শেষের পাতা

পুরান ঢাকায় মরণফাঁদ

গা ঢাকা দিয়েছেন গোডাউন মালিকরা

মারুফ কিবরিয়া

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:৫৯ পূর্বাহ্ন

রাজধানীর পুরান ঢাকা যেন এক মরণকুণ্ডলী। আর একেকটি গলি যেন একেকটি মরণফাঁদ। অলিগলির কমবেশি প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে কেমিক্যাল গোডাউন। যা বছরের পর বছর ভাড়া দিয়ে রেখেছেন বাড়ির মালিকরা। এই বিপজ্জনক কেমিক্যাল গোডাউন থেকে যেকোনো সময় ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। যা এরই মধ্যে দুইবার ঘটে গেছে। তাতেও টনক নড়েনি কারো। প্রশাসন বারবার নির্দেশ দিলেও তা মানা হচ্ছে না। বরং দিনের পর দিন কেমিক্যালের গোডাউন স্থাপন করা হচ্ছে পুরান ঢাকার একাধিক স্থানে। তবে বুধবার রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন গোডাউনের মালিকরা।

গতকাল রাজধানীর নিমতলী, লালবাগ, ইসলামপুর, ইসলামবাগ, শহীদনগর, আরমানিটোলা, বাবুবাজার, মিটফোর্ড, চকবাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এসব এলাকার কমবেশি প্রতিটি বাড়িতেই একটি করে  কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। যা বসবাসরত মানুষের জন্য বড় হুমকির কারণ। বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাসাবাড়িতে মানুষ খুব ভয়ের মধ্যে থাকে। আগুন লাগলে এই কেমিক্যাল বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যা গত বুধবার চুড়িহাট্টায় হয়েছে। ঘটনার পর থেকে এসব এলাকায় আতঙ্ক আরো বেড়ে গেছে। গতকাল সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি কেমিক্যাল গোডাউনে তালা লাগানো। অগ্নিকাণ্ডের পর পর কাজ বন্ধ রেখে মালিকরা গা-ঢাকা দিয়েছেন। এসব গুদামে রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল ইত্যাদি। আগুনের সংস্পর্শে এলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে এসব রাসায়নিক পদার্থ
চক বাজারের উর্দু রোডের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। আমার জন্ম এখানেই। এই রোডের অনেক বাড়িতেই কেমিক্যাল গোডাউন আছে।

আমি নিজেই জানি। কেউ মুখ খোলে না ভয়ে। এরা অনেক প্রভাবশালী। কিন্তু আমরা তো সারাক্ষণ আতঙ্কের মধ্যে থাকি। যেকোনো সময় আগুন লাগলে এসব কেমিক্যাল থেকে আগুন দ্রুত ছড়াতে পারে। তিনি বলেন, চুড়িহাট্টা থেকে এই রাস্তাটা বেশি দূরের না। ওই আগুন যদি আমাদের গলিতে আসতো তাহলে আমরা কেউ জীবিত থাকতাম না। উর্দু রোড ও চুড়িহাট্টার কয়েকটি গলি ঘুরে দেখা যায়, এখানকার বেশির ভাগ বাড়ির প্রধান ফটক তালা লাগানো। মানুষ থাকার জন্য বাড়ি নির্মাণ করলেও সেখানে ভাড়া দিয়ে রাখা হয়েছে কেমিক্যালের গোডাউন। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব বাড়ির মালিকরা মানুষ থাকার জন্য আগে ভাড়া দিতেন। এখনো কিছু কিছু ফ্ল্যাটে মানুষ থাকে। তবে নিচ তলা ও দোতলা বেশিরভাগই কেমিক্যালের গোডাউন। বাড়ির মালিকরা অনেকে ভাড়া দিয়ে লন্ডনে থাকেন। কেউ বা গুলশান, বনানীতে। উর্দু রোডের ১৪/এ নং বাড়ির নিচ তলায় একটি কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে। তবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বাড়ির মালিক। তার নাম জানতে চাইলেও বলতে চাননি। ওই বাড়ির মালিক বলেন, আমার এখানে কোনো কেমিক্যাল গোডাউন নাই। নিচের এটা প্রিন্টিং প্রেসকে ভাড়া দিয়ে রাখছি। খুলে দেখতে চাইলে তিনি বলেন, এখন তো খোলা যাবে না। আপনাকে পরে আসতে হবে।

