প্রথম পাতা

গণশুনানিতে বাম জোটের প্রার্থীদের বয়ান

রাতেই ৪০-৬০ ভাগ ব্যালটে সিল মারা হয়

স্টাফ রিপোর্টার

১২ জানুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ১০:০৫ পূর্বাহ্ন

গণশুনানিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের প্রার্থীরা তুলে ধরেছেন নির্বাচনে অনিয়মের চিত্র। বলেছেন, আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে ভোটের বাক্স ভর্তি করার কথা। তাদের সবার কথা- ৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচন হয়নি। হয়েছে ভোট ডাকাতি। রাতে ভোট কেটে নিলেও দিনে ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বারণ ছিল। ফাঁক গলিয়ে যারা গিয়েছেন তাদেরও প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে। বের করে দেয়া হয় এজেন্টদের। তারা জানিয়েছেন, এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল এই শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী এই গণশুনানিতে বাম জোটের ৮২ প্রার্থী নিজ নিজ আসনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

প্রার্থীরা বলেছেন, এই নির্বাচন মানুষের অধিকারের প্রতি ভয়াবহ আঘাত। বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে আর সুষ্ঠু নির্বাচনের অবস্থা নেই। জনগণ এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। নতুন করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে।

৮টি বাম গণতান্ত্রিক জোট দিনব্যাপী এই গণশুনানির আয়োজন করে।

গণশুনানিতে প্রার্থীরা যা বললেন: পিরোজপুর-১ আসনের বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কাস্তে প্রতীকের প্রার্থী তপন বসু বলেন, আমার সেন্টারে গিয়ে দেখি আমার ভোট নেই। আমার পরিবারের ১০টি ভোটের মধ্যে একটি ভোট দিতে পেরেছি। তা আমার মেয়ের ভোট। কিন্তু সেটি আবার নৌকার প্রতীকে প্রকাশ্যে দিতে বলেছে আওয়ামী লীগের লোকজন।

ঢাকা-১২ আসনের বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির কোদাল প্রতীকের প্রার্থী মো. জোনায়েদ আবদুর রহিম সাকি (জোনায়েদ সাকি) বলেন, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ভোট আগের রাতেই সিল মারা হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে ব্যালট বক্স ভরে যায়। বেলা ১১টার পর থেকে কেন্দ্রগুলোতে প্রকাশ্যে সিল মারতে থাকে আওয়ামী লীগের লোকজন। এই নির্বাচনে ভোট ইচ্ছামতো গণনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে এই নির্বাচনের মতো কলঙ্কজনক নির্বাচন আর হয়নি। এই নির্বাচন বাতিল করতে হবে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে মানুষের ভোটাধিকারের প্রতি ভয়াবহ আঘাত করা হয়েছে। দেশে দলীয় সরকারের অধীনে আর সুষ্ঠু নির্বাচনের অবস্থা নেই। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে এবং পরে একতরফা পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার উপর ভর করে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে।

দিনাজপুর-৪ আসনের সিপিবি’র প্রার্থী মো. রেয়াজুল ইসলাম বলেন, তার আসনে রাত ১২টা থেকে ৩টার মধ্যেই ৬০ শতাংশ ভোট শেষ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মানুষের ভোট ডাকাতি করেছে। এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছি। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দেশে দ্রুতই নতুন নির্বাচন দাবি করেন এই প্রার্থী।

ঢাকা-৬ আসনের সিপিবির প্রার্থী আবু তাহের হোসেন বলেন, ইভিএম-এ একটি ভোটও দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভোট দিয়ে বলেছে যে আপনার ভোট হয়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করে গণশুনানিতে বলেন, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দিয়েছে। যারা তাদের পরিচিত ছিল কেবল তাদের ভোট দিতে দিয়েছে।

অনুষ্ঠানে নেত্রকোনা-২ আসনের সিপিবি’র (কাস্তে প্রতীক) প্রার্থী মোশতাক আহমেদ বলেন, একাদশ নির্বাচনে ভোট ডাকাতি হয়েছে। ২৯ তারিখ রাতেই এই ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা আওয়ামী লীগের মেগা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করেছে। তিনি তার জীবনে প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, এরকম নির্বাচন কখনো দেখিনি। তিনি অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনের আগে তরুণ ভোটারদের চাকরির ভয় দেখানো হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা এ বলে হুমকি দিয়েছিল যে নৌকায় ভোট না দিলে চাকরি হবে না।

