প্রথম পাতা

নাটেশ্বরের ঘরে ঘরে কান্না

নাসির উদ্দিন বাদল, নোয়াখালী থেকে

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

রাজধানীর চকবাজারে লাগা আগুনে শোকের ঢেউ গিয়ে আছড়ে পড়েছে নোয়াখালীর নাটেশ্বরে। এখানকার ঘরে ঘরে চলছে কান্না । শুধু তাই নয়, শোকে আচ্ছন্ন নোয়াখালীর ৪ উপজেলা। ওই ঘটনায় নোয়াখালীর ৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর আচমকা এমন বেদনায় শোকের বন্যা বইছে সর্বত্র। বুকফাটা কান্না ও আর্তনাদে ভাসছে গোটা জেলা। নিহতদের অনেককে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়েছে। অনেক পরিবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে দিশাহারা। চকবাজার ট্র্যাজেডিতে নিহত নোয়াখালীর নাটেশ্বরের ৪৮ পরিবারে চলছে শোকের মাতম। একের পর এক বেরিয়ে আসছে মর্মান্তিক ঘটনার গল্পগুলো। মায়ের কোলে শিশুর মৃত্যুু, ২ ভাইয়ের বুকে নিহত ৩ বছরের শিশু, গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর মৃত্যু। বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। ঠিক তার আধা ঘণ্টা আগে রাত ১০টার দিকে চা খেয়ে, পানি নিয়ে বাবাকে বাড়ি ফিরতে বলেছিলেন দুই ছেলে। এ জন্য বাবাকে কিছু টাকাও দেন ছেলেরা।

বাবাও ছেলেদের বলেন, ‘দোকান বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসতে।’ বাবা মো. শাহবুল্লাহ বাড়ি ফিরলেও দুই ছেলে মাসুদ রানা (৩৫) ও মাহবুর রহমান রাজু (২৮) আর বাড়ি ফেরেনি। কথাবার্তা শেষে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা বাজারে ছেলেদের দোকান এস আর টেলিকম থেকে অল্প দূরে যেতেই বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় দুই ছেলের। দুর্ঘটনা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কে বি রুদ্র রোডের ১৮-২০ নম্বর বাসায় ফিরে আসা বাবা মো. শাহবুল্লাহর কান্না থামছে না। বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার ছেলেগো আমি দেশে নিয়া যামু, তাগো লগে আমি শুমু। বাসায় আসা আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন শাহবুল্লাহকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। শাহবুল্লাহ বলেন, ‘দোকান থেকে বেরিয়ে অল্প একটু আসতেই শব্দ শুনেছি। আমি আর ওইদিকে যাইতে পারিনি। পুরা রাস্তায় আগুন।

আমার বাবারা আগুনে....।’ প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল আমিন স্বপন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা ছাদ থেকে রানা আর রাজুকে শাটার নামিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে যেতে দেখেছি। ওইখানেই তাদের মৃত্যু হয়।’ মাসুদ রানার একমাত্র সন্তান বাবা হারা হয়েছে। গত ২৮শে জানুয়ারি অনুষ্ঠান করে বিয়ে করা রাজুর স্ত্রীর মুখেও কোনো কথা নেই। রাজু-রানার বাড়ি লোকে পূর্ণ, কিন্তু কান্না ছাড়া এখন আর সেখানে কিছু নেই। বাড়ির একপাশে রানা-রাজুর মা, তাদের স্ত্রী ও সন্তানের কান্না; অন্য পাশে বাবার আহাজারি। অনবরত বিলাপ করে চলা মো. শাহবুল্লাহর কণ্ঠে এই কথাগুলোই ঘুরে ফিরে আসছিল- ‘বাবা, আমার দুই ছেলে নাই। বাবা, বাবারে...। রানা, রানারে? রাজু, রাজুরে? বাবারে, আমার চন্দ্র-সূর্য হারাইয়া ফেলাইছি। আমার চন্দ্রও ডুবে গেছে, সূর্যও ডুবে গেছে আমি অন্ধ হয়ে গেছি। আগুনে কর্মজীবী দুই ছেলের মৃত্যুর পর পড়ুয়া ছোট ছেলে খলিলুর রহমান মিরাজই এখন পরিবারের একমাত্র সম্বল। কিন্তু তারাতো কেমিক্যাল বিক্রির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাই ক্ষণে ক্ষণেই বিলাপ করে উঠছিলেন শাহবুল্লাহ, ‘আমার ছেলে তো কোনো কেমিক্যাল বিক্রি করে না।

চকবাজারে ব্যবসা করতেন ৪ বন্ধু। সবারই বাড়ি নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে। ব্যবসার কাজ সেরে প্রতি রাতে একসঙ্গে কিছু সময় আড্ডা দিয়ে তারপর বাসায় ফিরতেন। কিন্তু গত বুধবার রাতে আড্ডায় বসলেও আর বাসায় ফেরা হয়নি তাদের। ভয়াবহ আগুন কেড়ে নিয়েছে এই ৪ বন্ধুর জীবন। জানা যায়, চকবাজারে পারিবারিক ওষুধের ব্যবসা ছিল মঞ্জুর। চুড়িহাট্টা জামে মসজিদের পাশে মঞ্জুর ওষুধের দোকানের নাম ‘হায়দার মেডিকো’। পাশেই ইমিটেশন গয়নার ব্যবসা হীরার। আনোয়ারের ছিল ব্যাগের ব্যবসা। আর নাসিরের প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবসা। প্রতি রাতেই কাজ শেষে রাত ১০টার দিকে হায়দার মেডিকোতে এসে বসতেন তারা। একসঙ্গে কিছু সময় গল্পগুজব করে নিজ বাসায় ফিরে যেতেন।

