প্রথম পাতা
অনশনে প্রশাসন নীরব মধ্যরাতে ছাত্রীদের হেনস্তার অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার
১৫ মার্চ ২০১৯, শুক্রবার, ১০:১৬ পূর্বাহ্ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের পুনঃনির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশনে বসা রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর নবনির্বাচিত জিএস গোলাম রাব্বানীর বিরুদ্ধে। গত বুধবার গভীর রাতে এ হেনস্তার ঘটনা ঘটে। এদিকে হেনস্তার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা। আর অনশনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করেন। এসময় তিনি ছাত্রী হেনস্তাকারীদেরও বিচার দাবি করেন। পুনঃনির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশনে বসা রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রীর অভিযোগ রাতে গোলাম রাব্বানী নেতাকর্মীদের নিয়ে তাদের হুমকি-ধামকিও দেন। বুধবার গভীর রাতে রোকেয়া হলের প্রধান ফটকে এ ঘটনা ঘটে। অনশনকারী শ্রবণা শফিক দীপ্তি সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাতে গোলাম রাব্বানী নেতাকর্মীদের নিয়ে এসে ছবি দেখিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করেন। একজনকে চরিত্রহীন প্রমাণের চেষ্টা করেন। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, আমরা মদ-গাঁজা খেয়ে আন্দোলন করছি। এ ছাড়াও আমাদের চিহ্নিত করে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের হুমকি দেন তিনি।’
অনশনকারীরা হলেন- ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রাফিয়া সুলতানা, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সায়েদা আফরিন, একই বিভাগের জয়ন্তী রেজা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শ্রবণা শফিক দীপ্তি ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের প্রমি খিশা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত দেড়টার দিকে মোটরসাইকেলে করে ছাত্রলীগ শতাধিক নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে রোকেয়া হলের সামনে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানী। এসেই তিনি ছাত্রীদের হলের ফটকের বাইরে অনশন করা ও তাদের সমর্থকদের অবস্থান নিয়ে মুঠোফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে কথা বলেন।
রাব্বানী মুঠোফোনে প্রক্টরকে জানান, হলের কিছু মেয়ে মধ্যরাতে গেট খুলে বাইরে অবস্থান করে অন্য শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছেন। তিনি বলেন, ‘এরা খুব বাড়াবাড়ি করছে, স্যার। এদের সবগুলোর ফাইল দেখে চিহ্নিত করে, গার্ডিয়ান ডেকে এনে স্থায়ীভাবে একাডেমিক বহিষ্কার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খোদা হাফেজ করে দেন।’ এরপর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা অনশনকারীদের কয়েকজন সমর্থককে দেখিয়ে ছাত্রলীগ নেত্রীদের প্রশ্ন করেন, ‘রাত দুইটার দিকে বোরকা, নেকাব পরা এরা কারা? ছাত্রী সংস্থা? শিবিরের কর্মী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের অবস্থান নিষিদ্ধ।’ এরপর রাব্বানী গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে বলেন, ‘এদের ফোকাস করেন।’ রাব্বানীর এমন অভিযোগে ঘটনাস্থলে থাকা হলের হাউস টিউটর দিলারা জাহিদ, লোপা মুদ্রা, সাদিয়া নূর খান এসে তাকে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এসময় রাব্বানী বলেন, ‘এরাই ভোটের দিন ব্যালট ছিনতাই করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে দেয়নি। প্রভোস্ট ম্যামকেও লাঞ্ছিত করেছে। সবারই আন্দোলন, অনশন করার রাইট আছে।
কিন্তু রাত দুইটার দিকে হলের গেট খোলা রেখে অন্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার রাইট কারও নাই।’ এসময় বোরকা পরে মুখ ঢাকা মেয়েরা এখানে কেন? এমন প্রশ্নও করেন তিনি। এরপর গোলাম রাব্বানী উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘হলের গেট খোলা রেখে ছাত্রীদের অবস্থানের কথা শুনে অন্য শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখানে আমি আসি। এসে দেখি, কয়েকজন মদ-গাঁজা খেয়ে এখানে আন্দোলন করছে।’ এই দশ-পনেরো জনের কারণে অন্যদের ক্ষতি হলে সে দায় নেবে কে?’ বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি। এর আগে বিকাল থেকে চার দফা দাবিতে অনশন করছেন রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রী। দাবির মধ্যে রয়েছে- ডাকসু ও হল সংসদে পুনঃর্র্নিবাচন, হল প্রভোস্টের পদত্যাগ, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ এবং ছাত্রী হেনস্তাকারীদের বিচার করতে হবে-ভিপি
