এক্সক্লুসিভ

নয়া সুপার পাওয়ার?

অনিম আরাফাত

১২ জানুয়ারি ২০১৯, শনিবার, ৯:০৭ পূর্বাহ্ন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে শুধু তিনটি বিশ্বশক্তিকেই সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। দেশগুলো হচ্ছে- সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটিশ সাম্রাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। এদের মধ্যে প্রথম দেশ দুটি কোনো না কোনোভাবে তাদের এই শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রই এখন সত্যিকার অর্থে বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি। কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে একটা রাষ্ট্রকে সুপার পাওয়ার হিসেবে গণ্য করা হবে তার কোনো ধরা-বাঁধা নিয়ম নেই। তবে ধরে নেয়া হয় যে, পরাশক্তি হয়ে উঠতে হলে একটি রাষ্ট্রকে অবশ্যই অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষাক্ষেত্রে সেরা হয়ে উঠতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এরকম একটি রাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকতে হবে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের সামরিক বাহিনীর বিচরণ থাকতে হবে। ১৯৮০ সালে বিশ্বাস করা হতো জাপানই হতে চলেছে বিশ্বের পরবর্তী পরাশক্তি। কিন্তু নানা কারণে সেটা কখনোই আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এ মুহূর্তে বিশ্বে আরেকটি রাষ্ট্রের পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। খুব বেশি দ্বিমত ছাড়াই সকলেই মেনে নেবে রাষ্ট্রটি হচ্ছে চীন।

কিন্তু পরাশক্তি হয়ে ওঠা কী এতই সহজ? যুক্তরাষ্ট্রই সব থেকে ভালো করে জানবে পরাশক্তি হওয়ার জন্য অতিরিক্ত কত কিছু করতে হয়। একটা বিশাল সেনাবাহিনীর ব্যয় বহন, আধুনিকতম অস্ত্র উৎপাদন ও ক্রয়, বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক মিশন পরিচালনা ও বিদেশি বিভিন্ন রাষ্ট্রকে সাহায্য প্রেরণসহ ব্যাপক অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হয় একটি পরাশক্তিকে। তাই পরাশক্তি হওয়ার যুদ্ধে নামার আগে চীনের মনে রাখা উচিত আড়াই হাজার বছর আগে চৈনিক জেনারেল সান জুর লেখা বিখ্যাত দ্য আর্ট অব ওয়্যার বইয়ের কথা। সেখানে যুদ্ধের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রথমেই খরচ সম্পর্কে ভাব। অর্থাৎ পরাশক্তি হিসেবে আত্ম প্রকাশের পূর্বে চীনের কমিউনিস্ট সরকারকে মিলাতে হবে অনেক হিসাব- নিকাশ।

সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো চীন আসলে কোন ধরনের পরাশক্তি হতে চায়। নিশ্চিতভাবেই চীন সবার আগে এশিয়া মহাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এটি চীনের জন্য সহজ ও তারা সেপথে খুব দ্রুততার সঙ্গেই এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আঞ্চলিক পরাশক্তি আর বৈশ্বিক পরাশক্তির মধ্যে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। যেটা বৃটিশ সাম্রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র করতে পেরেছে সেই অর্থে চীনের এখনো অনেক দূর যাওয়ার বাকি। পরাশক্তি হতে হলে তার বিশ্বের যে কোনো স্থানে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষমতা থাকতে হবে। এ জন্য বিশ্বজুড়ে একটি দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ, সামরিক ঘাঁটি, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব থাকা জরুরি। চীন এসব ক্ষেত্রে কতখানি এগিয়েছে?

ঝাং উইনিং একজন চীনা ব্যবসায়ী ও প্রফেসর। কিন্তু তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি যখন চীন যাই সেখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের কথা শোনার চেষ্টা করি। তাদের আলোচনার বিষয়গুলো হলো- প্রযুক্তি, ব্যবসার মডেল। কিন্তু যখন আমি টেক্সাসে ফিরে আসি, সেখানকার আলোচনাগুলো হয় অনেক ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা সরকার, আইন ও নানা রাজনৈতিক আলাপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। প্রফেসর ঝাং বলেন, চীনের মানুষ শুধু চিন্তা করে কীভাবে আরো বেশি ধনী হওয়া যাবে। তারা নতুন নতুন ব্যবসায় আগ্রহী, নতুন প্রযুক্তিতে আগ্রহী। যখন কেউ শুধু রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় সেটা তার জীবনে কোনো কাজে আসে না। এর জন্য কেউ তাকে টাকা দিচ্ছে না। চীনের সরকার কাজের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াটাকেই উৎসাহিত করছে।