চট্টগ্রাম-১১ আসনের কোদাল প্রতীকের বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটির অপু দাস গুপ্ত গণশুনানিতে বলেন, কেন্দ্রগুলোত নৌকার লোক ছাড়া আর কেউ ছিল না। স্কুল শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্প করতে শুনেছি যে তারা একজনে অনেক ভোট দিয়েছে। তিনি বলেন, ভোট ডাকাতি হয়েছে। এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন চাই।

পটুয়াখালী-৪ আসনের বাসদ’র মই প্রতীকের প্রার্থী জহিরুল আলম বলেন, সকাল থেকেই আওয়ামী লীগের লোকজন ঘুরে ঘুরে কেন্দ্রে ১০/২০টি করে সিল মেরেছে।

বরিশাল-৫ আসনের বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির আবদুস সাত্তার (কোদাল প্রতীক) বলেন, ভোটের দিন তার আসনে সাড়ে ৮টার পর ভোট ডাকাতির উৎসব হয়েছে। প্রচার করতে পারিনি। কোনো পোস্টার লাগাতে পারিনি। ভাটিখানা কেন্দ্রে তাদের দলের এক সদস্য ব্যালট পেপার হাতে নিয়েও ভোট দিতে পারেনি। তার ভোট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা দিয়ে দিয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। যদি দেশে ফেয়ার নির্বাচন হতো তাহলে আওয়ামী লীগ চতুর্থ হয়ে যেত।

কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী খন্দকার মোসলেহ উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নাটক শুরু হয়ে যায়। নির্বাচনের দিন তার আসনের প্রায় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বলেছে ব্যালট পেপার নেই। ২৯ তারিখ রাতেই ভোট দিয়ে বাক্স ভরে রাখা হয়েছে।

ঢাকার-১৫ আসনের সিপিবি’র প্রার্থী আহাম্মদ সাজেদুল হক বলেন, তার আসনে ২৮ ও ২৯ তারিখে এক প্রকার কারফিউ ছিল। মনিপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ৪০ শতাংশ ভোট আগের রাতেই হয়ে যায়। তিনি বলেন, ঘর থেকে মানুষ বের হয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও ভোট দিতে পারেনি। ভোট চুরি নয়, ডাকাতি হয়েছে। তিনি সংসদ ভেঙে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করেন।

নেত্রকোনা-৪ আসনের সিপিবির প্রার্থী জলি তালুকদার বলেন, আমরা প্রচার চালাতে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের আক্রমণের শিকার হয়েছি। তারা আক্রমণ করে এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। নির্বাচনের দিন তার ৫০টি কেন্দ্রের এজেন্টদের বের করে দেয়ার অভিযোগ করেন তিনি।

ঢাকা-১৭ আসনের বাসদ’র মই প্রতীকের এসএম আহসান হাবিব বলেন, তিনি ৩৭টি কেন্দ্রে ঘুরে অনিয়ম পেয়েছেন। ভাসানটেক কেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন কিন্তু গেটবন্ধ । ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ছাত্রলীগের ২০-২৫ জন নিয়ম ভেঙে ঘোরাফিরা করছে। তিনি আরো বলেন, নির্বাচনে ভুয়া এজেন্টের ছড়াছড়ি ছিল।

বগুড়া-৩ আসনের বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী মো. লিয়াকত আলী বলেন, নির্বাচন ২৯ তারিখ রাতেই হয়েছে। তাকে বাধা দেয়া হয়েছে। আমার মাকে ভোট দিতে দেয়া হয়নি। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাইনি।
নরসিংদী-৪ আসনের সিপিবির প্রার্থী কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, ভোট ডাকাতি হয়েছে। বাংলাদেশে ভোট হয়নি। তার আসনে রাতেই ৩৫ শতাংশের উপরে ভোট হয়ে যায়।

