অক্টোবরের শেষ দিকে মদন উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদরদের বেশ কয়েকটি সরাসরি তুমুল যুদ্ধ হয়। ৩০শে অক্টোবর থেকে থেমে থেমে ১৭২ ঘণ্টা যুদ্ধ চলছিল। সে সময় আমি হানাদার বাহিনীর খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার সময় হঠাৎ আমি পিঠে বুলেটবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তখন মুক্তিযোদ্ধারা আমাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক মতিয়র রহমানের কাছে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। পল্লী চিকিৎসক হওয়ায় তিনি সে সময় আমার পিঠ থেকে বুলেটটি বের করতে পারেননি। আল্লাহর অশেষ রহমতে সকলের দোয়ায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আমার পরিবারের লোকজন আমাকে নেত্রকোনা সদর উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বাইশদার গ্রামের নুরুল হক বকুলের সাথে বিয়ে দেন। আমাদের দাম্পত্য জীবনে চার ছেলে ও এক মেয়ে সন্তান জন্মগ্রহণ করে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে আমরা বর্তমানে জেলা শহরের কুরপাড় এলাকায় বসবাস করছি।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিঠে বুলেটবিদ্ধ থাকার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। মাঝে মধ্যে যখন পিঠে অসহ্য ব্যথা অনুভূত হয় তখন আমার মনে সেই ভয়াল যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়। পিঠে বুলেট নিয়েই দুঃসহ যন্ত্রণায় জীবনের অনেকগুলো বছর পার করেছি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিঠের ব্যথার যন্ত্রণা বাড়তে থাকায় এবং শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দেয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছি কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না। কিছুদিন আগে জনৈক অর্থোপেডিক্স ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এক্স-রে করার পর রঞ্জন রশ্মিতে ধরা পড়ে আমার পিঠে রয়ে যাওয়া ৭১ এর সেই বিদ্ধ বুলেটটি। আমি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বার বার মুক্তিযোদ্ধা সংসদে গিয়ে আবেদন নিবেদন করলেও তারা আমার বিষয়টি আমলে নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেননি। আমার বয়স এখন প্রায় ৬০-এর ঊর্ধ্বে। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে পাইনি স্বীকৃতি, পাইনি কোন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা।
বুলেটবিদ্ধ যুদ্ধাহত সালেহা বেগমের বড় ছেলে মো. রাসেল বলেন, আমরা ছোটবেলায় শুনেছি মায়ের আহত হওয়ার গল্প। কিন্তু এখনো যে তাঁর শরীরে বুলেট আছে, তা আমরা জানলাম ডাক্তারের কাছে গিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের বড় বড় অবদান থাকলেও তা খুব বেশি একটা আমাদের সামনে আসেনি। তারা আজও অবহেলিত। আমাদের মা মুক্তিযুদ্ধের এমন একটি স্মৃতি বহন করে আছে, যার জন্য আমরা গর্বিত। আমরা চাই আমাদের মাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার স্বীকৃতি দিক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধ সংসদ নেত্রকোনা জেলা ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা এখলাছ আহমেদ কোরাইশী সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সালেহা বেগমের পিঠে বুলেটবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, তখনকার দিনে সালেহা ছিল অত্যন্ত সাহসী একটি শিশু। আমি তাকে বকাবকি করতাম যে, তুমি এত ছোট তারপরও কেন মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসো? বকাবকি শুনেও নারী মুক্তিযোদ্ধা মিরাশী বেগমের সঙ্গে এসে দেখা করে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের অবস্থান জানাতো। আমি এই যুদ্ধাহত সাহসী নারীকে জানাই লাল সালাম।

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status