প্রথম পাতা

ফের বিক্ষোভে অচল ঢাকা

স্টাফ রিপোর্টার

২০ মার্চ ২০১৯, বুধবার, ১০:০৭ পূর্বাহ্ন

সহপাঠী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ-অবরোধ -ছবি: জীবন আহমেদ

আট মাসের মাথায় ফের নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন শিক্ষার্থীরা। জাবালে নুর বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর প্রতিবাদে গড়ে ওঠা ওই আন্দোলন নাড়া দিয়েছিল দেশজুড়ে। এ আন্দোলন থামাতে দেয়া হয়েছিল নানা প্রতিশ্রুতি। নেয়া হয়েছিল নানা উদ্যোগও। কিন্তু এতে যে কাজের কাজ কিছুই হয়নি তা আট মাস পরের আরেক ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে  দেখিয়ে দিলো। দুই বাসের রেষারেষির মাঝে পড়ে মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল্‌স-এর শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর। চোখের সামনে সহপাঠীর এমন করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারেন নি তার সতীর্থরা। প্রতিবাদে ঘটনার পর থেকে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নামেন তারা। দিনভর চলা বিক্ষোভে রাজধানীর প্রায় অর্ধেক এলাকা অচল হয়ে পড়ে। দীর্ঘ যানজটে পড়ে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে লাখো মানুষকে। আন্দোলনকারীরা আগের বারের আন্দোলনের মতোই স্লোগান দিয়েছেন নিরাপদ সড়কের দাবিতে। তাদের মুখে মুখে ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান। দিনভর অবস্থান কর্মসূচির পর আজও কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

গতকাল সকাল সোয়া ৭টার দিকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ফটকের সামনের জেব্রা ক্রসিংয়ের উপর দিয়ে রাস্তা পারাপারের সময় সুপ্রভাত কোম্পানির দুই বাস প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে পিষে ফেলে বিইউপি’র ওই শিক্ষার্থীকে। ঘটনাস্থলেই আবরার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সহপাঠীরা। সঙ্গে সঙ্গেই সড়কে অবস্থান নেন তারা। কুড়িল থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত কয়েক স্তরে অবরোধ করেন বিইউপি’র শিক্ষার্থীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরো জোরালো হয় তাদের আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। সকাল দশটার পর থেকে কুড়িল চৌরাস্তা থেকে নর্দ্দা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে তাদের অবস্থান।

এসময় শিক্ষার্থীরা আট দফা দাবি উত্থাপন করেন। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে- পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা এবং বাসচালকদের প্রতি মাসে লাইসেন্স চেক করা, আটককৃত চালক ও জড়িত সবাইকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা, ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুত অপসারণ, দায়িত্ব অবহেলাকারী  প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেয়া, চলমান আইনের পরিবর্তন করে সড়ক হত্যার সঙ্গে জড়িত সকলকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা, প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রীছাউনি করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও ছাত্রদের হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) অথবা আলাদা বাস সার্ভিস চালু করা। এসব দাবি ছাড়াও শিক্ষার্থীরা মৌখিক কিছু দাবিও তুলে ধরেন আন্দোলনে। এগুলো হলো- আবরারকে চাপা দেয়া বাসের চালককে ১০ দিনের মধ্যে ফাঁসি দিতে হবে, সুপ্রভাত বাসের রুট পারমিট বাতিল, সিটিং সার্ভিস বন্ধ, স্টপেজের ব্যবস্থা করা, চালকদের ছবি ও লাইসেন্স গাড়িতে ঝোলানোর ব্যবস্থা করা, প্রতিটি জেব্রা ক্রসিংয়ে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা এবং  ট্রাফিক পুলিশের ‘দুর্নীতি’ বন্ধ করা।