 চাঁদপুর-৩ আসনের বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী আজিজুর রহমান বলেন, ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। দেশে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে।

রংপুর-৩ আসনের আনোয়ার হোসেন বাবলু বলেন, ইভিএম নিয়ে মানুষের ধারণা পরিষ্কার হয়নি। আমার ভোট দেয়ার জন্য আঙ্গুলের ছাপ আসেনি। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার তার আঙ্গুল দিয়ে আমারটা ঠিক করি দিলেন। প্রশিক্ষণের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়নি নির্বাচনে।

কুষ্টিয়া-৩ আসনের মই প্রতীকের প্রার্থী বাসদের শফিউর রহমান শফি বলেন, নির্বাচনের প্রচারণায় পুলিশ বাধা দিয়েছে। পুলিশ বলেছে সরকারবিরোধী কোনো বক্তব্য দিলে জনগণ ক্ষেপে গেলে তাদের করার কিছু থাকবে না।
ময়মনসিংহ-৪ আসনের সিপিবি’র প্রার্থী এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। তার আসনের ১৭৬টি কেন্দ্রের প্রায় একই চিত্র। এজন্য ওই দিনই নির্বাচন বর্জন করেছি।

গাইবান্ধা-২ আসনের সিপিবি’র প্রার্থী মিহির কুমার ঘোষ বলেন, ভোটের অনিয়ম শুরু হয় আগের দিন থেকেই। ভোটের দিন এজেন্ট বের করে দিয়েছে। তখন প্রিজাইডিং অফিসারকে এই অভিযোগ দিলে তিনি বলেন, বাড়ি চলে যান।
 টাঙ্গাইল-২ আসনের সিপিবির প্রার্থী জাহিদ হোসেন খান বলেন, তার আসনের ১২৭টি কেন্দ্রের ২১টিতে তিনি পরিদর্শন করেছেন। সব কেন্দ্র দখল করে আওয়ামী লীগকে সিল মারতে দেখেছেন। প্রিজাইডিং অফিসারের রুমে বসেও সিল মারতে দেখেছি। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং মহাজোট এক হয়ে ভোট ডাকাতি করেছে। ডিজিটাল আইনের ভয়ে মোবাইলে ছবি তুলিনি।

ফেনী-৩ আসনের বাসদের মই প্রতীকের প্রার্থী হারাধন চক্রবর্তী বলেন, আওয়ামী লীগের কিছু লোক বলেছে টাকা দেন, ভোট সংগ্রহ করে দিবো। তার কর্মীদের উপরেও হামলা হয়েছে। তার কর্মীদের ভোটকেন্দ্রে গেলে লাঞ্ছিত করার হুমকি দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নয়। ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের আন্দোলন করতে হবে।
রংপুর-৪ আসনের বাসদের মই প্রতীকের প্রার্থী মো. সাদেক আলী বলেন, যে কেন্দ্রেই গিয়েছি দেখি আমার সামনে নৌকা প্রতীকে সিল মারছে।

 পটুয়াখালী-১ আসনের সিপিবি’র প্রার্থী বলেন, সকাল ৯টা ৪৬ মিনিটে তার সামনে একটি কেন্দ্রে স্থানীয় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ পর পর লাইনে লোক দাঁড় করায়। তিনি বলেন, পুলিশ ষষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী দিয়ে ৫টি ব্যালেটে সিল মারায়। ওই শিক্ষার্থী এটাকে দুর্নীতি বললে পুলিশ শিক্ষার্থীকে বলে, এটা দুর্নীতি না।
 লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের বাসদের প্রার্থী মিলনকৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, আগের রাতেই ৬০ শতাংশ ভোট হয়। তার আসনের তিনটি ইউনিয়ন থেকে এমন খবর আসে।

সিলেট-১ আসনের বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী উজ্জ্বল রায় বলেন, এমসি কলেজ কেন্দ্রে সকাল ১০টার পর আর ভোটারদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। তিনি এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন দাবি করেন।

