এক্সক্লুসিভ

সিজিএস-এর সেমিনারে বক্তারা

যেনতেন নির্বাচন সংকট আরো গভীর করবে

স্টাফ রিপোর্টার

২৩ ডিসেম্বর ২০১৮, রবিবার, ৯:৪১ পূর্বাহ্ন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা বলেছেন, যেনতেন নির্বাচন দেশে সংকট আরো গভীর করবে। ভোটাররা নিশ্চিন্তে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন কিনা এ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত হবে কিনা সেই প্রশ্নও তুলেছেন। এছাড়া ভালো নির্বাচনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের যে ভূমিকা থাকার ছিল তা নিয়ে অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, গণমাধ্যম এক থাকলে তিনদিনের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যাবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকে পালন করতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। গতকাল রাজধানীর পুরাতন এলিফ্যান্ট রোডে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) মিলনায়তনে ‘নির্বাচন ও গণমাধ্যম’ শীর্ষক সেমিনারে তারা এসব কথা বলেন। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর উদ্যোগে এই সেমিনারের আয়োজন করা হয়। বক্তরা আরো বলেন, নির্বাচন ঘিরে তৈরি হওয়া সংকট রাজনীতিবিদদেরই সৃষ্টি। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ রাজনীতিবিদদেরই তৈরি করতে হবে।  নির্বাচনের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যার ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারে।

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, যেনতেন নির্বাচন সংকট আরো গভীর করবে। এতে ভোটের টার্নওভারে অ্যাফেক্ট হবে। ভোটারদের আগ্রহ হারিয়ে যাবে। সরকার নৈতিকতার চ্যালেঞ্জর সম্মুখীন হবে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য অর্থবহ নির্বাচনে জবাবদিহিতামূলক শাসন ব্যবস্থা জোরদার হয়। এটা মানুষের ইচ্ছা। এখন মুখ্য বিষয় হচ্ছে হয়ে দাঁড়িয়েছে- ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবেন কি-না। বাস্তবতা দেখা দিয়েছে এখন একপেশে মাঠ। বিরোধী দল অনুপস্থিত।

গায়েবি মামলা অব্যাহত রয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে উদ্বেগের বিষয় তৈরি হয়েছে। হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এখন রাজনৈতিক প্রচারণা রাজনৈতিক শক্তি-সক্ষমতা প্রদর্শনের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে দলীয় সমর্থন প্রদর্শনের বিষয় নয়। অন্ধ দলীয় সমর্থন করার মধ্যে একটা তফাত থাকা উচিত। বাংলাদেশে বৃহৎ দু’দলের সমর্থন আছে। অন্ধ সমর্থন দেশে ১০ থেকে ১৫ ভাগ। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশ দুটি শিবিরে বিভক্ত। এটা সঠিক নয়, অসত্য কথা। এর বাইরেও একটি শীর্ষ গ্রুপ আছে দেশে। জবাবদিহি ব্যবস্থা তৈরি করে তারা।

তিনি বলেন, সার্বিকভাবে মানুষ ঐক্যবদ্ধ। সাবেক এই উপদেষ্টা বলেন, এই মুহূর্তে বাংলাদেশে  মিডিয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকলেও শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে আছে। তিনি আরো বলেন, পেশাগত মর্যাদা যাই দেখছি, সঠিকভাবে উপস্থাপন করছে মিডিয়া। ভোটাররা কেন্দ্রে নির্ভয়ে যেতে পারবে কিনা তা গণমাধ্যম তুলে ধরবে। ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারবেন কিনা, এ বিষয়ে গণমাধ্যমের একটা বড়ধরনের দায়িত্ব আছে। উদ্বেগ এবং আশা মাথায় নিয়ে গণমাধ্যম একটা ভূমিকা রাখবে আশা করি। তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেনতেন নির্বাচন যেন না হয়। আইনি বৈধতার নির্বাচন যেন না হয়, পরবর্তী সরকারের নৈতিক বৈধতা যদি তৈরি না হয় তাহলে কিন্তু সংকট আরো গভীর হবে। তাই নির্বাচনে কে নির্বাচিত হবে সেটা ভোটারদের উপরই আমরা ছেড়ে দেই।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, জনগণ সম্পৃক্ত থাকলে নির্বাচন হবে। সুষ্ঠু সঠিক নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, বিভিন্ন দল বলেছে সেবাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেবাবাহিনী মোতায়েনের কথা বলেছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আর্মি সব সময় লাগে। আর্মি ছাড়া ইলেকশন হবে না। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ভালো নির্বাচন হোক। মিডিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচনকে মিডিয়া কতখানি প্রভাবিত করতে পারে। দেশে শত শত কাগজ বের হচ্ছে। মিডিয়ার কর্র্মীদের প্রশিক্ষণ কম। কোনো কিছুর পটভূমি বুঝতে তাদের প্রশিক্ষণ দরকার। বিএনপি ২০১৪ সালে নির্বাচনে না গিয়ে অনেক সমর্থক হারিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ভারতীয় সাংবাদিক এবং সাউথ এশিয়ান মনিটরের নির্বাহী নির্বাহী সম্পাদক চন্দন নন্দী বলেন, জেনারেল জিয়া হত্যায় জড়িত একজন মেজর মোজ্জাফল ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে কলকাতায় অবস্থান করছেন। এটা তিনি শুনে আসছেন। তিনি বলেন, র’ যে বাংলাদেশের নির্বাচনে সংযুক্ত এটা এখন আর সিক্রেট (গোপন) না। মিডিয়ার ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার চেয়ে দুর্বল।

মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সাংবাদিকতায় যে সংকট তৈরি হয়েছে তার জন্য কাকে দায়ী করবেন। সরকারকে দায়ী করার আগে নিজেদের আত্মসমালোচনার দরকার আছে। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি তিনদিনের মধ্যে পাল্টে দেয়া সম্ভব- যদি সাংবাদিকরা নিজেদেরকে জবাবদিহিতার মধ্যে নিয়ে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে সাংবাদিকরা কিছু প্রাপ্তির আশায় পেশার প্রতি অবিচার করছেন।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদুু বলেন, ধীরে ধীরে আমরা একটি অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছি। ছাত্রজীবন থেকেই আমরা নিজেদের মতো করে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি, আবার সেগুলো অতিক্রমও করেছি। কিন্তু বর্তমানে এক অন্ধকার জায়গায় বাস করছি আমরা। অনেকেই বলছে, ২৪ তারিখের পরে সেনাবাহিনী নামবে- এই ২৪ তারিখের পরে দেশ অন্ধকার হবে নাকি আলোকিত হবে সেটির জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। কারণ পুলিশ প্রশাসন  তো এক পক্ষ নিয়ে ফেলেছে যার যতটুকু আছে ততটুকু করছে তারা।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, গণতন্ত্র আছে কিনা তা নিয়ে আমি চিন্তিত। গণতন্ত্র নেই,  রোগে এর ধমনিগুলো শুকিয়ে গেছে। দেশে পেশাদার সাংবাদিকের যথেষ্ট অভাব আছে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার এবং সাবেক জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, টকশোতে গেলে হাতে চাপ দিয়ে ধরে বলেন আমাদের বিপদে ফেলবেন না। মিডিয়া এককভাবে দায়িত্ব পালন করে না, অন্যরা যদি সঠিক দায়িত্ব পালন না করে তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তিনি বলেন, ইসি চূড়ান্ত করার পর দেখি উচ্চ আদালত একাধিক প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল করেছে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। উচ্চ আদালত এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারে না।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক সালেহ আহমেদ বলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়েছে, ভোট দিতে পারবো কিনা। প্রথম আলোর কনসালটেন্ট আয়শা কবির প্রশ্ন করে বলেন, আসলে কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে। মানুষ ভোট দিতে পারবে কিনা আতঙ্কে আছেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে ইংরেজি দৈনিক নিউএজ-এর সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, মানুষের ভোট দেয়ার পরিস্থিতি  এই মুহূর্তে হুমকির মুখে। যে পরিস্থিতি আছে তা কারো জন্য মঙ্গলজনক নয়। পত্রিকার সূত্র ধরে বলেন, নির্বাচন হবে কিনা- এখনও সংশয় আছে। নির্বাচন কমিশন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সার্চ কমিটি মেরুদণ্ডহীন নাগরিক তাদের মধ্যে থেকে অনুগত লোককে খুঁজে নিয়োগ দিয়েছে। বেছে বেছে অফিসারদের ওএসডি করা হয় এবং অনুগতদের দায়িত্ব দেয়া হয়। 

খুঁজে বের করা কমিশনার একজন বিব্রত হন, একজন কমিশনার আরেকজনকে মিথ্যাবাদী বলেন। এই নির্বাচনে কোন পেশার কত শতাংশ প্রার্থী প্রতিযোগিতা করছেন তার একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরেন তিনি। এতে দেখা যায়- সবচেয়ে বেশি ব্যবসায়ীরা ৫৫ শতাংশ। ১১ শতাংশ আইনজীবী। ৭ শতাংশ কৃষি, ৬ শতাংশ বিভিন্ন পেশার, ৪ শতাংশ পলিটিশিয়ান এবং ১৭ শতাংশ নানা পেশার মানুষ রয়েছেন। এই নির্বাচনে এখনো অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি বা কোনো ব্যবস্থা নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। কাজেই আগামী দিনে সংঘর্ষ হবে না তা নিশ্চিত হতে পারিনি।

১৬ জন প্রার্থী কারাগারে। প্রতিদিন ৩ থেকে ৪শ’ গ্রেপ্তার হচ্ছেন। বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয়েছে। প্রবন্ধে তিনি বলেন, নির্বাচনে মিডিয়ার গুরুত্ব আছে। কিন্তু মিডিয়ার যে  আচরণ- বেশির ভাগই জনগণের স্বার্থের বাইরে গিয়ে দলের হয়ে কাজ করছে। জনগণের দু’দলের  বিভাজনের মতো মিডিয়াতেও বিভাজন প্রকট। সরকার চেষ্টা করে নিজের অনুগতদের নিউজ ম্যানেজমেন্টে বসানোর। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী  মিডিয়া উপ-কমিটিতে ৭৫ জন সাংবাদিক রয়েছেন, যারা সামাজিকভাবে সম্মানিত। প্রবন্ধকার আশা প্রকাশ করে বলেন, কোনদিন এর ইতিবাচক পরিবর্তন হবে।

সিজিএস-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে এবং সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা-জানিপপ-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, দৈনিক দিনকাল-এর সম্পাদক ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী, ডা. সাখাওয়াত হোসেন শায়েন্থ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান, সিজিএস-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status