দেশ বিদেশ

নদী রক্ষা কমিশন কার্যকরের তাগিদ

মোহাম্মদ ওমর ফারুক

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:৩৮ পূর্বাহ্ন

বদলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাংলাদেশ। বর্ষায় থৈ থৈ পানি আর দেখা মেলেনা নদীতে। গ্রীষ্মেতো মানুষ এপার ওপার হয় হেঁটে। ভরা যৌবনেও এখন ফুঁসে উঠে না জলরাশি। তাইতো বছরের বেশির ভাগ সময় নদী থাকে মরা। অথচ এক সময় এ দেশে নদীপথই ছিল শক্তিশালী। নদীতে চলত পাল তোলা নৌকা, লঞ্চ, জাহাজ। পণ্য পরিবহন হতো নদী পথেই। তাইতো নদীপথকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বন্দর। আর এ বন্দরকে ঘিরে গড়ে উঠে শহর। আজ কোথায় এসব বন্দর? এসব নদী দেখভালের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল নদী সংরক্ষণ কমিশন। এ কমিশনের অবস্থাই এখন কি? হিসাব অনুযায়ী দেশে আট শতাধিক নদ-নদীর অস্তিত্ব ছিল এক সময়। যার আয়তন ২৪ হাজার ১৪০ কিলোমিটার। এর কোনোটি এখন দূষণে দূষিত। কোনোটি দখন হয়ে হারিয়ে গেছে। কোনোটি আবার মরেও গেছে। কোথাও কোথাও মানচিত্রে নদী থাকলেও এখন সেখানে স্থান পেয়েছে অট্টালিকা। যা-ও কিছু বেঁচে আছে তার অবস্থাও করুণ। নদী দখল আর দূষণের হাত থেকে বাঁচাতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে গঠিত হয় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। কিন্তু পাঁচ বছর পরে এসে এই কমিশনের কার্যক্রম হতাশাজনক। অব্যবস্থাপনা এবং আইনের দুর্বলতার কারণে নিজেই অরক্ষিত হয়ে উঠেছে নদী সংরক্ষণ কমিশন। নয়া পল্টনে হোসেন টাওয়ারের ১২তলায় দুটি ফ্লোর নিয়ে কোনো রকম চলছে কার্যক্রম। শুধু তাই নয় রয়েছে জনবল সংকটও। একজন চেয়ারম্যান আর চার জন মেম্বার। এর মধ্যে তিন জন আবার অস্থায়ী ভাবে কাজ করছেন। মাস তিনেক পর পর শুধুমাত্র মিটিংয়ে তাদের দেখা মিলে। এসব ভঙ্গুরতার পাশাপাশি কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। মালিকানাধীন অরক্ষিত দুটি ফ্লোরে নেই কোনো নিরাপত্তার ব্যবস্থা। অভিযোগ রয়েছে, এলাকার প্রভাবশালীরা হুটহাট করে অফিসে ঢুকে কর্মকর্তা কর্মচারীদের ভয়ভীতি, মারধর, চাঁদাবাজি, টেন্ডার কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার, লোক নিয়োগ ও কেনাকাটায় অবৈধ হস্তক্ষেপ করছে। এই নিয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান গত মাসে পুলিশের মহপরিদর্শকের কাছে অভিযোগ করেন। গত ২৮শে জানুয়ারি কার্যালয়টির নিরাপত্তার জন্য আমর্ড আনসার ব্যাটালিয়নের একটি দল নিয়োগ দেয়ার জন্য জননিরাপত্তা সচিব বরাবর আবেদন করেন নদী রক্ষা কমিশনের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম। যদিও উচ্চ আদালত, নদী রক্ষা কমিশনের কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা প্রদান এবং সর্বপ্রকার সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। কমিশন সূত্রে জানা যায়, কার্যালয়ের জন্য ইতিমধ্যে তারা জায়গা চেয়েছেন  যেখানে নিজস্ব ভবন হবে। এই যখন কমিশনের অবস্থা, তাদের কার্যক্রম নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন শুধুমাত্র নদী পরিদর্শন, সভা-সেমিনার, মিটিং আর কিছু সুপারিশ দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে তাদের কার্যক্রম। তবে কেউ কেউ মনে করছেন আইনি দুর্বলতার কারণে এই কমিশন পিছিয়ে আছে। আবার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে নদ-নদী রক্ষা করাও সম্ভন নয়। এই কমিশন নদী রক্ষার স্বার্থে মামলা করার এখতিয়ার থাকলেও প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরেও হয়নি একটি মামলা। কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলা করতে হলে মামলার আসামি হবে ডিসি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিআইটিডাব্লিউ কর্মকর্তা এবং প্রভাবশালীরা। এসব মামলা করে আমাদের টিকে থাকা খুব কষ্টকর। তাই কোনো মামলার ভেজালে যাওয়া হয় না। তবে কেউ নদী রক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে মামলা করলে আমাদের প্যানেল আইনজীবীরা তাদের সহযোগিতা করবে। তাছাড়া মামলা করার জন্য যে জনবল প্রয়োজন, ইন্সপেক্টর নিয়োগ বা যারা মামলা করবে এখনো সেটা হয়নি। মামলা করার জন্য অর্থায়নও পাওয়া যাচ্ছে না।