 কুড়িগ্রাম-৪ বাসদের প্রার্থী আবুল বাসার মঞ্জু বলেন, বিকাল ৩টার দিকে তাকে একজন প্রিজাইডিং অফিসার বলেছেন, ভোট কাস্ট হয়ে গেছে। এই প্রার্থী বলেন, রাতে ভোট কাস্ট হলে সারাদিন প্রিজাইডিং অফিসারকে বসে থাকতে হয় না।
গাইবান্ধা-৪ আসনের বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী মো. ছামিউল আলম বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রে পিকনিক উৎসব ছিল। ভোট খাওয়ার পিকনিক ছিল এটি। সিরাজগঞ্জ-২ আসনের বাসদের প্রার্থী নব কুমার কর্মকার বলেন, নির্বাচনের আগের রাতেই সিল মারা হয়েছে।

ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়া বাম জোটের প্রার্থী আসাদুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবেই স্থানীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন বাম জোটের প্রার্থীরা। কিন্তু অনুমতি না থাকায় শহীদ মিনারে ফুল দিতেও আমাদের বাধা দেয় স্থানীয় পুলিশ। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে জানানোর পরও তেমন কোনো ফলই পাওয়া যায়নি। এমনকি প্রচারণার সময় তোপের মুখেও পড়তে হয় বলে তিনি জানান।

শরীফুর জামান শরীফ (বাগেরহাট-৪) আসন থেকে নির্বাচন করেন। নির্বাচনের বিষয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা জানানোর সময় তিনি বলেন, এবার নির্বাচনটি সত্যিই অন্যরকম নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন নির্বাচন আর একটিও হয়নি। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগের দিন স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে লাল ও নীল এই দুই রঙের গেঞ্জি বিতরণ করা হয়। এবং বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা প্রিজাইডিং অফিসার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্দেশ দেয়া হয়, এই দুই রঙের গেঞ্জি পরা কর্মীদের কথা শুনে চলতে হবে। তারা যেইভাবে বলবে, সেইভাবে কেন্দ্রের মধ্যে কার্য পরিচালনা করতে হবে।

খালেকুজ্জামান লিপন (ঢাকা-৭) বলেন, আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের কথা বাদ দিলাম। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে খোদ পুলিশই আমাদের ব্যানার-পোস্টার ঝুলাতে বাধা দিয়েছে। এমনকি ভোটের আগে সন্দেহভাজন এলাকাগুলোতে মহাজোটের কমীদের সঙ্গে মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে হুমকি দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সরকারি দলের পোলিং এজেন্ট ছাড়া কোনো কেন্দ্রেই ঢুকতে দেয় হয়নি অন্য প্রার্থীর এজেন্টকে।

জনার্ধন দত্ত নান্টু (খুলনা-৩) বলেন, ভোট গ্রহণের পূর্বে ব্যালট বাক্সগুলো খালি আছে কিনা পোলিং এজেন্টের সামনে পরীক্ষা করে দেখানোর কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। তিনি বলেন, জনসম্মুখে ভোট ডাকাতির মধ্যে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে যেই শিক্ষা দেয়া হলো, তা এই দেশের ভবিষ্যতের জন্য কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না।

মানবেন্দ্র দেব (গাজীপুর-৪) বলেন, সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলেছে এবার ভোট উৎসব হয়েছে। আর এই উৎসবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনসহ পুরো নির্বাচনী কাজ সম্পন্নকারী কর্মকর্তারা।

মজিবুর হাওলাদার (ঢাকা-৩) বলেন, নির্বাচনে প্রার্থীদের পলিং এজেন্টদের নিয়োগের জন্য যেই কার্ডগুলো দেয়া হয়, তাও আমার ভাগ্যে জোটেনি। নির্বাচন কমিশন থেকে আমাকে বলা হয়, সব কার্ড শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি দেখেছি, আওয়ামী লীগের একাধিক কর্মী পুলিং এজেন্টের কার্ড গলায় ঝুলিয়ে কেন্দ্রের ভিতর-বাইরে চলাচল করছে। ভোট দিতে আসা ভোটারদের সবার সামনেই বলা হচ্ছে ব্যালটে সিল মারতে। নৌকা বাদে অন্য কোনো প্রতীকে সিল মারলেই সেগুলোকে বাক্স থেকে আলাদা করে ফেলে দেয়া হচ্ছে।