এদিকে পুনরায় নির্বাচন ও প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে অনশনে বসা পাঁচ অনশনকারীর সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। একইসঙ্গে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদার পদত্যাগ ও নারী হেনস্তার বিচার দাবি করেন তিনি। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে ছাত্রীদের অনশনে সংহতি জানিয়ে নুরুল হক নুর এসব কথা বলেন। এর আগে লাইব্রেরির সামনেও একই বিষয়ে কথা বলেন নুর। নুরুল হক নুর বলেন, শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে অনশন করছে তার সঙ্গে আমি সংহতি প্রকাশ করছি। আমি মনে করি রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদার পদে বহাল থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। যারা রাতে নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করার চেষ্টা করেছে প্রশাসনের অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়। নুর বলেন, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। নৈতিকতার জায়গা থেকে তিনি তার পদে থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ম্যাম যে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে ছাত্রীদের সঙ্গে এবং স্বয়ং আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন একজন শিক্ষক হিসেবে সেটি আমরা তার কাছে প্রত্যাশা করিনি। তিনি আমাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন।
সে জন্য আমরা বলেছি তিনি নৈতিকতার জায়গা থেকে তিনি তার পদে থাকতে পারেন না। তার অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত। নুর বলেন, আমি আমার বোনদের দাবির সঙ্গে সমর্থন দিয়ে বলছি- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকেও বলেছি রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষকে পদত্যাগ করতে হবে। যেহেতু তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। যেমনটি তারা কুয়েত মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। যদি প্রশাসন সেটি না করে তাহলে আমরা ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য হবো। তিনি আরো বলেন, প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাবো- ছাত্রদের দাবানল জ্বলে উঠার আগেই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে (নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে) আপনারা তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। এসময় নবনির্বাচিত ভিপি বলেন, পাঁচজন কিংবা চারজন শিক্ষার্থীও যদি অনশন করে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যায় আর অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা যে প্রতিবাদ করছে সেটি যৌক্তিক। নৈতিকভাবে আমি তাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছি। এখনো দিচ্ছি। এসময় দায়িত্ব নেয়ার বিষয়ে নুর বলেন, দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি এখনো পর্যন্ত সামনে আসেনি।
আমি আগেও বলেছি আমার একটি সংগঠন রয়েছে। তারা আমার জন্য শ্রম দিয়েছে, কাজ করেছে। অন্যান্য সহযোদ্ধা যারা আমার সঙ্গে কাজ করেছে। এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা আমাকে এতো কারচুপির পরও নির্বাচিত করেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে ইন্টারেকশান বোঝার চেষ্টা করছি। সে জায়গা থেকে তারা যদি চায় আমি ভিপির দায়িত্ব নিয়ে তাদের জন্য আন্দোলন সংগ্রামের লড়াই করি তাহলে আমি সেটি করবো। আর তারা যদি না চায় তাহলে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করবো না। অনশনরতদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘আজকে যারা আন্দোলন করছেন তাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। এর আগেও আমরা দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় হুমকি দেয়া হয়েছিলো ও হয়রানি করা হয়েছিলো। আমরা ছাত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে এর উচিত জবাব দিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলতে চাই- শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং তাদের ওপরে কোনো স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। তাহলে শিক্ষার্থীরা তা প্রতিহত করবে।
ছাত্রী হেনস্তার বিষয়ে জানেন না দাবি রোকেয়ার প্রাধ্যক্ষের
এদিকে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনে ফের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশনে বসা রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রীকে হেনস্তার বিষয়ে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেছেন, তারা হলের গেটের বাইরে গিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে হেনস্তার হওয়ার ঘটনাটি আমাদের কনসার্ন না। আমাদের কনসার্ন তাদের গেটের বাইরে থেকে হলের ভেতরে নিয়ে আসা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জিনাত হুদা এ কথা বলেন। এসময় তিনি পুনঃনির্বাচনের এখতিয়ার তার নেই বলেও মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা ছাত্রীদের হেনস্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনার বিষয়ে আমি অবগত না। কোনো হাউস টিউটরও আমাকে অবগত করেননি। রোকেয়া হল সংসদ নির্বাচনে কোনো কারচুপি হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