নিমতলীর স্বপ্না নামের এক বাসিন্দা জানান, আমরা সবসময় ভয়ে থাকি। এর আগে এখানে ভয়াবহ আগুন লাগছে। পরশু চকবাজারে। পুরান ঢাকার এই এলাকাগুলাতে প্রচুর গুদাম আছে। এর মধ্যে মানুষও থাকে। কিন্তু সরকার কোনো নজর দেয় না। এইসব কেমিক্যাল গুদামে আগুন লাগলে কেউ বাঁচে না। আমরা সবসময় ঝুঁকির মধ্যে আছি। নিমতলীর কয়েকটি গলি ঘুরে দেখা যায়, এখানেও  আবাসিক ভবনে স্থাপন করা আছে কেমিক্যাল গোডাউন। বাসিন্দারা জানান, বুধবার রাতে চকবাজারের ঘটনার পর থেকে তারা আর কেউ আসছে না। সবাই পালিয়ে গেছে। তারা আরো জানান, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে আবার এসে কাজ শুরু করবে।

এখন আপাতত গা-ঢাকা দিয়ে আছে। একই অবস্থা দেখা গেছে ইসলাম বাগ, শহীদ নগর, বাবুবাজার ও মিটফোর্ড রোডে। এখানেও অনেক আবাসিক ভবনে রয়েছে কেমিক্যালের গুদাম। যেখানে একেকটি ভবনে বাস করছেন শতাধিক মানুষ। এই ভবনগুলো কোনো কোনোটি আবার খুব সরু গলির মধ্যেও অবস্থান করছে। যেকোনো দুর্ঘটনা হলে মুহূর্তেই সব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বাবুবাজারের ওমর ফারুক নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমি মেডিসিনের ব্যবসা করি। কিছুদূর গেলে দেখতে পাবেন অনেক কেমিক্যালের দোকান। এগুলো খুব ভয়ঙ্কর। এসব এলাকায় কেমিক্যালের কাজ করা ঠিক না। আমরা অনেকবার সিটি করপোরেশনে জানাইছি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

এদিকে চকবাজারের আগুনে দগ্ধদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে দেখতে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পুরান ঢাকা থেকে সব ধরনের কেমিক্যালের গোডাউন সরানো হবে। তিনি বলেন, যেটা হয়ে গেছে এবং যারা চলে গেছে, ক্ষয়ক্ষতি যা হয়ে গেছে সেটা তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। এখন ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সেটা আরো আগে করা উচিত ছিল, করা হয়নি, চেষ্ট ছিল। কিন্তু এটা এমন একটা ঘনবসতিপূর্ণ ঘিঞ্জি এলাকা, এখানের কেমিক্যাল গোডাউনগুলো আবার ভেতরে ভেতরে এসে জায়গা নিয়ে ফেলেছে।

এটা একটু মনিটরিং করলে হয় তো এড়ানো যেত। ওবায়দুল কাদের বলেন, যেটা ভুল এটা সংশোধন করে নতুন করে পথ চলার বিকল্প কিন্তু নেই। এখন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সরিয়ে নেয়ার জন্য। মেয়র এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকনও একই কথা বলেছেন। তিনি বৃহস্পতিবর দুপুরে চকবাজারের আগুনের ঘটনার পর উদ্ধার অভিযান শেষে বলেছেন, পুরান ঢাকায় দাহ্য পদার্থের কোনো গোডাউন থাকতে দেবো না। এজন্য কঠোর থেকে কঠোরতম পদক্ষেপ নেয়া হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status