আর এসব কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে নিশ্চিতভাবেই চীন ইতিমধ্যে পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেশটির অর্থনীতি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। তাদের ক্রয়-সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চীনের মানুষ প্রতি দিন আগের দিন থেকে ধনী হয়ে উঠছে। এ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে চীনাদের মাথাপিছু আয় দ্রুত বাড়তে শুরু করে। গত ২০ বছরে দেশটির মাথাপিছু আয় বেড়েছে ৮ গুনেরও বেশি! পাশাপাশি দেশটিতে দীর্ঘদিন এক সন্তান নীতি থাকায় চীনের জনসংখ্যা এখন নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২০২৩ সালের পর থেকে চীনের জনসংখ্যা কমতে শুরু করবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এ সফলতা চীনকে পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশে সাহায্য করবে।

পরাশক্তি হয়ে ওঠার আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি। বাস্তবতা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এ দিক থেকে চীন এখনো অনেক পেছনে রয়েছে। কিন্তু সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যেতে চীন বদ্ধপরিকর। ইতিমধ্যে দেশটি তার প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হয় রাশিয়াকে। চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট রাশিয়ার তিন গুনেরও বেশি। ১৯৮৯ সালে যেখানে চীনের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল মাত্র ১৯ বিলিয়ন ডলার ২০১৬-তে এসে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ২২৮ বিলিয়ন ডলারে। প্রতি বছর এই বাজেট বেড়েই চলেছে। একবিংশ শতাব্দীর আধুনিকতম সমরাস্ত্র কিনে নিজের সেনাবাহিনীকে যেকোনো দেশের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করছে দেশটি। চীন সর্বশেষ যুদ্ধ করেছিল ১৯৭৯ সালে, প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভিয়েতনামের সঙ্গে। কিন্তু এরপর দেশটির সেনাবাহিনীকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা করে তোলা হয়েছে। চীন নিজেই তার প্রয়োজনের ৮৫ ভাগেরও বেশি অস্ত্র উৎপাদনে সক্ষম। দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব বিস্তার তার আত্মবিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। চীনের নৌবাহিনীও এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সাবমেরিন ও ক্ষেপণাস্ত্রের দিক থেকে দেশটি এ অঞ্চলে সেরা হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের থেকে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সংখ্যায় পিছিয়ে থাকলেও থেমে নেই চীন। বিশ্বজয়ের জন্য সবার আগে শক্তিশালী নৌবাহিনী দরকার, সেটি মাথায় রেখেই নিজ দেশে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করছে চীন।

রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীন যেদিকে বেশি পিছিয়ে আছে সেটি হলো পরমাণু বোমা। যেখানে রাশিয়ার ও যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু বোমার সংখ্যা যথাক্রমে ৭৮০০ ও ৭৫০০, সেখানে চীনের পরমাণু বোমা মাত্র সাড়ে চারশর মতো। দেশটি মূলত নতুন ও আধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী। এর মধ্যে রয়েছে, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, সাইবার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

পৃথিবীর ৪২ দেশে কমপক্ষে ৫১৬টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তি হয়ে উঠতে যা অনেক বেশি সাহায্য করেছে। সেই একই পথে হাঁটতে থাকা চীনও প্রথমবারের মতো জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটি নিজ এলাকা থেকেই প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। পাশাপাশি, ভারতীয় মহাসাগরেও নিজের প্রভাব বাড়িয়ে তুলেছে চীন। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে চীনের প্রভাব এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই। দেশগুলো নানা কারণে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকছে। এশিয়া ছাড়িয়ে আফ্রিকা এমনকি লাতিন আমেরিকাতেও চীনের প্রভাব বেড়ে চলেছে। পরাশক্তিতে পরিণত হতে যেসব দিকে নজর দেয়া দরকার, তার সবগুলোতেই এগিয়ে যাচ্ছে চীন। প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যাগুলোকে যেভাবে জয় করে এসেছে এবং এখনো লড়াই করে চলেছে, দেশটি তাতে অদূর ভবিষ্যতেই নিজ লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের আরেকটি শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে চীন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status