বাংলারজমিন

মহাসড়কে থামছেই না দুর্ঘটনা

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৮:৪৯ পূর্বাহ্ন

দুর্ঘটনার জন্য অনিরাপদ সড়ককেই দায়ী করা হয় মূলত। সেদিক থেকে এখন অনেকটাই নিরাপদ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। একমুখী হওয়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষে কোনো দুর্ঘটনা নেই বললেই চলে চার লেনের এই মহাসড়কে। তবুও থামছে না দুর্ঘটনা।
মঙ্গলবার একদিনে এই মহাসড়কে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও মিরসরাই অংশে পৃথক তিনটি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫ জন। আহত হয়েছেন ১০ জন। গত এক সপ্তাহে এই অংশে ঘটেছে আরো ১০টি দুর্ঘটনা। এতে নিহত হয়েছেন ৭ জন। আহত হয়েছেন ১৩ জন।
শুধু মিরসরাই পর্যন্ত নয়; ফেনী থেকে নোয়াখালী এমনকি কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তৃত এই দুর্ঘটনার আওতা। যেখানে প্রতিদিন ঘটছে এক বা একাধিক দুর্ঘটনা। গত সপ্তাহে ফেনী থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত ঘটেছে অন্তত আরো ১০টি দুর্ঘটনা। এতে প্রাণ গেছে ১৩ জনের।
এভাবে প্রতিদিন এই সড়কে মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন তাজা প্রাণ। আর প্রতিটি দুর্ঘটনার কাহিনী পেছনের গাড়ি থেকে। মঙ্গলবার মিরসরাইয়ে নিজামপুর কলেজের কাছে পেছন থেকে দ্রুতবেগে আসা কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান স্বামী-স্ত্রীসহ তিনজন। সীতাকুণ্ড পৌরসদর বাসস্ট্যান্ডেও পেছন থেকে আসা দ্রুতগতির একটি কাভার্ডভ্যান চাপা দিলে পথচারী এক শিশু মারা যায়। পেছন থেকে আসা দ্রুতগামী ট্রাক চাপায় এদিন মারা যায় আরো এক মোটরসাইকেল আরোহী। এভাবে সবগুলো দুর্ঘটনায় ঘটছে পেছন থেকে আসা দ্রুতগামী কাভার্ভভ্যান, ট্রাক, লরি এবং বাস চাপায়। এভাবে গত এক সপ্তাহে সংঘটিত সবক’টি দুর্ঘটনা ঘটেছে পেছন থেকে ধাক্কা বা চাপা দিয়ে। এতে নিরাপদ সড়কের দাবি যেন গুমরে  কেঁদে মরছে। এমন কথা বললেন- চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শমপা রানী সাহা। তিনি বলেন, ভারী যানবাহনগুলোই যেন মহাসড়কে দানব হয়ে উঠেছে। প্রতিটি দুর্ঘটনায় লরি, কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, এমনকি যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কা বা চাপায় ঘটছে। এরমধ্যে ফেনী ও নোয়াখালী এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের বাসে অন্তত চারটি দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অথচ এর আগে বলা হয়েছে ছোট যানবাহনগুলোর কারণে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে ছোট গাড়িগুলোর গতি কম। বেশিগতির যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে না পারায় দুর্ঘটনা ঘটছে। এমনকি এসব গাড়ির অধিকাংশের ফিটনেসও নেই। চালকদেরও লাইসেন্স নেই। শেষ পর্যন্ত মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ হলো সিএনজি অটোরিকশাসহ কম গতির গাড়িগুলো। এরপরও দুর্ঘটনা থেমে নেই। বরং বাড়ছে। তাও সবগুলো দুর্ঘটনা ঘটছে ফিটনেস সনদধারী দ্রুতগতির যানবাহনগুলোর কারণে। এগুলোর চালকদের লাইসেন্সও আছে।
