প্রথম পাতা

লাশটাও যদি পাওয়া যায়

জিয়া চৌধুরী

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১০:১১ পূর্বাহ্ন

মাকে খুঁজছে সানিন। ডিএনএ নমুনা দিলো ঢাকা মেডিকেলে

চুড়িহাট্টা থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ। অনবরত ছুটে চলেছে ইসরাফিল। কোলে ছোট্ট ভাগ্নি সানিন। মর্গে পড়ে থাকা লাশগুলো দেখছে। বার্ন ইউনিটে ছুটে যাচ্ছে। অন্তত লাশটাও যদি পাওয়া যায়। সানিন মামার কাছে আবদার করছে আজ কিন্তু মাকে  না নিয়ে যাবো না। মামা ইসরাফিলের বুক ফাটা কান্না থামছে না। ভাগিনি সানিনকে কি বলবে? চকবাজারের চুড়িহাট্টায় বুধবার রাতের অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে মাকে খুঁজছে সে। মামার কোলে চড়ে পাঁচ বছরের ছোট্ট সানিন এসেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। তার প্রশ্ন, মা তো একটু বাসার নিচে গিয়েছিল। তাহলে এখনো ফিরল না কেন? উম্মে হাবিবা বেগম শিলার লাশ শনাক্ত করতে মেয়ে সানিনের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা নিয়েছে সিআইডির ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ দল।

নমুনা নিতে গেলেও সানিনের একই প্রশ্ন, মাকে কি পাওয়া যাবে? আবারো প্রশ্ন আমার কি ব্যথা লাগবে? পরে অবশ্য সানিনের কাছ থেকে শুধু লালা সংগ্রহ করে সিআইডি। সানিনের মামা ইসরাফিল জানান, চকবাজারের ঘটনাস্থল থেকে মাত্র দুইশ’ গজ দূরেই সানিনদের বাসা। সেদিন রাতে সানিনের জন্য ওষুধ আনতে বাসা থেকে বের হন মা উম্মে হাবিবা বেগম শিলা। বাসার কাছের হায়দার মেডিকেল ফার্মেসি থেকেই নিয়মিত ওষুধ কিনতেন তারা। সেদিনও গিয়েছিলেন হায়দার মেডিকেলে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ছেলের ওষুধ নিয়ে তার আর বাসায় ফেরা হয়নি। শিলার বোনের স্বামী মো. বেলাল হোসেন জানান, বুধবার রাতে সানিনের বাবা মোহাম্মদ সুমন তার দোকানে ছিলেন। সানিন একটু অসুস্থ হওয়ায় তার জন্য ওষুধ আনতে চারতলার বাসার নিচে যায় তার মা শিলা।

এ সময় সানিন ও তার পাঁচ মাসের সহোদরকে বাসায় বোনের কাছে রেখে যান তিনি। আগুন শিলাদের বাসা অবধি না পৌঁছলেও সানিনের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেছে তার মাকে। মোহাম্মদ সুমন হারিয়েছেন তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে। মর্গের সামনে সুমন শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়েই ছিলেন। এতকিছুর ভিড়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। সানিনের মামা ইসরাফিল বলেন, ওষুধ আনতে না গেলে হয়তো শিলা এভাবে হারিয়ে যেতো না। তাকে ফিরে পাবার আশা আমাদের নেই, এখন মরদেহটা খুঁজে পেলেও শান্তি। এতো গেল ছোট্ট সানিনের মাকে খোঁজার কথা। বাবা মোহাম্মদ জাফরকে (৪৩) খুঁজতে মর্গে আসেন দুই সহোদর মোহাম্মদ রাজু ও মোহাম্মদ সাদিক। তারা থাকতেন পুরান ঢাকার সাবরাজা শুকু মিয়ার গলি এলাকায়। চকবাজারে মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগ ও প্লাস্টিকের জিনিস কেনাবেচার কাজ করতেন জাফর। বুধরাত রাত থেকে জাফর নিখোঁজ থাকায় শেষমেষ তার ছেলেরা মর্গে আসেন। সব মরদেহ দেখেও চিহ্নিত করতে পারেননি বাবাকে। বাবার লাশ খুঁজে পেতে সিআইডির কাছে রক্তের নমুনা দেন দুই ভাই রাজু ও সাকিব।

