শেষের পাতা

অভিনব ব্ল্যাকমেইল

রুদ্র মিজান

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:৫৪ পূর্বাহ্ন

মহিবুল্লাহ

রাত প্রায় দেড়টা। মেসেঞ্জারে ক্ষুদেবার্তার আগমনী শব্দ। মোবাইলফোন হাতে নিতেই দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায় সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার। তার পুরো শরীর কেঁপে উঠছিল। বিশ্বাস করতে পারছিলেন না এমনটি ঘটবে। নিজের উলঙ্গ ছবি দেখতে পাচ্ছেন তিনি। সারা শরীরে কোনো পোশাক নেই। ছবিটি ব্যবহার করে অনেক কিছুই বোঝানো যেতে পারে। তিনি একজন সচিব। তার পারিবারিক, সামাজিক একটা মর্যাদার ব্যাপার আছে। ছবি দেখছিলেন আর হাত কাঁপছিল। চোখে জল জমাট হচ্ছিল। নিজেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন তিনি। মাইশা মাদিহা নামে যে আইডি থেকে তাকে এটি পাঠানো হয়েছে ওই আইডি ব্যবহারকারীর কাছে জানতে চান, এই ছবি দিয়ে তিনি কি করতে চান। সচিবকে জানানো হয়, এক লাখ টাকা চান তিনি। টাকা না দিলে ছবিটি ফেসবুকে, ইউটিউবে ভাইরাল করে দেয়া হবে। সচিব অনুরোধ করেন এটি ভাইরাল না করতে।

সেইসঙ্গে এত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি চ্যাটে লিখেন, আমি এত টাকা যোগাড় করতে পারব না। আমি একজন সৎ অফিসার। তার পর ওই আইডি থেকে লেখা হয়, বুঝলাম না কথা। আপনার কত টাকা,  কী করেন, না করেন, তা আমি জানি। এভাবে চ্যাট করার একপর্যায়ে এক লাখ থেকে দাবিকৃত টাকার পরিমাণ নেমে আসে ৫০ হাজারে। তাতেও অপারগতা জানালে হুমকি দেয়া হয়, সচিবের মেয়ের বন্ধুদের গ্রুপে এই ছবি ছড়িয়ে দেয়া হবে। তারপরই টাকা দিতে সম্মতি জানান তিনি। টাকা দিতে প্রস্তুতি নেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তিনি। যদি কোনোভাবে ছবিটি প্রকাশ পায়। পরিচিত জনরা দেখতে পান- কী ব্যাখা দেবেন তিনি। কত জনকে বোঝাবেন প্রকৃত ঘটনাটি। তার মান-সম্মানের কী হবে। এ রকম নানা দুশ্চিন্তা ছিল তার মাথায়।

বিষয়টি নিয়ে পরামর্শ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাদের পরামর্শে গত বছরের ১লা ডিসেম্বর রমনা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। একইভাবে লিখিত অভিযোগ করেন সিটিটিসি’র সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগে। মাঠে নামেন সিটিটিসি’র সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের সদস্যরা। শুরু হয় তদন্ত। প্রাথমিক তদন্তেই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। পুলিশের পরামর্শে সরকারি ওই কর্মকর্তা বিকাশ নম্বর চান মাইশা মাদিহা নামের ফেসবুক আইডি ব্যবহারকারীর কাছে। দুটি বিকাশ নম্বর দেয়া হয় তাকে। প্রথমেই পাঁচ হাজার টাকা পাঠানো হয় বিকাশে। ৫০ হাজার টাকা দেয়ার কথা সেখানে মাত্র পাঁচ হাজার- এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হয় মাইশা মাদিহা আইডি থেকে। দ্রুত বাকি টাকা পাঠাতে বলা হয়। ততক্ষণে বিকাশ নম্বরের অবস্থান নিশ্চিত হয় পুলিশ। সেটি বরগুনার আমতলী। গত বছরের ৩রা ডিসেম্বর সেখানে পৌঁছে যায় পুলিশ। বিকাশে পাঠানো হয় আরও পাঁচ হাজার টাকা। টাকা উত্তোলন করতে যায় এক যুবক। তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। এই যুবকের নাম মহিবুল্লাহ। বরগুনা জেলার আমতলী থানার ঘোপখালী মুন্সিবাড়ির তৈয়বুর রহমানের পুত্র।

গ্রেপ্তারের পর তার পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে মহিবুল্লাহ। নিজেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার পরিচয় দিয়ে মহিবুল্লাহ জানিয়েছে, চায়না যেতে চাচ্ছিলো সে। চীনা ভাষা শিখতে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে। প্রস্তুতি নিচ্ছিল সেভাবেই। প্রয়োজন ছিল টাকার। সহজ পথে বেশি টাকা আয় করার জন্য বেছে নেয় ভিন্ন পথ। টার্গেট করে সমাজের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের। তাদের কাছ থেকে লাখ-লাখ টাকা আদায় করা কোনো বিষয় না বলে মনে করে মহিবুল্লাহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আইডি খুলে মাইশা মাদিহা নামে। এই আইডি থেকেই বন্ধুতা গড়ে তুলে ওই সচিবের সঙ্গে।

নিয়মিত চ্যাট করে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করে। নানা কৌশলে ওই সচিবকে আবেগপ্রবণ করে তুলতে চেষ্টা করছিল মহিবুল্লাহ। গত বছরের ২০শে নভেম্বর রাত সাড়ে ১২টা। সারা দিনের ব্যস্ততা, ক্লান্তি শেষে ওই সচিব সবেমাত্র বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। এরমধ্যেই ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ভিডিও কল। কলটি রিসিভ করেন তিনি। কিন্তু কোনো কথা নেই। এরমধ্যেই ঘটে ঘটনা। ভিডিও কলের মাধমে সচিবের খালি গায়ের ছবি নেয় মহিবুল্লাহ। পরবর্তীতে ওই ছবি এডিট করা হয়। এতে উলঙ্গ এক পুরুষের কোমড়ের নিচের অংশ সংযোজন করা হয়। পুরো উলঙ্গ একটি ছবি তৈরি করে ওই সচিবকে পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে চাঁদা দাবি করে মহিবুল্লাহ।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগী ওই সচিব জানান, তখন গরমের দিন। লুঙ্গি পড়ে খালি গায়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এরমধ্যেই ভিডিও কল। তিনি বুঝতে পারেননি ঘটনাটি এভাবে ঘটবে।  

এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিটিটিসি’র সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের পরিদর্শক নাজমুল নিশাত বলেন, মহিবুল্লাহ আরও অনেককে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করেছে। তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারলে হয়তো আরও অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারের পর মহিবুল্লাহ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে বলে জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status