ক্রমান্বয়ে সংঘটিত এসব দুর্ঘটনায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রীসাধারণের পাশাপাশি যানবাহন চালক-মালিকরাও এখন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সড়ক পাশে যাওয়া-আসা স্কুল শিক্ষার্থী ও পথচারীরা। প্রশ্ন একটাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করলেও সড়কগুলো এখনো অনিরাপদ কেন? বাংলাদেশ বাসযাত্রী কল্যাণ সমিতি চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক নিরাপত্তায় ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, থানা পুলিশ, আনসার নিয়োজিত রয়েছেন। জেলার সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, সড়ক ও জনপদ বিভাগ, বিআরটিএ সুশৃঙ্খল যানবাহন চলাচলে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন।
কিন্তু এতকিছুর পরও যদি সড়ক নিরাপদ না হয়। দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকে তাহলে স্বভাবতই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে সকল দায়িত্ব। আবার এসবের দায় নিতেও রাজি নয় দায়িত্বশীল কেউ। বরং লরি, কাভার্ডভ্যান, ট্রাক ও বাসের মতো অন্যের কাঁধে দোষ চাপাতে ব্যস্ত সবাই। আলাপকালে দুর্ঘটনার জন্য ফিটনেসবিহীন যানবাহন, বেপরোয়া গতি ও অদক্ষ চালকের কাঁধে দোষ চাপালেন চট্টগ্রাম জোরারগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে গতির নিয়ন্ত্রণ নেই। কোন গাড়ি কোন লেনে কোন গতিতে চলবে তাও জানেন না চালকরা। ফলে কমগতির গাড়ির উপর দ্রুতগতির গাড়িগুলো উঠে গিয়ে চাপা দিচ্ছে। নয়তো ধাক্কা খেয়ে সড়ক থেকে ছিটকে পড়ছে। আবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দ্রুতগতির গাড়ি ঠাঁই নিচ্ছে খাদে। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। নগরীর ভটিয়ারী সিটি গেইট এলাকায় কর্মরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মুনির হোসাইন বলেন, সড়কে ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকলেও বড় যানবাহনগুলো বেপরোয়া। বিশেষ করে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, বাসগুলোর অধিকাংশ চালক এখন ইয়াবা পাচার করে। ফলে হাইওয়ে পুলিশ, থানা পুলিশের তল্লাশির ভয়ে বেপরোয়াগতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ছে। সড়ক ও জনপদ বিভাগের চট্টগ্রাম সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল আলম বলেন, মহাসড়ক এখন অনিরাপদ নয়। চারলেনে উন্নীত এ সড়ক। মুখোমুখি সংঘর্ষের কোনো ঘটনা এখন মহাসড়কে নেই। দুর্ঘটনার জন্য মূলত দায়ী ট্রাফিক পুলিশ, থানা পুলিশ ও আনসারদের চাঁদাবাজি। তাদের হয়রানি থেকে বাঁচতে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে যানবাহন। তন্মধ্যে যানবাহনের ফিটনেস ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন চালকরাও দায়ী বলে জানান তিনি।  
বিআরটিএ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক তৌহিদুল হোসেন বলেন, বেপরোয়া ও অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেকের প্রতিযোগিতা, চালকদের অবসাদগ্রস্ততা, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো, যানবাহনের যান্ত্রিক ত্রুটি এবং চালকদের অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও অনভিজ্ঞতা এবং ট্রাফিক আইন না জানা ও যথাযথ অনুসরণ না করার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। কোথাও একটি কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে অন্য কোথাও আরেকটি কারণে ঘটছে। সবমিলিয়ে একসঙ্গে পরিবর্তন সাধিত না হলে দুর্ঘটনা কমবে না। প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিআরটিএ’র জনবল কম। ফলে ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের অবহেলা রয়েছে। সড়কের শৃঙ্খলায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন সঠিকভাবে তদারকি করলে দুর্ঘটনা কমে আসতো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status