তোপের মুখে মেয়র আতিক: আন্দোলন চলার একপর্যায়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম উপস্থিত হন ঘটনাস্থলে। তিনি শিক্ষার্থীদের বলেন শান্ত হতে। একই সঙ্গে তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বলেন। আতিক বলেন- তোমরা আমার সঙ্গে থাকলে আমি সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবো। বাসের মালিক ও সংশ্লিষ্টদের নিয়মের ভেতরে আনা হবে। ঢাকা সিটিতে ছয়টি কোম্পানির বাস চালানো হবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে সমাধান করবো। এসময় তিনি আরো জানান, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ফটকে একটি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে। যা নিহত আবরারের নামে নামকরণ করা হবে। তবে মেয়রের এসব আশ্বাসে শান্ত হননি শিক্ষার্থীরা। এ সময় বরং শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন আতিক। বিইউপি’র শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে পড়লে তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

শিক্ষার্থীদের ফাঁসাতে বাসে আগুন: দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে আন্দোলন চলার এক পর্যায়ে যমুনা ফিউচার পার্কের বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুপ্রভাতের একটি বাসে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। সেটি দেখে চারদিক থেকে ছুটে আসেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এসময় তারাই পানি ও বালি ছিটিয়ে বাসটির আগুন নেভান। পরে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, তাদের ফাঁসাতে ও আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতেই ওই বাসের চালক ও সহকারী আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। এরপর তারা পালিয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা আরো জানান, বাসে আগুন লাগিয়ে তাদেরকে প্রশাসনের চোখে এই আন্দোলনকে সহিংস হিসেবে চিহ্নিত করতেই চেষ্টা করেছে বাসের চালক।

ঘটনার সময় শিক্ষার্থীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। এ নিয়ে বিইউপি  ও ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তারা হাতাহাতিতেও জড়িয়ে পড়েন। পরে শ্রমিকদের আগুন লাগানোর বিষয়টি ধরা পড়লে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়।
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমর্থন: দুপুর ১টার পর থেকে বিইউপির শিক্ষার্থীদের আন্দোলন আরো জোরালো হলে তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সড়কে অবস্থান নিয়ে তারাও ওই নিরাপদ সড়ক চাই’র আন্দোলনে অংশ নেন। এমনকি আজ থেকে আহ্বান করা আন্দোলনে তারা থাকবেন বলেও আশ্বাস দেন।

এ সময় ঘটনাস্থলে নর্থ সাউথ, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ইউনাইটেডসহ বেশ কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপস্থিত হন। আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে, উই ওয়ান্ট জাস্টিজসহ বেশ কয়েকটি স্লোগানে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। সারা দিন আন্দোলন শেষে বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গতকালের কর্মসূচির ইতি টানেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী মাইশা নুর। এ সময় তিনি সারা দেশের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন ও সড়কে নেমে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের অনুরোধ করেন। এ ছাড়া মাইশা নুর বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলা এই আন্দোলনকে কেউ রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে দেখবেন না। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই আজকের মতো আন্দোলন স্থগিত করা হয়েছে। আগামী কাল সকাল থেকে আবারও  আমরা রাস্তায় নামবো।

আন্দোলন চলবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সকল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জনের অনুরোধ রইলো। সকল অভিভাবককে বলছি আমাদের সঙ্গে অংশ নিন। কারণ আজ যে ছেলেটি মারা গেছে সেও কোনো না কোনো বাবা-মায়ের সন্তান ছিল। আমাদের এই আন্দোলন চলবে। মাইশা নুর বলেন, আমরা চাই না গত বছরের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো শেষের দিকে খারাপ পরিস্থিতি হোক। যারা রাজনৈতিকভাবে আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করবে আমরা তাদেরকে চাই না। আমরা নিজেদের সুরক্ষা চাই। পুলিশ আমাদের সুরক্ষা দেবে সেটা আশা করি। আমাদের ওপর কোনো লাঠিচার্জ বা রাজনৈতিক আক্রমণ যেন না হয়। আমাদেরকে যে আশ্বাস দেয়া হয়েছে সেটার প্রতিফলন চাই।

