বাংলারজমিন

খুমেক হাসপাতালে দালালদের প্রতারণার ফাঁদ

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা থেকে

২৭ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ৯:১৯ পূর্বাহ্ন

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতারিত না হওয়ার জন্য মাইকিং চলছে রীতিমতো। বলা হচ্ছে দালালদের কাছ থেকে সতর্ক থাকতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযানও চালাচ্ছে মাঝে মধ্যে। তবে এতে দিন-দিন দালাল নির্মূলের পরিবর্তে আরো বাড়ছে। বহির্বিভাগ থেকে শুরু করে আন্তঃবিভাগ সব জায়গায় সক্রিয় রয়েছে এসব দালাল চক্র। হাসপাতালের মেইন গেট থেকে শুরু করে ভেতর পর্যন্ত চারস্তরের প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে এসব দালাল। কোনো না কোনো ফাঁদে পড়ে দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুমেক হাসপাতালের সামনে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে স্বাস্থ্য প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব প্রতিষ্ঠান চলছে। আর রোগী ধরার জন্য শতভাগ দালাল নির্ভর এসব প্রতিষ্ঠানের চক্র চারস্তরের প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে। এদের প্রথম টার্গেট হাসপাতালের মেইন গেটে। ঢুকতেই বোরকা পরা মহিলাদের মধ্যে কে দালাল তা দেখে বোঝারও উপায় নেই। যশোরের নওয়াপাড়া থেকে মো. জসিম মেয়েকে নিয়ে মেডিসিনের ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। আসতে তার বেলা সাড়ে ১১টা বেজে গেছে। হাসপাতালে ঢুকতেই বোরকা পরা এক নারী তাকে বলে ভাই টিকিট দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। আপনারা দেরি করেছেন কেন। এখন তো ডাক্তার নেই। টিকিট না পেলে আমাকে বলবেন। মাত্র ১শ’ টাকায় মামনিকে বড় ডাক্তার দেখিয়ে দেব, এই সামনেই ক্লিনিকটা। মহিলা তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল হাসপাতালের সামনে উদয়ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। গিয়ে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় ১২শ’ টাকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হলো।
বয়রা ক্রস রোডের বাসিন্দা সোহরাব ফরাজীকেও আটকানো হয়েছিল মেইন গেটে। ছেলের সঙ্গে গেছেন হাঁটুর ব্যথা নিয়ে। কিন্তু ছেলে সচেতন হওয়ায় দালালের কথা না শুনে টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ান। ছেলেকে লাইনে দাঁড় করিয়ে চেয়ারে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু সেখানে এক পুরুষ বললো এখানে ভালো দেখে না। আপনি বড় ডাক্তার দেখাবেন চলেন। ১শ’ টাকা দিলেই হবে। ঢাকা থেকে ডাক্তার আসে প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার। এসব কথায় মন গলে যায় তার। ছেলেকে নিয়ে চলে যান হাসপাতালের সামনে সুগন্ধা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক মেডিকেল অফিসারের কাছে। তিনি নাক, কান, গলা থেকে শুরু করে শিশু, সার্জারি ও অর্থপেডিক বিষেশজ্ঞ। তার প্যাডে এসব বাহারি ডিগ্রির পরে চিকিৎসক হিসেবে খুলনা মেডিকেল কলেজের নাম লেখা। ১শ’ টাকায় হাঁটুর ব্যথার বড় ডাক্তার দেখাতে এসে তিনিও ১৫শ’ টাকার পরীক্ষা নিরীক্ষার ফাঁদে পড়েন। তবে তার মধ্যে ডাক্তার এক্সরে লেখেন নি। এত গেল ডাক্তার দেখানোর আগে দালালদের ফাঁদ।
এসব ফাঁদ উপেক্ষা করে ডাক্তার দেখিয়ে বের হয়েছিলেন গল্লামারী এলাকার মনিকা রানি বিশ্বাস। অনেকগুলো পরীক্ষা দিয়েছেন চিকিৎসক তাকে। বের হতেই তার হাত থেকে টিকিট নিয়ে নিলেন এক যুবতী। বললেন, এখন তো হাসপাতালে এগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে না। হাসপাতালে যদি না হয় আপনি আমার সঙ্গে চলেন। বাইরে থেকে করেও এখানে দেখাতে পারবেন না। আমি এক জায়গায় নিয়ে যাব হাসপাতালের রেটই করাবেন। সেখানেই বড় ডাক্তার পাবেন, মাত্র ১শ’ টাকায় দেখে দেবেন আপনাকে। উপায় না দেখে তিনি চলে গেলেন ওই মেয়ের সঙ্গে আর বাসায় ফিরলেন সর্বস্বান্ত হয়ে। এ ছাড়া আন্তঃবিভাগে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে ডাক্তারদের ম্যানেজ করে স্যাম্পল কালেকশন করে নিয়ে যায় দালালদের আপডেট ভার্সন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ৫শ’ গজের ভেতরে কোনো ধরনের বেসরকারি হাসপাতাল ক্লিনিক ও প্রতিষ্ঠান না করতে নীতিমালা রয়েছে। এসব নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই খুমেক হাসপাতালের আশপাশ দিয়ে গড়ে উঠেছে ১৭টি প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগের সঙ্গেই কোনো চিকিৎসকের সম্পৃক্ততা নেই।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বেশিরভাগেরই কোনো ধরনের কাগজপত্র নেই। বাংলাদেশ প্যাথলজিস্ট সোসাইটির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, এসব প্রতিষ্ঠানে কোনো ডিগ্রিধারী ও মানসম্মত প্যাথলজিস্ট রিপোর্ট করতে যায় না।
খুমেক হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এটিএম মোর্শেদ বলেন হাসপাতালের সামনে চিকিৎসার নামে খোলা দোকানগুলোর কারণে দালাল নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রোগীদের খদ্দের বানিয়ে এসব প্রতিষ্ঠান হাসপাতালের বহির্বিভাগে ঘুরতে থাকে। মাত্র ১শ’ টাকায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষার-নিরীক্ষার ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে এরা। কোনো প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে কঠোরভাবে নিয়মনীতি অনুসরণ করতে স্বাস্থ্য বিভাগকে অনুরোধ জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status