দেশ বিদেশ

কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস

স্টাফ রিপোর্টার

২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:৫০ পূর্বাহ্ন

কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে বাতাস। পুরান ঢাকার ঘরে ঘরে চলছে মাতম। স্বজন হারানোর শোকে কাঁদছেন তারা। সবার মুখে মুখে ভয়াবহ সেই রাতের গল্প। মৃত্যু সেখানে ভয়ঙ্কর রূপে এসেছিল। চোখের পলকে কেড়ে নিয়েছে সব। শোকে-বিষাদে বিবর্ণ চুড়িহাট্টা। বিষাদ-বিলাপ চলছে ঢাকা মেডিকেলের মর্গেও। লাশের খোঁজে সেখানে ভিড় করছেন স্বজনরা। গতকাল সকাল থেকেই চুড়িহাট্টা এলাকায় পথে পথে ছিলো মানুষের ভিড়। টুপি-পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে-বসে ভয়াবহ রাতের গল্প করছিলেন। কাঁদছিলেন।

নন্দকুমার দত্ত লেনের একটি বাড়ির মালিক আবদুল আজিজ খান। তার চার সন্তানের মধ্যে মেজো ছেলে ইয়াসিন খান রনির জীবন কেড়ে নিয়েছে আগুন। সিঁড়ি দিয়ে তার বাসার চতুর্থ তলায় যেতেই ভেসে আসছিল কান্নার আওয়াজ। বাসার ভেতরে স্বজনরা সমবেত হয়েছেন। কেউ নামাজ, তসবিহ পড়ছেন। কেউ কোরআন তেলাওয়াত করছেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন রনির একমাত্র বোন আইনজীবী সোমাইয়া আজিজ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, বুধবার রাত সাড়ে ১০টায় বাসায় ফিরছিল রনি। এরমধ্যেই বিস্ফোরণে আগুন ছড়িয়ে যায়। আশেপাশের লোকজন ভিন্ন পথে চলে যায়। কিন্তু তিনি বাসায় নিজের মা, বাবা, বোন ও ভাগনিকে সেইফ করার জন্য দ্রুত শাহী মসজিদের পাশ দিয়ে পা বাড়ান। এ সময় তার ওপরে গিয়ে পড়ে আগুনের কুণ্ডুলি। কিন্তু তখনও পরিবারের সদস্যরা জানেন না রনি আর বেঁচে নেই।

সোমাইয়া জানান, আগুন তাদের বাসা থেকে কয়েকশ’ ফুট দূরে ছিলো। আগুনের খবর পেয়ে দ্রুত তার ফোনে কল দেন। কিন্তু ফোন বন্ধ পান। তারপর থেকেই মনটা ছটফট করছিলো রনির মা-বোনের। সারারাত তারা খুঁজেছেন। ভোরে মিডফোর্ডে গিয়েছেন। তারপর ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। সেখানে অনেক লাশের ভিড়ে রনিকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না।

লাশগুলো পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে। চেনার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত আঙ্গুলের আংটি, হাতে অস্ত্রোপচারের রড দেখে ভাইকে শনাক্ত করেন সোমাইয়া। বাসায় তখন চিৎকার করে কাঁদছিলেন রনির মা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, আমার আগেই সন্তান চলে গেল। আমি খুব হতভাগা মা। মায়ের আগে কেন সন্তান পৃথিবী ছাড়বে। গতকাল তাদের বাসায় ছিলো দোয়া মাহফিল। একইভাবে স্বজন হারানো প্রতিটি বাড়িতেই দোয়া মাহফিল করা হয়। মসজিদে মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। ঘরে-বাইরে বিভীষিকাময় সেই রাতের গল্প। হায়দার বক্স লেনে কথা হয় ওই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ শাকিলের সঙ্গে। তিনি জানান, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির মালিক মোহাম্মদ সোয়েব কিভাবে সংগ্রাম করে পরিবারসহ বেঁচে যান। সেই করুণ কাহিনী। কথা হয় সোয়েবের সঙ্গে। তিনি জানান, বাড়ির নিচতলায় ছিলো হায়দার মেডিকেল, টেইলার্স ও রঙের দোকান। তৃতীয় তলায় স্ত্রী, সন্তান ও মাকে নিয়ে ছিলেন সোয়েব।