২০১৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশন একটি সুনির্দিষ্ট আইন দ্বারা পরিচালিত। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ (২০১৩ সালের ২৯নং আইন)-এ বলা আছে ‘নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশ দূষণ, শিল্পকারখানা কর্তৃক সৃষ্ট দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানাবিধ অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠনের উদ্দেশে প্রণীত আইন। এ আইনের দ্বারা কমিশনের কাজও সুনির্দিষ্ট হয়েছে। এ আইনের ১২ধারায় মোট ১৩টি বিষয়ে সরকারকে কমিশন সুপারিশ করতে পারবে। এই অর্থে বলা হয় এই কমিশন একটি সুপারিশকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিবছর পহেলা মার্চের মধ্যে গত এক বছরের প্রতিবেদন জমা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। যদিও গত রোববার নদী রক্ষা কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন আইনে কমিশনকে কেবল সুপারিশ করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নদীরক্ষায় সরকার কী করবে সে বিষয়ে শুধু কমিশন সুপারিশ করবে। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা বা কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার কমিশনকে দেয়া হয়নি। তবে গত পাঁচ বছরে কেমন সুপারিশ করা হয়েছে এবং কতটা বাস্তবায়ন করা হয়েছে এর কোনো হিসেবে নেই কমিশনের কাছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, কমিশন মূলত বিভিন্ন নদী পরিদর্শন করছে। পরিদর্শনের পর কমিশন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে কখনও কখনও প্রতিবেদন জমা দিয়ে থাকে। এতে আসলে কাজের কাজ কিছু হয় না। তেমন কোনো সুপারিশ আমরা আসলে পাই না। সূত্র মতে, সারা দেশের বিভাগ বা জেলায় কোথাও নদীরক্ষা কমিশনের শাখা নেই। রাজধানী ঢাকায় একটি মাত্র কার্যালয় দিয়ে চলছে পুরো দেশের কার্যক্রম। কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, জনবল সংকটের কারণে কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হলেও কমিশনের চেয়ারম্যান এবং স্থায়ী সদস্য গত এক বছরে ৫৮ জেলা পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার চেষ্টা করছেন। তবে তাদের আরো নানা কাজ থাকায় আমাদের কাজটি রাখেন সবার শেষে।
জানা যায়, বাজেট সংকটের কারণে কর্মকর্তাদের কোনো প্রশিক্ষণ দিতে পারছে না কমিশন। যার কারণে মাঠে কাজ করতে গিয়েও নানান প্রতিবন্ধকতার শিকার হন তারা।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র সাধারণ সম্পাদক  প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বলেন, তাদের যতটুকু কাজ করার কথা তারা ততটুকু কাজও করতে পারছে না। কিছু আইনের দুর্বলতা আছে, তবে আমরা পরিবেশকর্মী, গণমাধ্যমকর্মী থেকে শুরু করে পুরো দেশ তো তাদের সঙ্গে আছে। তারা কিছু কাজ করে দেখাক। সীমাবদ্ধতার মধ্য থেকেও অনেক কাজ করা যায়। তারা যে সুপারিশগুলো করছে সেটা কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে? কমপক্ষে বছরে একবার গণমাধ্যমের সামনে বলুক। জবাবদিহি নিশ্চিত করুক তাহলেই তো হলো। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, কাজ করতে গিয়ে আমাদের অনেক হুমকি আসে। সব কথা তো আর বলা যায় না। আমি তো ভেতর থেকেই অনেক হুমকি পাই। তবুও আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা যে সুপারিশ করি, সেগুলো বাস্তবায়ন হলো কি হলো না সেটার জন্য তো কারো কাছে জবাবদিহি চাইতে পারছি না। নদী রক্ষা কমিশনকে আরো কার্যকর করতে চাইলে একে আরো শক্তিশালী করতে হবে। সুপারিশ করার পর বাস্তবায়নও কিছু হয়েছে তবে কোথাও কোথাও উচ্ছেদ হয়েছে। কোথাও কোথাও উচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রভাবশালীদের কারণে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অভিযোগটির ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা একেবারই ঠিক না। তারা নিজেদেরটা চাপা দেয়ার জন্য এমনটা বলছে। তাদেরকে আমরা সুনির্দিষ্ট অনেক সুপারিশ করেছি, এবং চিঠিও লেখেছি সেটা তারা বাস্তবায়ন করেননি। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু আছে যারা সেগুলো উচ্ছেদে যাননি। তবে কিছু কিছু তারা বাস্তবায়ন করেছে। বিআইটিডাব্লিউকে আমরা নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। বরং তারা অনেক নদীর জায়গা সাবলিজ দিয়েছে। তারা অবিলম্বে সাব লিজ বন্ধ করুক। নদীর জমি কাউকেই দেয়া যাবে না। কিন্তু তারা তা বন্ধ করছে কেননা সেটাও তো সুপারিশ করেছিলাম। তিনি বলেন, নদী রক্ষা কমিশনকে কোনো মন্ত্রণালয়ের আওতায় না রেখে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status