দেশ বিদেশ

চার রংয়ের স্টিকারে চিহ্নিত হবে রেস্তরাঁয় খাবারের মান

স্টাফ রিপোর্টার

২১ জানুয়ারি ২০১৯, সোমবার, ৯:৫০ পূর্বাহ্ন

কাঁচে ঘেরা, বর্ণিল আলোয় খাবারের আয়োজন। নান্দনিক পরিবেশ রাজধানীর নামিদামি প্রায় সব রেস্তরাঁয়। নাগরিক জীবনে বন্ধু, পরিবার নিয়ে মাঝেমধ্যেই খেতে হয় এসব রেস্তরাঁয়। ভোজনরসিক বা নিয়মিত বাইরে খেতে যাওয়া মানুষেরা রেস্তরাঁর বাইরের পরিবেশ নিয়ে যতটা খুঁতখুঁতে, ঠিক ততটা সচেতন নন কিচেনের পরিবেশের বিষয়ে। রান্নাঘরের পরিবেশ নিয়ে খুব একটা ভাবার সময় নেই তাদের। তবে, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএসএফএ) গত কয়েক মাসের অভিযানে উঠে এসেছে রাজধানীর রেস্তরাঁগুলোর ভেতরের চিত্র। নোংরা পরিবেশে রান্না, ভেজাল কাঁচামালসহ প্রায় নানা অনিয়ম দেখা গেছে বেশির ভাগ নামিদামি রেস্তরাঁয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বেশিরভাগ রেস্তরাঁয় গত বছরের শেষের দিকে অভিযান চালায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। গত বছরের ২৭শে অক্টোবর অভিযান চালানো হয় মিরপুরের ইয়ান তাই ও পিজা ইন রেস্তরাঁয়। বেসিনে একসঙ্গে সব ধরনের মাংস ও ছেঁড়া পলিথিনে সবজি ভিজিয়ে রাখা, পচা-বাসি সবজি, নোংরা ডালের পাত্র, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে নিজেরাই মেয়াদের তারিখ বসানো ও থালাবাসন ধোয়ার জায়গায় ময়লা-আবর্জনা থাকায় দুটি রেস্তরাঁকেই চার লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। তারও দুই দিন আগে অভিযান চলে রাজধানীর মিরপুর এলাকায়। নিয়ম না মানায় জরিমানা করা হয় শ্যামলী লিংক রোডের প্রিন্স ও চিলিস চাইনিজ হোটেলকে। ফাঙ্গাশ পড়া গাজর, বেসিনের ময়লা পানিতে থালাবাসন ধোয়া, ফ্রিজে খোলা অবস্থায় নাড়িভুঁড়িসহ মুরগির মাংস রাখা ছিল সেখানে। মুরগির মাংস কেটে নিচে রাখা হয়েছে ময়লা পরিষ্কার করা দুটি ঝাড়ুর পাশে। রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়েছে নোংরা সাদা গাদযুক্ত তেল, মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য উপকরণ। ধানমন্ডির চাইনিজ জিনডিয়ান ও শংকর হান্ডি, ভাগ্যকুল মিষ্টি সবখানে যেন অনিয়মই নিয়ম। ফাঙ্গাশ পড়া দই বড়া, অস্বাস্থ্যকর ফ্রাইড চিকেন নোংরা পরিবেশে দোসা তৈরি, পচা গাজর আর শসার সালাদ, পুরনো নুডলস, পোড়া তেলে ভাজা, নোংরা পরিবেশে রাখা ছানা, মিষ্টির সিরায় তেলেপোকাসহ অন্যান্য পোকার অস্তিত্ব পাওয়া যায় অভিযানে। অভিযানে ব্যাপক অনিয়ম পাওয়ায় জরিমানা করে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করা হয় এসব রেস্তরাঁকে। তবে এসবের বিপরীত চিত্রও মিলেছে কিছু রেস্তরাঁয়। শ্যামলী লিংক রোডের নবাবী ভোজ, তাজমহল রোডের বিএফসি এবং পাবুলুম ক্যাফের কিচেনে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ পাওয়ার কথা জানিয়েছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে রেস্তরাঁ খাতে শুদ্ধতা আনতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে নিরাপদ খাদ্য এলাকা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো খাবার মান ও কিচেনের পরিবেশ বিবেচনায় সবুজ, নীল, হলুদ ও কমলা চারটি রংয়ে চিহ্নিত করে দেয়া হচ্ছে রেস্তরাঁগুলোকে। মানের দিক থেকে একেবারে এগিয়ে থাকলে পাওয়া যাবে সবুজ রংয়ের এ প্লাস স্টিকার। পরের ধাপ অনুযায়ী বাকি তিনটি। রাজধানীর রেস্তরাঁগুলোর খাবারের মান ও পরিবেশ নিরাপদ রাখতে চারটি ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করা শুরু করেছে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ। গতকাল রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকার একটি হোটেলে এই কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে মোট ৫৭টি রেস্তোরাঁকে সবুজ ও নীল রংয়ের স্টিকার তুলে দেন। এর মধ্যে ১৮টি রেস্তরাঁ ছিল উত্তমমানের এ প্লাস ক্যাটাগরির ও বাকি ৩৯টি ভালো মানের এ ক্যাটাগরির। খাবার টেবিলে বসে কিচেনের ভেতরের পরিবেশ দেখা গেলে মিলবে স্বীকৃতি। কিচেন থাকতে হবে কাঁচে ঘেরা দেয়ালে। যাতে খাবার গ্রহিতা সহজেই রান্নাঘরের পরিবেশ সম্বন্ধে ধারণা