প্রথম পাতা

উচ্চ আদালতে হাজারো জামিনপ্রার্থী, দুর্ভোগ

নাজমুল আহসান রাজু

১২ ডিসেম্বর ২০১৮, বুধবার, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

গায়েবি অভিযোগে সারা দেশে মামলার পর উচ্চ আদালতে ভিড় করছেন আগাম জামিনপ্রার্থীরা। প্রতিদিন হাজারো জামিনপ্রার্থী ধরনা দিচ্ছেন উচ্চ আদালতে। বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে কিশোর ও নারী আসামিরাও আসছেন সুপ্রিম কোর্টের আঙ্গিনায়। জামিন শুনানির দীর্ঘ  সারির কারণে কেউ কেউ আদালতের বাইরের বারান্দায় বসেছেন, কেউ দাঁড়িয়ে বা কেউ আবার পত্রিকা বিছিয়ে অপেক্ষায় থাকেন কখন ডাক পড়ে। যারা একই মামলার আসামি তারা থাকছেন কাছাকাছি বা একত্রে। আদালত ডাকলেই হাজির হতে হবে সামনে। সাধারণ আগাম জামিনের প্রার্র্থীকে সশরীরে হাজির হয়ে আদালতের সামনে দাঁড়াতে হয়।

আইনজীবীরা বলেছেন, হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলার কারণে আগাম জামিন আবেদনের হার বেড়ে গেছে। আগাম জামিন প্রার্থীদের ৯৫ ভাগ মামলাই রাজনৈতিক হয়রানিমূলক। যা গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিত। অধিকাংশ হয়রানিমূলক মামলায় ৬০ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হলেও অজ্ঞাত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয় আরো দুই থেকে পাঁচশ জনের নাম।

তারা বলেছেন, এজাহারে নাম না থাকলে আগাম জামিনের জন্য বিচারিক আদালতে হাজির হওয়া যায় না আবার জামিন আবেদন করা হলেও জামিন নামঞ্জুর হলে গ্রেপ্তারের আশঙ্কা থেকে যায়। এ সুযোগে পুলিশি হয়রানির ভয়ে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা বাসা বাড়িতে থাকতে পারছেন না। ফলে পুলিশের হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে তারা উচ্চ আদালতে আগাম জামিন আবেদন করছেন।

সেপ্টেম্বর থেকে এ চিত্র নিত্যদিনের। প্রতিদিনই হাইকোর্টের এনেক্স (বর্ধিত) ভবনের আদালত কক্ষগুলোর সামনে দেখা মিলছে এমন দৃশ্যের। আগাম জামিন আবেদন বিবেচনার এখতিয়ার সংকুচিত হওয়ায় জামিন আদেশ আসছে চার সপ্তাহ বা আট সপ্তাহের। এ সময় কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকা গেলেও সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে তাদের। সেখানেও আছে শঙ্কা। উচ্চ আদালত জামিন বিবেচনা করলেও বিচারিক আদালত অধিকাংশ ব্যক্তির জামিন নাকচ করে পাঠানো হয় কারাগারে।

সাদা পাঞ্জাবি পরা বয়োবৃদ্ধ আলহাজ মো. মমিন উদ্দিন মাতব্বর এজলাস কক্ষের বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। চেহারায় চিন্তার চাপ। বয়স ৭৭। এসেছেন রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে গায়েবি মামলায় জামিন নিতে। কথা বলতে চাইলে কিছুটা লজ্জিত মো. মমিন উদ্দিন মাতব্বর আমতা আমতা করতে থাকেন। পাশে বসে থাকা আরেক জামিনপ্রার্র্থী অভয় দেন তাকে। কিছুক্ষণ আলাপের পর মুখ খোলেন। বলেন আমার নামে ১৬টি মামলা হয়েছে। নাশকতা, পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়া ও গোপন বৈঠকের। যখনকার ঘটনা তখন আমি মেয়ের কাছে কানাডাতে ছিলাম। সেখান থেকে আসার পর মামলার আসামি হয়েছি।