মোহাম্মদ রাজু জানান, ঘটনার সময় শার্ট ও লুঙ্গি পরা ছিলেন তার বাবা। বিকালেই বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, যাবার সময় রাতে বাসায় ফিরে খাবার কথাও বলে গেছেন। পরিবারের সঙ্গে রাতের খাওয়াটা আর হলো না মোহাম্মদ জাফরের। তার ছেলেরাও আজ দু’দিন হলো অনেকটা না খেয়েই আছেন। হাসপাতাল, মর্গ আর চকবাজার এলাকায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন জন্মদাতা পিতাকে। সালেহ মোহাম্মদ লিপু ও সোনিয়া জাহান দম্পতির কাহিনী আরো করুণ। কেরানীগঞ্জে ঈগলু আইসক্রিমের পরিবেশক ছিলেন সালেহ মোহাম্মদ। আর স্ত্রী সোনিয়া ছিলেন পুরান ঢাকার আশিক টাওয়ারের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা। বুধবারের আগুনে এই দু’জনের সঙ্গে প্রাণ গেছে তাদের আট বছরের একমাত্র ছেলে আপতাহিরও। সবে মাত্র ১৫ দিন হলো লিপু ও সোনিয়া চকবাজার ঈদগাহ এলাকায় বাসা নিয়েছেন। এর আগে থাকতেন লালবাগে। সোনিয়ার বড় ভাই আনোয়ার হোসেন বলেন, আমার বোন ইডেন কলেজে পড়াশোনা করেছে। লিপুর সঙ্গে দশ বছরের সংসার জীবন তাদের।

আট বছরের ছেলে আপতাহির পড়তো বকশীবাজারের বীকন স্কুলে। কেরানীগঞ্জে কাজ করায় প্রতিদিনই রাতে সোনিয়ার অফিস থেকে তাকে নিয়ে রিকশায় বাসায় ফিরতো লিপু। ঘটনার দিন রাতে লিপু নৌকায় করে কেরানীগঞ্জ থেকে এপারে আসে। মায়ের অফিসেই ওই সময় বাবার জন্য অপেক্ষা করছিল আপতাহির। বাবা আসলে সবাই মিলে একসঙ্গে বাসায় যাবে। বাড়িতে সেদিন রান্না না হওয়ায় পছন্দের দোকান থেকে বিরিয়ানি কিনে নেবার কথা ছিল তাদের। আশিক টাওয়ারে পৌঁছানোর পর স্ত্রী সোনিয়া ও ছেলে আপতাহিরকে নিয়ে রিকশায় করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয় লিপু। আগুন লাগার ৪-৫ মিনিট আগে উর্দু রোডের দিকে যায় তারা। এ সময় আমাদের সঙ্গে লিপুর কথা হয়।

এরপর থেকে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ীর মির্জাগঞ্জের রাহেলা বেগম এখনো জানেন না তার ছেলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু’র (৪০) করুণ পরিণতির কথা। তিনি শুধু টিভিতে দেখেছেন পুরান ঢাকার চকবাজারে আগুন লেগেছে। এরপর থেকে ছেলেকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে মায়ের মন। মায়ের ছটফটানিতে ইতালি থেকে একদিনের নোটিশে চলে এসেছেন আনোয়ারের আরেক ভাই শাহজাহান ফিরোজ। বড় ভাই সাজ্জাদ হোসেন মর্গে এসেছেন ভাই আনোয়ারকে খুঁজতে। পুরান ঢাকায় বড় ভাইয়ের দোকানে কাজ করতো আনোয়ার। দুই ভাই একসঙ্গে বাংলাদেশে ল কলেজে পড়তেন আইন বিষয়ে। সাজ্জাদ হোসেন বলেন, আমার ভাই সব সময় তার সঙ্গে ল কলেজের আইডি কার্ডটা রাখতো। আমি প্রতিটা লাশ তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোথাও আমার ভাইকে খুঁজে পাইনি।

আমরা আনোয়ারের ডেডবডিটা হলেও চাই। তাকে হারাতে চাই না। নোয়াখালীতে গ্রামের বাড়ি হলেও স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ১৮ নম্বর নন্দকুমার দত্ত রোডে থাকতেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ছয় বছরের ছেলে মাহী বি চৌধুরী ও পাঁচ বছরের মেয়ে সানজিদা বাবার ফেরার অপেক্ষায় এখনো কষ্টের প্রহর গুনছে। গতকাল রাতে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৪৬ জনের মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে বলে জানায় ঢাকা জেলা প্রশাসন। বাকি ২১ জনের মরদেহ শনাক্ত না হওয়ায় আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলে জানিয়েছেন সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন। এসব নমুনা সংগ্রহের পর মরদেহ শনাক্ত করতে প্রায় চার মাস লাগতে পারে বলে জানান সিআইডির এই কর্মকর্তা। গতকাল রাত পর্যন্ত মোট ১৭ জনের পরিবারের সদস্যদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে সিআইডি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status