এমনকি ব্যালট বাক্স লুকিয়ে রাখার কোনো ঘটনাও ঘটেনি। যে তিনটি ব্যালট বাক্স পাওয়া গেছে তা বুথের মধ্যেই ছিল।
তৃতীয় দিনের মতো রাজু ভাস্কর্যে সাত শিক্ষার্থীর অনশন অব্যাহত: ‘একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশন’ ব্যানার টানিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সাত শিক্ষার্থীর অনশন অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল থেকে পুনরায় ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করছেন তারা। পুনরায় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। এই বিষয়ে অনশনকারী আল মাহমুদ তাহা বলেন, আমরা চাই ডাকসুর ঐতিহ্য টিকে থাকুক। কিন্তু যেভাবে নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে সেটা ডাকসুর ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই পুনরায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি। পুনরায় নির্বাচন না দেয়া পর্যন্ত আমাদের আমরণ অনশন চলবে। মিম আরাফাত বলেন, আমরা আমাদের দাবি আদায়ে আমরণ অনশন চালিয়ে যাবো। কারণ ১১ই মার্চ কোনো নির্বাচন হয়নি।
ছাত্রদলের সংহতি
এদিকে রাজু ভাস্কর্যে ও রোকেয়া হলের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গতকাল দুপুরে ডাকসুতে ছাত্রদল থেকে মনোনীত ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে এসে এ সংহতি জানান। এসময় মোস্তাফিজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদেরকে আমরা সবসময় শ্রদ্ধা করি। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্রদল সব সময় সোচ্চার ছিল। আগামীতেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকবে।
পুনঃনির্বাচন চায় ছাত্র সংগ্রামভুক্ত জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র মৈত্রীও:‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ডাকসু নির্বাচনের ফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়েছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদভুক্ত ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল), জাসদ ছাত্রলীগ (ইনু) ও বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে সংগঠনগুলো। এদিকে ফল ঘোষণার পরদিন থেকেই আন্দোলন করে আসছে ছাত্রদল, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, প্রগতিশীল ছাত্র জোট, স্বতন্ত্র জোটসহ নির্বাচনে অংশ নেয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। দাবি মানতে তিন দিনের আল্টিমেটামও দিয়েছেন তারা। এই বিষয়ে জাসদ ছাত্রলীগ (ইনু) সভাপতি আহসান হাবীব শামীম বলেন, এটা একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। এ ধরনের নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চায় নি। এ নির্বাচন আয়োজনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীরা আস্থা হারিয়েছে। তাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে আমরা উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছি। আশা করবো, তিনি আমাদের দাবি মেনে নেবেন।
অনশনকারীরা হলেন- ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রাফিয়া সুলতানা, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সায়েদা আফরিন, একই বিভাগের জয়ন্তী রেজা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শ্রবণা শফিক দীপ্তি ও ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের প্রমি খিশা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত দেড়টার দিকে মোটরসাইকেলে করে ছাত্রলীগ শতাধিক নেতাকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে রোকেয়া হলের সামনে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানী। এসেই তিনি ছাত্রীদের হলের ফটকের বাইরে অনশন করা ও তাদের সমর্থকদের অবস্থান নিয়ে মুঠোফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে কথা বলেন।
রাব্বানী মুঠোফোনে প্রক্টরকে জানান, হলের কিছু মেয়ে মধ্যরাতে গেট খুলে বাইরে অবস্থান করে অন্য শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছেন। তিনি বলেন, ‘এরা খুব বাড়াবাড়ি করছে, স্যার। এদের সবগুলোর ফাইল দেখে চিহ্নিত করে, গার্ডিয়ান ডেকে এনে স্থায়ীভাবে একাডেমিক বহিষ্কার করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খোদা হাফেজ করে দেন।’ এরপর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক হলের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা অনশনকারীদের কয়েকজন সমর্থককে দেখিয়ে ছাত্রলীগ নেত্রীদের প্রশ্ন করেন, ‘রাত দুইটার দিকে বোরকা, নেকাব পরা এরা কারা? ছাত্রী সংস্থা? শিবিরের কর্মী? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের অবস্থান নিষিদ্ধ।’ এরপর রাব্বানী গণমাধ্যমকর্মীদের ডেকে বলেন, ‘এদের ফোকাস করেন।’ রাব্বানীর এমন অভিযোগে ঘটনাস্থলে থাকা হলের হাউস টিউটর দিলারা জাহিদ, লোপা মুদ্রা, সাদিয়া নূর খান এসে তাকে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এসময় রাব্বানী বলেন, ‘এরাই ভোটের দিন ব্যালট ছিনতাই করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোট দিতে দেয়নি। প্রভোস্ট ম্যামকেও লাঞ্ছিত করেছে। সবারই আন্দোলন, অনশন করার রাইট আছে।
