দেশ বিদেশ

জিআরওর কাজ করে উমেদার, বেতন কাটছে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে

ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম থেকে

২০ জানুয়ারি ২০১৯, রবিবার, ৯:৫৫ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার প্রতিটি থানার তদন্তে থাকা মামলার নথি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকেন আদালতে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও)। কিন্তু আদালত পুলিশের ওই শাখার কাজ করার জন্য উমেদার নিয়োগ করেন জিআরওরা।
যদিও উমেদার সরকারের অনুমোদিত বৈধ কোনো পদ নয়। তবুও বিভিন্ন মামলার নথিপত্র লেখাসহ আদালতের গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার জন্য মৌখিকভাবে নিয়োগ করা হয় এই উমেদার। যাদের প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেতন দেন জিআরওরা। আর এই টাকা নানা ফাঁদে ফেলে আদায় করা হয় বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে।
আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ও মহানগর পুলিশের আওতাধীন ৩২টি থানা রয়েছে। প্রতিটি থানার জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক জিআরও। আর প্রত্যেক জিআরও শাখায় কাজ করার জন্য একাধিক পুলিশ সদস্য নিয়োগ আছে। এরপরও প্রত্যেক জিআরও শাখাগুলোতে রয়েছে এক বা একাধিক উমেদার।  
সূত্র জানায়, বাৎসরিক ছুটির দিন বাদে প্রতি বছর কর্মদিবস থাকে প্রায় ২৫০ দিন। প্রতি উমেদারের দৈনিক পাঁচশ’ টাকা বেতন হিসেবে ধরলেও প্রতিবছর উমেদারদের আয় কমপক্ষে ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এই টাকার পুরোটাই আদায় করা হয় বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে।
অভিযোগ রয়েছে, মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে জিআরও শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্য, কিংবা আদালতে কর্মরত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পুলিশ শাখার এসব উমেদার নিয়োগ করেন। দিন শেষে বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে নেয়া টাকা থেকে তাদের বেতন দেন জিআরও শাখার পুলিশ সদস্যরা।
এ সুবাদে নিজেদের কাজ উমেদারদের ওপর চাপিয়ে ঘুরে-ফিরে, আরাম-আয়েশ করে দিন কাটান পুলিশ সদস্যরা। অনেক পুলিশ সদস্য উমেদারদের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে, মামলার নথিপত্রের কোথায় কি কাজ করতে হবে সেটিও ঠিকমতো জানেন না। উমেদার ছাড়া একদিনও জিআরও শাখা চালাতে পারবেন না বলেও মনে করেন অনেক পুলিশ সদস্য।
বিচারপ্রার্থীরা জানান, নিয়োগপ্রাপ্ত উমেদারের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। কোনো কোনো উমেদার আদালত এলাকায় মাদকসহ গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। কর্ণফুলী থানার জিআরওতে কাজ করা সম্রাট নামের এক উমেদারকে গত বছর ১ হাজার ৬০০ ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক তপন কুমার শর্মা।
পরে তিনি জামিনে মুক্তি পেয়ে ফের জিআরও শাখায় উমেদার হিসেবে কাজ করছেন। তাকে গ্রেপ্তারের কিছুদিন পর মহানগর মালখানায় উমেদার হিসেবে কাজ করা নুরুজ্জামানকে একটি চুরির ঘটনায় আদালত প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তার করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে জামিনে এসে একই জায়গায় কাজে যোগ দেয় নুরুজ্জামান।
অভিযোগ রয়েছে, আদালতের জিআরও শাখার পুলিশ কর্মকর্তাদেরকে দুর্নীতিপরায়ণ করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা আছে উমেদারদের। বিচারপ্রার্থী জনগণের পকেট কাটার বুদ্ধি পরামর্শ দেন উমেদাররা। দায়িত্বরত পুলিশের অগোচরে মামলার গোপনীয় নথিপত্র সংশ্লিষ্টদের সরবরাহ করে টাকা আয় করেন উমেদাররা।
এ ছাড়া মামলায় জামিন নেয়া, রিমান্ড আবেদন বাতিল করে দেয়াসহ বিভিন্ন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েও টাকা হাতিয়ে নেয় উমেদাররা। এ ছাড়াও মামলা সংগ্রহ করে পরিচিত আইনজীবী বা আইনজীবী ক্লার্কদের দিয়ে কমিশনও আদায় করেন তারা।