সজীব সরকার রতন (নেত্রকোনা-২) বলেন, পরাধীন দেশে মানুষকে নির্যাতন করা হয় সবাই জানে। কিন্তু এখন আমাদের এই স্বাধীন দেশের মানুষই নির্যাতনের স্বীকার হচ্ছে। নিজে কানে শোনা এক ঘটনার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, নির্বাচনের দিনে দুই পুলিশ সদস্য নিজেদের মধ্যে কথা বলছে যে, এবার তো অনেক কষ্টে ভোট মেরে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা লাগলো। এরপর থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হবে, সরাসরি বিজি প্রেস যেখানে ব্যালট ছাপানো হয়, সেখান থেকেই নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বিতরণ করতে।

রঞ্জন কুমার দে (বগুড়া-৫) বলেন, পুলিশি সহায়তায় ভোটের আগের রাতেই নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছে। এমনকি ভোটের দিন প্রিজাইডিং অফিসারের রুমের ভিতর পুলিশের পাহারায় নৌকায় সিল মেরে ব্যালট বক্স ভর্তি করা হয়েছে। আর কথিত ভোটগ্রহণ শেষে ব্যালট গণনা না করে শুধু বইয়ের মুড়ি গুনে নিজেদের ইচ্ছামতো ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে।

দীলিপ কুমার পাইক (পিরোজপুর-৩) বলেন, জনসম্মুখে ধারালো অস্ত্র নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালায় মহাজোট প্রার্থী। তিনি বলেন, এক কাঁধে লাঙল ও অন্য হাতে রাম দা, স্যান দাসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালায়। আর এই ভীতিকর পরিবেশে প্রশাসনের সহায়তায় নিজেদের ইচ্ছামতো সাজানো নির্বাচন করেছে মহাজোট।

প্রহসনের এই নির্বাচন সম্পন্ন করায় নির্বাচন কমিশনের কাছে নিজেদের জামানতের ২০ হাজার টাকা, সিডি বাবদ ১৬ হাজার টাকা এবং নিজেদের অর্থায়নে ভোটের লিস্ট ছাপানোর টাকা ফেরত চায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের বাম জোটের প্রার্থী শাহরীয়ার মো. ফিরোজ, সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের আবদুল আলীম ফকির, মৌলভীবাজার-৩ আসনের মো. মগনু মিয়া, সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের শেখ মো. মোস্তফা নুরুল আমীন, ময়মনসিংহ-৩ আসনের হারুণ আল বারীসহ প্রমুখ প্রার্থীরা।

গণশুনানি শেষে বাম জোটের পক্ষ থেকে জোটের প্রধান সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম বলেন, আমরা এই গণশুনানির আয়োজন করেছি শুধুমাত্র সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনের প্রকৃত অবস্থা ও পরিবেশ সম্পর্কে নিজেরা জানতে ও দেশের মানুষকে জানাতে। আর এটা সব থেকে সঠিক বলতে পারবেন একজন প্রার্থী নিজেই। তাই আমাদের এই আয়োজন। তিনি বলেন, আমরা সকলের অভিযোগগুলো শুনেছি। আগামী ১৫ই জানুয়ারি আমরা শীর্ষ পর্যায়ে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছি। সেখানেই আলোচনা হবে আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে।

গণশুনানিতে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) এর সাধারণ সম্পাদক মো. খালেকুজ্জামান, আবদুল্লাহ আল-কাফি রতন প্রমুখ। সারা দেশের মোট ১৩১টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বাম জোটের মোট ১৪৭ জন প্রার্থী তাদের অভিজ্ঞতা ও নির্বাচনী পরিবেশের চিত্র তুলে ধরতে উপস্থিত ছিলেন। তবে সময় স্বল্পতায় আজকে মোট ৮২জন সদস্য তাদের অভিজ্ঞতার কথা উপস্থাপন করেন। বাম জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি এই গণশুনানিতে অংশ নেয় মানবাধিকার কমিশন, দেশি-বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক গ্রুপের প্রতিনিধি, সংবাদকর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের অতিথিবৃন্দ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status