সুপ্রভাত বাসের নিবন্ধন বাতিল: বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুর ঘটনায় গতকালই তাকে চাপা দেয়া সুপ্রভাত বাসটির নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া হয়। বিআরটিএ’র সহকারী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ার) রফিকুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক পত্রে একথা জানানো হয়। এতে বলা হয়, মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ এর ৪৩ ধারা মোতাবেক ঢাকা-মেট্রো-ব-১১-৪১৩৫ নং বাসের রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে বাতিল করা হলো।

আন্দোলন নিয়ে যা বললেন শিক্ষার্থীরা: সুপ্রভাত বাসের চাপায় আবরারের নিহত হওয়ার পরপরই  ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। বার বার একই ঘটনা ঘটছে। তবুও প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই।  সরকারেরও কোনো টনক নড়ছে না। সারা দিন আন্দোলনের মাঝে এভাবেই বলছিলেন বিইউপি ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে সড়ক অবরোধ করা শিক্ষার্থীরা। আবরারের সহপাঠী  রিমু বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের বন্ধুদের হারাচ্ছি। আমাদের দাবিগুলো কিছুতেই সরকার মানছে না। প্রশাসনের টনক নড়ছে না। সড়কে শিক্ষার্থী কেন কোনো মানুষই নিরাপদ না। ক’দিন আন্দোলন হলে এটা করবে ওটা করবে বলে জানায়। কিন্তু এরপর আবার একই হাল। আমরা সড়কে নিরাপত্তা চাই। প্রতিদিন মানুষ মরবে এটা চাই না। রাব্বী নামের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আজ আবরারকে হারিয়েছি। আমাদের মাঝ থেকে সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটি চলে গেছে। সে চলে যায়নি। তাকে খুন করা হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন আমাদের অনেক ভাইবোন বাবা মাকে খুন করা হচ্ছে। আমরা আর তা চাই না। যতক্ষণ না আমাদের দাবি বাস্তবায়ন  হবে তৎক্ষণ সড়ক ছেড়ে দেবো না। ফয়েজ উল্লাহ নামের আরেক শিক্ষার্থী জানান, সরকার ভেবেছে হেলমেটলীগ দিয়ে পেটালেই সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এবার আর থামছি না। মার খেয়ে মরে যাবো। তাও আন্দোলনে পিছপা হবো না।

দিনভর দুর্ভোগ: শিক্ষার্থীদের সারা দিন আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে সাধারণ কর্মজীবী মানুষের ওপর। একটি সড়কে যানচলাচল বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের কয়েকটি সড়কেই তীব্র যানজট শুরু হয়ে যায়। এ ছাড়া রামপুরা কিংবা বাড্ডা থেকে নদ্দা-কুড়িল হয়ে যাওয়া উত্তরা-গাজীপুরগামী অনেকে পায়ে হেঁটে খিলক্ষেত পর্যন্ত গিয়েছেন। দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে অনেককে। তবে কষ্ট ভোগ করলেও শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে কেউ কেউ সাধুবাদ জানিয়েছেন। আফরিন নাহার নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, আমার অফিস কুড়িলে। সকাল থেকেই কোনো যানবাহন নেই। বাড্ডা থেকে হেঁটেই যাচ্ছি। কষ্ট হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু আমি চাই এই আন্দোলন অব্যাহত থাকুক। শিক্ষার্থীরা এর আগেও  হামলা মামলার শিকার হয়েছে। তারপরও যেন সড়কে বিশৃঙ্খলা থামছে না। সাইদুল নামের এক গার্মেন্ট কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, কিছুদিন পর পরই এমন শিক্ষার্থী মরছে। কোনো বিচার হচ্ছে না। আজও একজন মারা গেল। আমি গাজীপুর যাবো। কুড়িল বিশ্বরোড পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। কষ্ট হলেও আমি এই আন্দোলনকে সমর্থন জানাই। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের দাবি আদায় করতে পারে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status