শেষের পাতা

হলি আর্টিজান হামলা

অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক ‘সরবরাহকারী’ রিপন গ্রেপ্তার

স্টাফ রিপোর্টার

২১ জানুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ১০:১৭ পূর্বাহ্ন

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি মামুনুর রশিদ ওরফে রিপনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। সে ওই হামলায় অর্থ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করেছে। গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় র‌্যাবের এক বিশেষ অভিযানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি জেএমবির একজন অন্যতম শূরা সদস্য ছিলেন। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে নগদ ১ লাখ ৪৭ হাজার ৭৫৫ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রিপন জঙ্গি কার্যক্রম নিয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। জানিয়েছে, জেএমবিকে পুনরায় সুসংগঠিত করার কাজ করছিল তারা।

সেই লক্ষ্যে আত্মগোপনে ও পলাতক থাকা জঙ্গিদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় জড়িত বন্দি জঙ্গিদের ছিনতাইয়েরও পরিকল্পনা ছিল তাদের। এ ছাড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর স্থাপনায় জঙ্গি হামলার উদ্দেশ্যে সব জঙ্গিদের সুসংগঠিত করা ও নতুন করে নাশকতার উদ্দেশে অর্থ, অস্ত্র, বিস্ফোরক সরবরাহের চেষ্টা করা হয়েছে। এসব পরিকল্পনার সঙ্গে রিপনের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল। গতকাল রাজধানীর কাওরানবাজারের র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন সংস্থাটির মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।

সংবাদ সম্মেলনে মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ২০১৪ সালে ময়মনসিংয়ের ত্রিশালে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনার মতো আরেকটি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিল জঙ্গিরা। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার শুনানির সময় আসামিদের বিভিন্ন কারাগার থেকে যখন আদালতে হাজির করা হয় তখন ছিনতাইয়ের টার্গেট করেছিল তারা। নির্বাচনের আগে দেশের কিছু জায়গায় নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় পরে সেটা আর সম্ভব হয়নি। আর এ ধরনের প্রত্যকটি পরিকল্পনায় সঙ্গে জড়িত ছিল মামুনুর রশিদ। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জঙ্গিদের সক্রিয় করার জন্য সে কাজ করে আসছিল। জেএমবির পুনর্গঠিত হওয়ার পেছনে সে প্রথম থেকেই সক্রিয় ছিল। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাইবান্ধায় একটি গোপন বৈঠক হয়। সেখানে সারোয়ার জাহান মানিক, মারজান, বাশারুজ্জামান চকলেট, রাজীব গান্ধীসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন।

সেখান থেকেই হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ওই  বৈঠকেও মামুনুর রশিদ রিপন উপস্থিত ছিল। সংগঠনের বিশ্বস্ত হওয়াতে তার ওপর হামলার সামরিক প্রশিক্ষণ, অর্থ সংগ্রহ, অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক সংগ্রহের দায়িত্ব ছিল। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে জেএমবির আমীরের নির্দেশে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে আত্মগোপন করে রিপন। ভারত থেকেই সে হলি আর্টিজানে হামলার অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক সরবরাহ করেছিল। অস্ত্রের মধ্যে রাইফেল, পিস্তল ও গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়েছিল। এগুলো সে কল্যাণপুরের একটি বাড়ি থেকে মারজানের মাধ্যমে সারোয়ার জাহানের কাছে দিয়েছিল।

এ ছাড়া সারোয়ার জাহানের কাছে প্রায় ৩৯ লাখ নগদ টাকা পাঠিয়েছিল। মুফতি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে এই জঙ্গি হলি আর্টিজান নিয়ে তথ্য দিয়েছে। হামলার আগের দিন বারিধারার একটি বাড়িতে বৈঠক হয়েছিল। ওই বৈঠকে হামলায় অংশগ্রহণকারী জঙ্গি মোবাশ্বের, নিবরাস, শফিকুরসহ অন্যদের সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছিলেন সারোয়ার জাহান। বৈঠকে কার কী দায়িত্ব সেটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিল। পরিপূর্ণভাবে সব নির্দেশনা দেয়ার পর পরেরদিন হামলা হয়। র‌্যাবের এই কর্মকর্তার দাবি, তার তত্ত্বাবধানে উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলা হয়েছে। তবে, ওই হামলাগুলোর নেতৃত্ব দিতেন রাজীব গান্ধী নামের আরেক জঙ্গি। তিনি হলি আর্টিজান হামলারও মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। যেকোনো হামলার আগে তারা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতেন। তখন ওই প্রশিক্ষণে যারা যে বিষয়ে পারদর্শী সবাই উপস্থিত হতেন। সেখানে মহড়ার ব্যবস্থা করা হতো। ২০১৬ সালে বগুড়ায় এরকম একটি মহড়ার সময় জেএমবির শূরা সদস্য ফারদিন ও তরিকুল ইসলাম নিহত হন।