বৃহস্পতিবার সকালে সরজমিন দেখা যায়, চট্টগ্রামের নতুন আদালত ভবনের ২১৫, ২৪২, ২৪৪ ও ২৪৮ নম্বর কক্ষে মহানগর পুলিশের আওতাধীন থানার জিআরও শাখার পুলিশ সদস্যরা কাজ করেন। এর মধ্যে ২৪২ নম্বর কক্ষে চান্দগাঁও, বায়েজিদ বোস্তামী, কর্ণফুলী, হালিশহর, আকবর শাহ, সদরঘাট ও কোতোয়ালি থানার জিআরও শাখার পুলিশ সদস্যরা বসে কাজ করেন। সেখানে দেখা যায় চান্দগাঁও থানার জিআরও শাখায় দুইজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে দুইজন উমেদার, বায়েজিদ থানার তিনজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে একজন, হালিশহর ও কর্ণফুলীতে দুইজন পুলিশের সঙ্গে একজন, আকবর শাহ ও বন্দর থানার জিআরওতে তিনজন পুলিশের সঙ্গে দুইজন এবং কোতোয়ালি থানার জিআরওতে চারজন পুলিশের সঙ্গে চারজন উমেদার কাজ করছেন।
২৪২ নম্বর কক্ষে ডবলমুরিং, পাহাড়তলী, পাঁচলাইশ, চকবাজার, বাকলিয়া, ইপিজেড ও পতেঙ্গা থানার জিআরও কাজ করেন। চকবাজার ও বাকলিয়া থানার জিআরও শাখায় দুইজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে দুইজন উমেদার, খুলশী জিআরও শাখায় একজন, পাঁচলাইশ ও হালিশহর জিআরও শাখায় দুইজন পুলিশের সঙ্গে দুইজন, ডবলমুরিং জিআরও শাখায় দুইজন পুলিশের সঙ্গে দুইজন উমেদার কাজ করছেন। ২৪৪ নম্বর কক্ষে মহানগর পুলিশের সিআই ও সিএসআই পুলিশ সদস্যরা কাজ করেন। এই শাখায়ও রয়েছে দুইজন উমেদার।
২৪৮ নম্বর কক্ষে মহানগর পুলিশের নারী ও শিশু জিআরও শাখা, নন-জিআর শাখা ও মোটরযান শাখা। এই তিন শাখায় পুলিশের সাতজন পুলিশ সদস্য কাজ করেন। উক্ত শাখা তিনটিতে কাজ করছেন তিনজন উমেদার। তারা হলেন- নন-জিআর শাখায় সুকুমার, নারী ও শিশু শাখায় আজম, মোটরযান শাখায় রহিম।
মহানগর পুলিশের নারী ও শিশু জিআরও সেকশনে উমেদার হিসেবে ছয় বছর ধরে কর্মরত মো. আজম। তিনি বলেন, নির্ধারিত কোনো বেতন নেই। কোনোদিন ৫০০, কোনোদিন ৬০০, কোনোদিন ৭০০ টাকা বেতন পাই। জিআরও সাহেব এই টাকা দেন।  মহানগর পুলিশের জিআরও শাখায় মোট কতজন উমেদার আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রত্যেক জিআরওতে গড়ে দুইজন করে উমেদার আছে। তবে মোট কতজন আছে তা বলতে পারবো না। এদিকে উমেদার দিয়ে কাজ করানোর একই দৃশ্য দেখা গেছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের জিআরও শাখাগুলোতেও। চট্টগ্রামের মুখ্য বিচারিক হাকিম ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে বোয়ালখালী, আনোয়ারা, চন্দনাইশ, ফটিকছড়ি, ভুজপুর, রাউজান, রাঙ্গুনিয়া, মিরসরাই ও জোরারগঞ্জ থানার জিআরও শাখা। এর বাইরে টিন শেড একটি ভবনের দুইটি কক্ষে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চট্টগ্রাম রেলওয়ে থানার কার্যক্রম চলে। জেলা পুলিশের আওতাধীন থানাগুলোর জিআরও শাখায় অন্তত ১৩ জন উমেদার কাজ করছেন।
এরমধ্যে বোয়ালখালী থানার জিআরও শাখায় দুইজন পুলিশের সঙ্গে একজন, হাটহাজারী থানার পুলিশের জিআরও শাখায় জুয়েল ও তার ভাইপো, সীতাকুণ্ড জিআরও শাখায় দুইজন পুলিশের সঙ্গে দুইজন কাজ করছেন। ফটিকছড়ি থানার জিআরওতে ফারুক, রাউজানের জিআরওতে বিন্দু, মীরসরাই থানার জিআরওতে নিজাম, চন্দনাইশ জিআরওতে আনোয়ার, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়াতে নজরুল উমেদার হিসেবে কাজ করছেন। অন্যদের নাম জানা যায়নি।
নিয়ম অনুযায়ী নিজের কাজ উমেদার দিয়ে করার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির দুর্নীতি দমন ও টাউট উচ্ছেদ কমিটির আহ্বায়ক ইয়াছিন খোকন বলেন, বিচারপ্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য জিআরও, পেশকার, সেরেস্তাদাররা তাদের পছন্দের লোকজনকে উমেদার হিসেবে রাখেন। হাতিয়ে নেয়া টাকা দিয়েই উমেদারদের বেতন দেয়া হয়। অনিয়ম, দুর্নীতি রোধ করার জন্য ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে আইনজীবী সমিতি। আদালত এলাকা থেকে উমেদারদের উচ্ছেদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, জিআরও শাখার পুলিশ সদস্যগণ উমেদার দিয়ে কাজ করাতে পারেন না। বিষয়টি দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status