পান। এছাড়া, কিচেনের ভেতরকার পরিবেশ মনিটরের মাধ্যমে সুবিধাজনক জায়গায় দেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এসব বিষয়ে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য ও অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির বলেন, ‘বি’ ক্যাটাগরির হলুদ রংয়ে চিহ্নিত রেস্টুরেন্টগুলোকে তাদের মান ভালো করতে তিন মাসের সময় দেয়া হবে। এর মধ্যে তারা নিজেদের মান উন্নত করতে না পারলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই রকমভাবে ‘সি’ ক্যাটাগরির কমলা রংয়ে চিহ্নিত রেস্টুরেন্ট এক মাসের মধ্যে নিজেদের পরিবেশ ঠিক করতে না পারলে বন্ধ করে দেয়া হবে। এছাড়া নিয়মিত অভিযান চলবে বলেও জানান তিনি। মাহবুব কবির বলেন, সব হোটেলের কিচেন দৃশ্যমান থাকতে হবে। কাঁচ, সিসি ক্যামেরা ও মনিটর রাখতে হবে যাতে করে ভোক্তা খুব সহজেই কিচেনের ভেতরের পরিবেশ দেখতে পারে। রাজধানীতে যেসব হোটেলে অভিযান চালানো হয়েছে সেগুলোকে এক মাস সময় দিয়ে নোটিশ দেয়া হচ্ছে। নির্দেশনা অনুুযায়ী সবুজ স্টিকার পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলে স্থায়ী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। রেস্তরাঁগুলোর গ্রেডিং ও তথ্য নিয়ে একটি মুঠোফোন অ্যাপ তৈরির কাজ চলছে। অ্যাপটি চালু হলে যে কেউ রেস্তরাঁর পরিবেশ নিয়ে তাতে অভিযোগ ও মতামত জানাতে পারবেন। এছাড়া, অ্যাপেও পাওয়া যাবে নিরাপদ রেস্তরাঁর সব তথ্য। এছাড়া নিয়মিত অভিযানের বিষয়ে মাহবুব কবির আরো বলেন, আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা এখন স্বাধীন। অফিস থেকে বের হয়ে নিজেই ঠিক করেন কবে কোথায় অভিযান পরিচালনা করবেন। প্রথমে জরিমানার মাধ্যমে সতর্ক করা হলেও নির্দেশনা না মানলে রেস্তরাঁ বন্ধ করে দেয়া হবে বলেও জানান। তিনি বলেন, এই প্রথমবারের মতো দেশের জনগণ দেখবে তালাচাবি, সিলগালা করার প্রক্রিয়া। কোনো তদবিরেই লাভ হবে না। মান অনুযায়ী রেস্তরাঁ চিহ্নিত করা ও অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা, পল্টন, তোপখানা, গুলিস্তান ও সচিবালয় এলাকায় ফুড সেইফটি জোন বা নিরাপদ খাদ্য এলাকা তৈরির কাজ চলছে। এসব এলাকার রেস্তরাঁ মালিক ও কর্মীদের দেয়া হচ্ছে বিশেষ প্রশিক্ষণ। হোটেল-রেস্তরাঁগুলোর কর্মী ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে নিরাপদ পরিবেশের ব্যাপারে বেশ আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। বাংলাদেশ রেস্তরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব রেজাউল করিম সরকার বলেন, আমরা আর জরিমানা দিতে চাই না। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগে রেস্তরাঁ মালিকদের মধ্যে পরিবেশের মান উন্নয়নে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এমন উদ্যোগে খুশি সাধারণ ভোক্তারাও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল নিরব বলেন, ‘প্রতিদিন না হলেও প্রায় সময়ই বাইরে খেতে হয়। বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অভিযানের খবর পত্রিকায় দেখলে গা গুলিয়ে ওঠে। বাইরে আর খেতে ইচ্ছে করে না। তবে ভালো রেস্তরাঁগুলোকে চিহ্নিত করা গেলে আর সমস্যা হবে না।’ রাজধানী ঢাকার পুরো ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, মিরপুর, উত্তরা, বনানী ও গুলশান এলাকা এবং চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ-জিইসির মোড় এলাকায় প্রাথমিক পর্যায়ে চালু করা হবে নিরাপদ খাদ্য এলাকা বাস্তবায়নের কাজ। ধীরে ধীরে সব জেলায় জেলায়ও পাইলট রেস্টুরেন্ট ও হোটেলের মাধ্যমে সারা দেশে নিরাপদ খাদ্যের বার্তা পৌঁছে দেয়া হবে বলেও জানান মাহবুব কবির। তবে এক্ষেত্রে জনবল সংকটের বিষয়টিকে সামনে টেনে নিয়ে আসেন তিনি। মাত্র ১৭ থেকে ১৮ জন জনবল দিয়ে কাজ করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং বলেও জানান এই কর্মকর্তা। বলেন, জনবল বাড়ানোসহ পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা পেলে নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন আরো বেগবান হবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status