মুফতি মাহমুদ আরো বলেন, গ্রেপ্তারকৃত আসামি মামুনুর রশিদ ১৯৮৮ সালে বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেছে। স্থানীয় একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে সে মাদরাসায় ভর্তি হয়। ঢাকার মিরপুর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম, নওগাঁর বিভিন্ন মাদরাসায় লেখাপড়া করে। ২০০৯ সালে চাঁপাই নবাবগঞ্জের মাদরাসাতুল দারুল হাদিস থেকে দাওরা-ই হাদিস সম্পন্ন করে বগুড়ার সাইবার টেক নামক একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেয়। চাকরিরত অবস্থায় পূর্বপরিচিত ডা. নজরুল কর্তৃক জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। জেএমবিতে যোগদান করার পরে নজরুল তার নাম দেন রিপন। প্রাথমিকভাবে তার দায়িত্ব ছিল ইয়ানতের (চাঁদা) সংগ্রহ করে নজরুলের কাছে পৌঁছে দেয়া। ডা. নজরুল তখন জেএমবি একাংশের আমীর ছিলেন। আস্থাভাজন হিসেবে রিপন অল্প সময়ের মধ্যে নজরুলের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মুফতি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে রিপন জানিয়েছে, সেই সময়ে জেএমবির নব নিযুক্ত আমীর হিসেবে সারোয়ার জাহান সংগঠনের জন্য অর্থ ও দাওয়াতি কার্যক্রম বেগবান করার উদ্যোগ হাতে নেয়।

এরই অংশ হিসেবে মামুনুর রশিদ রিপনের এলাকায় বিকাশের দোকান লুট করে ৬ লাখ, সিগারেট বিক্রেতার কাছ থেকে ছিনতাই করে ১ লাখ এবং গাইবান্ধা থেকে আরো ১ লাখ টাকা ছিনতাই করে সারোয়ার জাহানের কাছে পাঠিয়ে দেয়। সারোয়ার জাহানের মাধ্যমে জঙ্গিদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও মদতদাতা আব্দুল্লার সঙ্গে রিপনের পরিচয় হয়। রিপনের বরাত দিয়ে র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৫ সালের মাঝামাঝিতে তামিম চৌধুরী ও সারোয়ার জাহানের গোপন বৈঠকে সমঝোতার মাধ্যমে স্মারকপত্র তৈরি করা হয়। তখন সারোয়ার জাহানকে আমীর নির্বাচিত করা হয় এবং সাংগঠনিক নাম দেয়া হয় শায়েখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ। একই বৈঠকে রিপনসহ আরো অনেককে শূরা সদস্য মনোনীত করা হয়।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ পহেলা জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে হামলা চালায় জঙ্গিরা। তারা অস্ত্রের মুখে দেশি বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে রাখে। জঙ্গিদের গুলিতে নিহত হন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা। পরের দিন সকালে সেনা কমান্ডের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ মোট ছয়জন নিহত হয়। পরে পুলিশ ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছিল। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরেক রেস্তোরাঁকর্মী। ওই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মোট ২১ জনের সম্পৃক্ততা খুঁজে পান। তাদের মধ্যে ঘটনাস্থলে মারা যান ৫ জন। আরো ৮ জন জঙ্গি বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। ঢাকার সন্ত্রাস বিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে হোলি আর্টিজান হামলার মামলায় বিচার কাজ চলছে। বর্তমানে এই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের কাজ চলছে।

গত বছরের ২৬শে নভেম্বর এই মামলায় ৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত। পরে ৩রা ডিসেম্বর থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে তারা হলেন, রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাতকাটা সোহেল মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, রাশেদ ইসলাম, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ রিপন। এই আটজনের মধ্যে শরিফুল ইসলাম এখনো পলাতক রয়েছেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status