বুধবার রাতেও একসঙ্গে দেখা গেছে তাদের। মঞ্জুর ভাই লিটন জানান, বিকালেই ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয়। প্রতি রাতে ৪ বন্ধু মিলে ফার্মেসিতে আড্ডা দিতেন। বুধবারও তারা আড্ডায় মিলিত হন। আগুন লাগার পর তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাত ৩টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলে হায়দার মেডিকোর ভেতরে পাওয়া যায় পোড়া ৪টি মাথার খুলি। যেহেতু তারা প্রতি রাতে এখানে আড্ডা দিতেন, সেহেতু চারটি খুলিই বলে দিচ্ছে, এগুলো তাদেরই।

বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে এই ৪ বন্ধুর কথা স্মরণ করছিলেন মাহমুদুল হক নামের এক যুবক। তার বাড়িও নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলায়। ওই ৪ বন্ধুর মধ্যে হীরা ও নাসির আত্মীয় এবং স্কুলের সহপাঠী ছিলেন। নাটেশ্বরে আবুল খায়ের উচ্চ বিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়াশোনা করেছেন তারা। রাজধানীর চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের মধ্যে ৩৪ জন নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার, বেগমগঞ্জ উপজেলার ২ জন, কোম্পানীগঞ্জের ৯ জন, হাতিয়া উপজেলার ৩ জনসহ মোট ৪৮ জন নোয়াখালীর। রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টির অগ্নিকাণ্ডে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির বিভিন্ন ইউনিয়নের নিহতদের মধ্যে ১১ জনের লাশের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। শুক্রবার সকালে ইউপির বিভিন্ন স্থানে জানাজা শেষে নিজ কবরস্থানে তাদের দাফন সম্পন্ন হয়।

নিহতদের স্বজনরা জানান, অগ্নিকাণ্ডে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার নিহতদের মধ্যে মোট ১১ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। নিহতরা হলেন উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের ঘোষকামতা গ্রামের খাসের বাড়ির সাহেব আলীর দুই ছেলে মাসুদ রানা (৩০) ও মাহাবুবুর রহমান রাজু (২৮), পশ্চিম নাটেশ্বর গ্রামের মিয়ন হাজী বাড়ির মৃত ভুলু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী হোসেন (৫৫), নাটেশ্বর গ্রামের সৈয়দ আহমদের ছেলে হেলাল উদ্দিন, মমিন উল্যার ছেলে শাহাদাত হোসেন হীরা (২৭), মৃত গাউছ আলমের ছেলে নাছির উদ্দিন (২৯), মধ্য নাটেশ্বর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মোল্লা বাড়ির সিদ্দিকুল্লাহ ও পার্শ্ববর্তী বারগাঁও ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে আনোয়ার, বেগমগঞ্জ উপজেলার মুজাহিদপুর গ্রামের কামাল হোসেন, ৪নং আলাইয়াপুর ইউনিয়নের হরি বল্লবপুর ভূঁঞা বাড়ির চকবারের জুতা ব্যবসায়ী মোশাররফ হোসেন বাবু ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরএলাহী গ্রামের জসিম উদ্দিন।

নাটেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির হোসেন খোকন বলেন, নিহতদের মধ্যে শুক্রবার সকাল ৮টায় পূর্ব নাটেশ্বর গ্রামের হেলাল উদ্দিনের, ৯টায় ঘোষকামতা গ্রামের ২ সহোদর মাসুদ রানা ও মাহাবুবুর রহমান রাজুর, সাড়ে ৯টায় নাছির উদ্দিনের, ১০টায় শাহাদাত হোসেন হীরার, সাড়ে ১০টায় সিদ্দিকুল্লাহর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এর আগে বৃহস্পতিবার রাত ৩টায় পশ্চিম নাটেশ্বর গ্রামের মৃত ভুলু মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী হোসেনের দাফন সম্পন্ন হয়। একইদিন সকাল সাড়ে ৮টায় অম্বরনগর ইউনিয়নের ওয়াসেকপুর গ্রামের আবদুর রহিম ও বারগাঁও ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে আনোয়ার এর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। তাদের মৃত্যুর খবর এলাকায় পৌঁছলে স্বজনের কান্নাকাটি ও আহজারিতে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। খবর পেয়ে এলাকাবাসী ছুটে যায় নিহতদের বাড়িতে। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। নাটেশ্বর জুড়ে চলছে ঘরে ঘরে কান্না।

এলাকাবাসী জানান, শুধু নাটেশ্বর ইউনিয়নের কয়েকশ’ লোক ঢাকার চকবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যবসা বাণিজ্য ও বসবাস করে আসছেন। গতকাল পর্যন্ত অনেকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তাদের আশঙ্কা এলাকার অনেকে অগ্নিকাণ্ডে হতাহত হয়েছেন। ঢাকাস্থ চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সবার প্রতি গভীর শোক ও সহানুভূতি এবং বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন কোম্পানীগঞ্জ আসনের এমপি, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সেনবাগ আসনের এমপি আলহাজ মোরশেদ আলম, বেগমগঞ্জ আসনের এমপি আলহাজ মামুনুর রশিদ কিরণ, হাতিয়া আসনের এমপি আলহাজ আয়েশা ফেরদৌস আলী ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ এফসিএ ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও তমা গ্রুপের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ভূইয়া মানিক।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status