কিন্তু রাত দুইটার দিকে হলের গেট খোলা রেখে অন্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার রাইট কারও নাই।’ এসময় বোরকা পরে মুখ ঢাকা মেয়েরা এখানে কেন? এমন প্রশ্নও করেন তিনি। এরপর গোলাম রাব্বানী উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘হলের গেট খোলা রেখে ছাত্রীদের অবস্থানের কথা শুনে অন্য শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখানে আমি আসি। এসে দেখি, কয়েকজন মদ-গাঁজা খেয়ে এখানে আন্দোলন করছে।’ এই দশ-পনেরো জনের কারণে অন্যদের ক্ষতি হলে সে দায় নেবে কে?’ বলেও প্রশ্ন রাখেন তিনি। এর আগে বিকাল থেকে চার দফা দাবিতে অনশন করছেন রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রী। দাবির মধ্যে রয়েছে- ডাকসু ও হল সংসদে পুনঃর্র্নিবাচন, হল প্রভোস্টের পদত্যাগ, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ এবং ছাত্রী হেনস্তাকারীদের বিচার করতে হবে-ভিপি
এদিকে পুনরায় নির্বাচন ও প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে অনশনে বসা পাঁচ অনশনকারীর সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর। একইসঙ্গে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জিনাত হুদার পদত্যাগ ও নারী হেনস্তার বিচার দাবি করেন তিনি। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে ছাত্রীদের অনশনে সংহতি জানিয়ে নুরুল হক নুর এসব কথা বলেন। এর আগে লাইব্রেরির সামনেও একই বিষয়ে কথা বলেন নুর। নুরুল হক নুর বলেন, শিক্ষার্থীরা যে দাবিতে অনশন করছে তার সঙ্গে আমি সংহতি প্রকাশ করছি। আমি মনে করি রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ জিনাত হুদার পদে বহাল থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। যারা রাতে নারী শিক্ষার্থীদের হেনস্তা করার চেষ্টা করেছে প্রশাসনের অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানায়। নুর বলেন, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষকে অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। নৈতিকতার জায়গা থেকে তিনি তার পদে থাকতে পারেন না। তিনি বলেন, রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ম্যাম যে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে ছাত্রীদের সঙ্গে এবং স্বয়ং আমার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন একজন শিক্ষক হিসেবে সেটি আমরা তার কাছে প্রত্যাশা করিনি। তিনি আমাদের দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছেন।
সে জন্য আমরা বলেছি তিনি নৈতিকতার জায়গা থেকে তিনি তার পদে থাকতে পারেন না। তার অবশ্যই পদত্যাগ করা উচিত। নুর বলেন, আমি আমার বোনদের দাবির সঙ্গে সমর্থন দিয়ে বলছি- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকেও বলেছি রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষকে পদত্যাগ করতে হবে। যেহেতু তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এসেছে। যেমনটি তারা কুয়েত মৈত্রী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। যদি প্রশাসন সেটি না করে তাহলে আমরা ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করতে বাধ্য হবো। তিনি আরো বলেন, প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাবো- ছাত্রদের দাবানল জ্বলে উঠার আগেই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে (নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে) আপনারা তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। এসময় নবনির্বাচিত ভিপি বলেন, পাঁচজন কিংবা চারজন শিক্ষার্থীও যদি অনশন করে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্যায় আর অনিয়মের বিরুদ্ধে তারা যে প্রতিবাদ করছে সেটি যৌক্তিক। নৈতিকভাবে আমি তাদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছি। এখনো দিচ্ছি। এসময় দায়িত্ব নেয়ার বিষয়ে নুর বলেন, দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি এখনো পর্যন্ত সামনে আসেনি।
আমি আগেও বলেছি আমার একটি সংগঠন রয়েছে। তারা আমার জন্য শ্রম দিয়েছে, কাজ করেছে। অন্যান্য সহযোদ্ধা যারা আমার সঙ্গে কাজ করেছে। এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা আমাকে এতো কারচুপির পরও নির্বাচিত করেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে ইন্টারেকশান বোঝার চেষ্টা করছি। সে জায়গা থেকে তারা যদি চায় আমি ভিপির দায়িত্ব নিয়ে তাদের জন্য আন্দোলন সংগ্রামের লড়াই করি তাহলে আমি সেটি করবো। আর তারা যদি না চায় তাহলে আমি দায়িত্ব গ্রহণ করবো না। অনশনরতদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, ‘আজকে যারা আন্দোলন করছেন তাদেরকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। এর আগেও আমরা দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় হুমকি দেয়া হয়েছিলো ও হয়রানি করা হয়েছিলো। আমরা ছাত্রদেরকে সঙ্গে নিয়ে এর উচিত জবাব দিয়েছি। তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলতে চাই- শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং তাদের ওপরে কোনো স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন না। তাহলে শিক্ষার্থীরা তা প্রতিহত করবে।
