দেশ বিদেশ

চা শিল্পে দাসপ্রথার রেশ এখনো আছে: টিআইবি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১৯ ডিসেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১:৫৯ পূর্বাহ্ন

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলেও চা শিল্পে এখনো রেশ রয়ে গেছে। চা শ্রমিকদের সরাসরি দাস বলা যাবে না। তবে তাদের যে মৌলিক অধিকার তা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকার, শিল্প মালিক, চা সংসদ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দায় রয়েছে। গতকাল টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি। ‘চা বাগানের কর্ম-পরিবেশ ও শ্রমিকদের অধিকার: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে টিআইবি এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সময় টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান, গবেষণা তত্ত্বাবধান ও সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. ওয়াহিদ আলম উপস্থিত ছিলেন।

প্রবন্ধ উপস্থাপনে বলা হয়, দেশের বিভিন্ন খাতের মধ্যে তুলনামূলক কম মজুরি পান চা বাগানের শ্রমিকেরা। চা বাগানের একজন স্থায়ী শ্রমিককে দৈনিক ১০২ টাকা মজুরি, রেশন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাড়িভাড়া, ভবিষ্যৎ তহবিল ইত্যাদির মাধ্যমে মালিকেরা যে সুবিধা দেন, তার সম্মিলিত মূল্য দাঁড়ায় মাসে ৫ হাজার ২৩১ টাকা। বিপরীতে দেশের জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিকেরা সর্বনিম্ন ১৬ হাজার টাকা মজুরি পান। কমের মধ্যে কটন শিল্পের শ্রমিকেরা পান সর্বনিম্ন ৫ হাজার ৭১০ টাকা। চা বাগানে একটি অংশের শ্রমিক অস্থায়ী, তাদের মজুরি আরো কম। সংস্থাটি বলেছে, অনেক বাগানে শ্রমিকদের খাল বা ছড়ার পানিও পান করানো হয়। পানি পানের জন্য গ্লাসও দেয়া হয় না।
চা শ্রমিকেরা আধুনিক দাস কিনা প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৃটিশ আমলে ভারত থেকে দাস হিসেবে মানুষকে ধরে এনে চা বাগান করা হয়েছিল। সেই অবকাঠামো এখনো রয়ে গেছে। তিনি বলেন, এখন আইনি কাঠামো এসেছে। ঘাটতি থাকার পরও শিক্ষা, চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা হয়েছে। তাই আমি একে দাসপ্রথা বলবো না। আপনারা চাইলে দাসপ্রথার বর্তমান প্রজন্ম বলতে পারেন।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, চা শ্রমিকদের ওপর জরিপের তথ্য নিয়ে মালিকদের সমিতির কাছে যাওয়ার পর তারাও বিব্রত হয়েছে। মালিকেরা বলেছেন, তাদের মুনাফা হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে, মালিকেরা শ্রমিকদের জীবনমানে পরিবর্তনে আগ্রহী। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সরকারেরও উদ্যোগ ও সহযোগিতা দরকার। তিনি বলেন, চা বোর্ড ৯৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে চা শিল্পের জন্য একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়েছে। যার মধ্যে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নের বিষয়টি আছে। এটি বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

টিআইবির জরিপে বলা হয়, দেশে বর্তমানে ২২৯টি চা বাগান আছে। এর মধ্যে মূল বাগান ১৫৩টি, ফাঁড়ি বাগান ৭৬টি। এসব বাগানে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার শ্রমিক কাজ করেন, যার প্রায় ২২ হাজার অস্থায়ী। জরিপ করা হয়েছে সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের ৬৪টি চা বাগানের ওপরে। এসব বাগানের ১ হাজার ৯১১ জন স্থায়ী শ্রমিকের কাছ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।

জরিপে চা বাগানের কয়েকটি ইতিবাচক দিক উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে কোনো শ্রমিক চাকরি ছাড়লে বা অবসরে গেলে পরিবারের একজনকে চাকরি দেয়া হয়। শ্রমিক ও তাদের পোষ্যদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা আছে। ভবিষ্যৎ তহবিল ও সাপ্তাহিক অবসর ভাতা দেয়া হয়। শ্রমিক ও পোষ্যদের রেশন দেয়া হয়। অবশ্য এসব সুবিধার ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের চিত্রও উঠে এসেছে টিআইবির জরিপে।

৬৪ বাগানের ওপর জরিপে উঠে আসে যেকোনো বাগান তার মুনাফার অংশ শ্রমিককে দেয় না, যদিও তা আইনে আছে। কোনো বাগানে গোষ্ঠী বীমা নেই। তিন মাস শিক্ষানবিশ থাকার পর স্থায়ী করার নিয়ম থাকলেও কোনো বাগানেই তা মানা হয় না। কোনো বাগানেই নিয়োগপত্র নেই, আবার ৯৩ শতাংশ বাগানে শ্রমিকদের নিয়োগ সংক্রান্ত কোনো নথিই দেয়া হয় না।

টিআইবি বলছে, ২৩টি বাগানে কাজের সময় শ্রমিকদের ছড়া, কুয়া বা খালের পানি পান করতে দেয়া হয়। হাত পেতে শ্রমিকেরা পানি পান করেন, কোনো গ্লাস দেয়া হয় না। বাগানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শৌচাগার নেই। ১১টি বাগানে চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। ৭৫ শতাংশ শ্রমিককে বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে হয়েছে, যার মধ্যে ৪৮ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছেন কম্পাউন্ডারের কাছ থেকে। মাত্র ২২ শতাংশ চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা পেয়েছেন। শ্রমিকদের অনেক ক্ষেত্রে ঘর মেরামত করতে হয় নিজেদের টাকায়, যদিও তা মালিকদের দেয়ার কথা। শ্রমিকদের অঙ্গহানি হলে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণও ঠিকমতো দেয়া হয় না।

জরিপ অনুযায়ী ৫৬টি বাগানে অ্যানালগ যন্ত্রে পাতা ওজন করা হয়। ওজন করার সময় নির্দেশক কাটা অনুসরণ করতে চাইলে শ্রমিকদের ধমক ও শাস্তি দেয়া হয়। শ্রমিকেরা অভিযোগ করেন, গামছার ওজন, পরিবহনের সময় পাতা পড়ে যাওয়া, বৃষ্টিতে পাতার ওজন বেড়ে যাওয়াসহ কোনো কারণ ছাড়াই পাতার ওজন কম দেখানো হয়। টিআইবির হিসাবে, পাতার ওজন কম দেখানোর প্রাক্কলিত মূল্য সপ্তাহে ৩১ লাখ টাকা।

জরিপে বলা হয়, বেশির ভাগ বাগান কর্তৃপক্ষ ক্ষমতাবান ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের খুব কাছাকাছি থাকায় সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে প্রতিবেদন উপস্থাপনে ভয় পায়। তদারকি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ঘুষ-দুর্নীতির আশ্রয়ও নেন।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status