ঠিক ওই সময়ে আগুন লেগে যায়। দ্রুত বাড়ির পেছন দিয়ে লাফ দিয়ে পাশের ছাদে যান। সেখান থেকে মই দিয়ে স্ত্রী, সন্তান ও মাকে নিচে নামান। আগুন তখন দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক ওই সময়ে দ্বিতীয় তলার জানালা থেকে চিৎকার করে তার ভাতিজি বলছিলেন, চাচা আমাদের বাঁচান। আমরা মরে যাব চাচা। আগুন এদিকে আসছে। হাতুড়ি দিয়ে দ্রুত জানালা ভাঙ্গতে থাকেন। আগুনের তাপ তখন শরীরে এসে লাগছিল। আগুনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই হাতুড়ি চালাচ্ছিলেন তিনি। জানালা ভেঙ্গে বের করেন ভাতিজা, ভাতিজি ও ভাবিকে। এভাবেই পুরো পরিবারকে রক্ষা করেন সোয়েব। তবে মানুষের ভিড়ে মাকে হারিয়ে সারারাত খুঁজেছেন। পরদিন সকালে মাকে খুঁজে পান। সোয়েব বলেন, তার বাড়ির নিচে কোনো কেমিক্যালের গোডাউন ছিল না। তাই একটু সময় পেয়েছিলেন, যে কারণে পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করতে পেরেছেন।  

আবদুল ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিকের নামেই এই ম্যানশন। তিনি বেঁচে নেই। তার দুই সন্তান সোহেল ও হাসান। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আশপাশের লোকজন জানান, ঘটনার রাতে বাসায় ছিলো না  সোহেল ও হাসানের পরিবারের সদস্যরা। তারা কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তবে এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে দেখা গেছে সেখানে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন স্বজন হারানো মানুষ। মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার বালিয়াটি থেকে এসেছেন কামাল হোসেন। তিনি জানান, তার বড় ভাই হেলাল রিকশা চালাতেন। থাকতেন ঢাকার সোয়ারিঘাট। অগ্নিকাণ্ডের আগে মঙ্গলবারে মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছে হেলালের। বুধবারের রাত থেকে তার ফোন বন্ধ। কোনো খোঁজ নেই। মা কাঁদছেন। ছেলের খোঁজ নিতে ছোট ছেলে কামালকে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। হন্যে হয়ে বিভিন্নস্থানে খুঁজেছেন। হেলালের খোঁজ নেই। বুধবার রাতে আর মেসে ফিরেননি তিনি।

বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গে যান, লাশ দেখে চিনতে পারেন না। লাশগুলো চেনার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত ঢামেক মর্গে যান। সেখানে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন কামাল। একইভাবে স্বামীকে না পেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে ডিএনএ নমুনা দিতে এসেছিলেন চুড়িহাট্টার বাসিন্দা ময়না বেগম। তার স্বামী শাহীন ওই রাতে বাসার পাশে রেস্টুরেন্টে এক বন্ধুকে নিয়ে চা পান করতে যান। ওই বন্ধুর লাশ পাওয়া গেলেও শাহীনের  কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ডিএনএ নমুনা দিতে গিয়ে শাহীনের ১০ বছর বয়সী মেয়ে হাফসা বলে, আব্বু বলেছিল চকলেট নিয়ে বাসায় আসবে। বলেছিল, আমাদের নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবে। তারপর আর আসেনি। ফোন বন্ধ। কেউ কি বলতে পারবে না আব্বু কোথায়, আব্বু কি আর কখনো আসবে না?  এভাবেই নিখোঁজ স্বজনের সন্ধানে ভিড় বাড়ছে ঢামেক মর্গে। সবাই তাদের স্বজনের খোঁজ চায়।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status