ছাত্রী হেনস্তার বিষয়ে জানেন না দাবি রোকেয়ার প্রাধ্যক্ষের
এদিকে অনিয়ম-কারচুপির অভিযোগ এনে ফের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশনে বসা রোকেয়া হলের পাঁচ ছাত্রীকে হেনস্তার বিষয়ে হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. জিনাত হুদা বলেছেন, তারা হলের গেটের বাইরে গিয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে হেনস্তার হওয়ার ঘটনাটি আমাদের কনসার্ন না। আমাদের কনসার্ন তাদের গেটের বাইরে থেকে হলের ভেতরে নিয়ে আসা। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার্স ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে জিনাত হুদা এ কথা বলেন। এসময় তিনি পুনঃনির্বাচনের এখতিয়ার তার নেই বলেও মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা ছাত্রীদের হেনস্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ঘটনার বিষয়ে আমি অবগত না। কোনো হাউস টিউটরও আমাকে অবগত করেননি। রোকেয়া হল সংসদ নির্বাচনে কোনো কারচুপি হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি।
এমনকি ব্যালট বাক্স লুকিয়ে রাখার কোনো ঘটনাও ঘটেনি। যে তিনটি ব্যালট বাক্স পাওয়া গেছে তা বুথের মধ্যেই ছিল।
তৃতীয় দিনের মতো রাজু ভাস্কর্যে সাত শিক্ষার্থীর অনশন অব্যাহত: ‘একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আমরণ অনশন’ ব্যানার টানিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সাত শিক্ষার্থীর অনশন অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার বিকাল থেকে পুনরায় ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে অনশন করছেন তারা। পুনরায় নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। এই বিষয়ে অনশনকারী আল মাহমুদ তাহা বলেন, আমরা চাই ডাকসুর ঐতিহ্য টিকে থাকুক। কিন্তু যেভাবে নির্বাচনে কারচুপি করা হয়েছে সেটা ডাকসুর ঐতিহ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই পুনরায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি। পুনরায় নির্বাচন না দেয়া পর্যন্ত আমাদের আমরণ অনশন চলবে। মিম আরাফাত বলেন, আমরা আমাদের দাবি আদায়ে আমরণ অনশন চালিয়ে যাবো। কারণ ১১ই মার্চ কোনো নির্বাচন হয়নি।
ছাত্রদলের সংহতি
এদিকে রাজু ভাস্কর্যে ও রোকেয়া হলের সামনে অনশনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। গতকাল দুপুরে ডাকসুতে ছাত্রদল থেকে মনোনীত ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান ও জিএস প্রার্থী আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক নেতাকর্মীদের সঙ্গে এসে এ সংহতি জানান। এসময় মোস্তাফিজ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদেরকে আমরা সবসময় শ্রদ্ধা করি। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্রদল সব সময় সোচ্চার ছিল। আগামীতেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে থাকবে।
পুনঃনির্বাচন চায় ছাত্র সংগ্রামভুক্ত জাসদ ছাত্রলীগ ও ছাত্র মৈত্রীও:‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ডাকসু নির্বাচনের ফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন দেয়ার দাবি জানিয়েছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদভুক্ত ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ (বিসিএল), জাসদ ছাত্রলীগ (ইনু) ও বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী। পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে সংগঠনগুলো। এদিকে ফল ঘোষণার পরদিন থেকেই আন্দোলন করে আসছে ছাত্রদল, বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, প্রগতিশীল ছাত্র জোট, স্বতন্ত্র জোটসহ নির্বাচনে অংশ নেয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। দাবি মানতে তিন দিনের আল্টিমেটামও দিয়েছেন তারা। এই বিষয়ে জাসদ ছাত্রলীগ (ইনু) সভাপতি আহসান হাবীব শামীম বলেন, এটা একটা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন। এ ধরনের নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা চায় নি। এ নির্বাচন আয়োজনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি শিক্ষার্থীরা আস্থা হারিয়েছে। তাই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে আমরা উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছি। আশা করবো, তিনি আমাদের দাবি মেনে নেবেন।