বাংলারজমিন

বিশেষজ্ঞদের মতে ঝুঁকিপূর্ণ

ছাতকে সুরমা সেতুর নির্মাণকাজে ত্রুটি

নূর মিয়া রাজু, ছাতক (সুনামগঞ্জ) থেকে

২৪ জানুয়ারি ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ৯:১৫ পূর্বাহ্ন

ছাতকের সুরমা নদীর ওপর নির্মাণাধীন সুরমা সেতুর নির্মাণকাজে মারাত্মক ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। ত্রুটিকে ধামাচাপা দিতে জোড়াতালি দিয়ে ছাতক-দোয়ারাবাজার উপজেলাবাসীর বহুল প্রত্যাশিত সুরমা সেতুর নির্মাণকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে ভবিষ্যতে এ সেতু ছাতক-দোয়ারাবাসীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। বর্তমানে সুরমা সেতুর নির্মাণকাজ প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড় শ্যামপাড়া সংলগ্ন এলাকায় ২য় পিলারের (স্তম্ভ) গার্ডার স্থাপনের পর এ ত্রুটি ধরা পড়ে। ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে পিলারগুলো উচ্চক্রম অনুসারে সাজানো হয়ে থাকে। কিন্তু সুরমা সেতুর ক্ষেত্রে মনে হয় এর বিপরীত সূত্র ধরে নির্মাণকাজ করা হচ্ছে। সেতুর ১ম পিলার থেকে নদীর দিকে অগ্রসর ২য় ফিলারের উচ্চতা অন্তত এক থেকে দেড় ফুট নিচে থাকায় এমনটাই মনে হচ্ছে। অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের মতে প্রকৌশল শাস্ত্রের বিপরীতে চলছে সুরমা সেতুর নির্মাণকাজ। প্রকৌশল শাস্ত্র অনুযায়ী একটি ব্রিজ নির্মাণের ক্ষেত্রে ১ম পিলার থেকে ২য় পিলার ক্রম উচ্চতায় অবস্থান করবে। দু’য়ের অধিক পিলার দ্বারা নির্মিত ব্রিজের ক্ষেত্রে ১ম পিলার থেকে ২য় পিলার অন্তত ১ ফুট উচ্চতায় থাকবে। সম্প্রতি এমন ত্রুটি ধরা পড়লে ত্রুটিযুক্ত পিলারের শীর্ষ মুখে গার্ডারের নিচে সিসি ঢালাই দিয়ে ব্রিজের লেভেল নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন নিয়োজিত ঠিকাদার। ব্রিজের ঠিকাদার ত্রুটির কথা স্বীকার করে এ ত্রুটির জন্য দু’টি ধাপে তৈরি ব্রিজের প্ল্যানিংকেই দায়ী করছেন। বিষয়টি ভবিষ্যতের জন্য কোনোরকম ঝুঁকিপূর্ণ নয় বলেও তিনি দাবি করছেন। ছাতক-দোয়ারাবাসীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ছিল সুরমা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণ। অবশেষে ২০১৭ সালের ২২শে আগস্ট সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (জিএফডিপি) সৈয়দা সালমা বেগম স্বাক্ষরিত ছাতক
সুরমা নদীর উপর সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়। ৪টি শর্ত দিয়ে ৩০ কোটি ৪৯ লাখ ৮৫ হাজার ১৭৪ টাকা ব্যয় ধরে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে সুরমা সেতুর কার্যাদেশ প্রদান করা হয় ‘জন্মভূমি নির্মাতা’ নামক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে। সুরমা নদীর উপর সেতুর নির্মাণের মূল পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের দাবির প্রেক্ষিতে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সেতু নির্মাণের প্রাক্কলন  তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শহরের শ্যামপাড়া এলাকায় ২০০৪ সালে ২৩শে আগস্ট সুরমা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি সরকারের একটি বিশেষ প্রকল্পের আওতায় ২০০৬ সালে জানুয়ারিতে ১৮ই কোটি টাকা ব্যয় ধরে তিন বছর মেয়াদে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নদীর উভয় তীরে চারটি স্তম্ভ নির্মাণ করাই ছিল জোট সরকারের সুরমা সেতু নির্মাণের সর্বশেষ কাজ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেতু নির্মাণে ব্যাপক অসংগতি রয়েছে বলে প্রকল্পটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি এডিপি থেকে বাতিল করে দেয়। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০১০ সালে এ সেতুটির অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ৫১ কোটি টাকার একটি সংশোধিত নতুন প্রকল্প যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। এ আবেদনটি বিশেষ বিবেচনায় এনে ১১২ কোটি ৯৯ লাখ ৪৯ টাকার পুনঃসংশোধিত প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় সড়ক ও জনপদ বিভাগের
প্রধান কার্যালয়ে। ২০১৬ সালের জুন মাসে মহান জাতীয় সংসদে সুরমা সেতুর নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংসদ সদস্য মুহিবুর রহমান মানিকের দাবির প্রেক্ষিতেই অক্টোবর মাসে পরিকল্পিত এপ্রোচ ও নেভিগেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে সেতু নির্মাণে ১১৩ কোটি টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)’র সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদনের প্রায় ১০ মাস পর সেতুর কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। ১ম পিলার থেকে ২য় পিলার পর্যন্ত গার্ডার স্থাপনের পর ২য় পিলার অপেক্ষাকৃত নিচু এ বিষয়টি ধরা পরে। বর্তমানে পিলারের মুখে (গার্ডারের নিচে) কৌশলে সিসি ঢালাই দিয়ে লেভেল ম্যান্টেইন করার চেষ্টা করছেন নিয়োজিত ঠিকাদার।  সিনিয়র ঠিকাদার রবীন্দ্র কুমার দাস ও উপজেলা কন্ট্রাক্টর এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শাহীন চৌধুরী এ ব্যাপারে জানান, বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ও দক্ষ প্রকৌশলীর পরামর্শ নিয়ে ত্রুটি সংশোধন করা উচিত। এভাবে গার্ডারের নিচে সিসি ঢালাই দিয়ে ব্রিজের উচ্চতা ম্যান্টেইন করা ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রকৌশল শাস্ত্রের পরিপন্থি। সাবেক উপজেলা প্রকৌশলী সমরেন্দ্র দাস তালুকদার জানান, ইঞ্জিনিয়ারিং প্ল্যান অনুযায়ী ব্রিজের পিলার মিডল পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে উঁচু হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে ১ম পিলার থেকে ২য় পিলারের উচ্চতা হবে নুন্যতম ১ ফুট ৩ ইঞ্চি। গার্ডারের নিচে সিসি ঢালাই দিয়ে লেভেল পূর্ণ করা অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। নিয়োজিত ঠিকাদার লুৎফুর রহমান ত্রুটির কথা স্বীকার করে এ ব্যাপারে জানান, দুটি প্ল্যানে সুরমা সেতুর প্ল্যানিং করা হয়েছে।  যে কারণে সামান্য ত্রুটি দেখা দিয়েছে। গার্ডারের নিচে ঢালাই দিয়ে লেভেল ঠিক করা হয়েছে। বর্তমানে ১ম টি থেকে দ্বিতীয়টি অন্তত ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় রয়েছে। উপজেলা প্রকৌশলী আবুল মনসুর মিয়া জানান, এমন ত্রুটির ক্ষেত্রে দক্ষ প্রকৌশলী বা বুয়েটের পরামর্শ নিয়ে কাজ সম্পন্ন করা উচিত। অন্যথায় ব্রিজের নির্মাণকাজ হবে ঝুঁকিপূর্ণ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status