আক্ষেপ করে বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমি জড়িত নই। শারীরিকভাবে অসুস্থ। ডায়বেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী। বার্ধক্যজনিত সমস্যা তো রয়েছেই। আমার পক্ষে কি সম্ভব নাশকতা বা পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়ার? আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।

পাশে বসে থাকা সাহাবুদ্দিন সাগর দক্ষিণ খান থানা বিএনপির সভাপতি। তিনি বলেন, আমার নামে ৬৬টি মামলা। ১৬টিতে জামিন নিতে এসেছি। মমিন উদ্দিনকে দেখিয়ে বলেন, কিন্তু উনার কি দোষ? কেন উনাকে আসামি করা হলো? এটাই বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র। বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা ঘরে থাকতে পারে না। পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচতে মাসের পর মাস ঘরছাড়া। মা-বাবার সঙ্গে দেখা নেই। স্ত্রী-সন্তানরা কিভাবে আছি জানি না।

বিমানবন্দর থানা বিএনপির সভাপতি জুলহাস পারভেজ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন ৩ মাস ২১ দিন ঘরছাড়া। প্রতিদিনই বাড়িতে পাঁচ-সাতবার হানা দেয় পুলিশ। সাদা পোশাকে মোটরসাইকেলে এসে ধরে নিয়ে যায়। তাই পালিয়ে আছি। ২১ মামলার আসামি জুলহাস আগাম জামিন নিতে এসেছেন। তুচ্ছ একটি অভিযোগের মামলায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার কসবা উপজেলা থেকে এসেছেন নির্মাণ শ্রমিক মো. খোরশেদ আলম। বয়স ৩৮। স্থানীয় ছাত্রলীগের দুই নেতা ফোনে বলছিলেন তোরা বাজারে যাবি না। এটা অমান্য করায় মামলা হলো নামসহ আসামি ৩২। সঙ্গে রয়েছে অজ্ঞাতনামা।  

গত শনিবার বিকাল ৪টায় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকে ট্রেনে রওনা হয়ে কমলাপুর পৌঁছান রাত ১০টায়। ঢাকায় আত্মীয়স্বজন নেই। তাই সেদিন রাত কমলাপুর স্টেশনেই কাটিয়েছেন। সকালে এসেছেন সুপ্রিম কোর্টে। দুপুরে শুনানি হবে তার জামিন আবেদনের। ১০টি মামলায় জামিন নিতে হবে। তিনি জানান, ভাই বোঝেনই তো আমি নির্মাণ শ্রমিক। রাজনীতি করার সুযোগ কই? তারপরেও মামলার আসামি। তার সঙ্গে কসবা থেকে এসেছেন ১৫ বছরের আলাউদ্দিন একই মামলার আসামি।

আলাউদ্দিন বলেন, কসবার কল্যাণসাগর পূর্ব পাড়ে আমাদের বাড়ি। সন্ধ্যা নেমে এলেই স্থানীয় বাজার পুরুষ শূন্য হয়ে পড়ে। বাজার ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের দখলে। অধিকাংশ বাড়িতে রাতে পুরুষরা থাকেন না। কখন পুলিশ হানা দেয় এই আতঙ্কে।

গত রোববার থেকে গতকাল পর্যন্ত সরজমিনে দেখা গেছে, এনেক্স ৭, ১২ ও ১৬ নম্বর বিচার কক্ষের সামনে শত শত আগাম জামিন প্রার্থীর ভিড়। জামিন প্রার্থীরা এজলাসের বাইরের বারান্দা, ও ভেতরের খোলা মাঠে অপেক্ষায় আছেন তাদের আবেদনের শুনানির। এ ছাড়া পুরো সুপ্রিম কোর্ট আঙ্গিনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আগাম জামিন প্রার্র্থীদের অপেক্ষায় থাকা প্রতিদিনের চিত্র। আজ বুধবার ও কাল এ ভিড় আরো বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ বৃহস্পতিবার শেষে শুরু হবে সুপ্রিম কোর্টের ১৭ দিনের অবকাশ ছুটি।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, গায়েবি মামলার কারণে উচ্চ আদালতে জামিন প্রার্থীদের আসতে হচ্ছে। এসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে হয়রানি উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। মামলার ঘটনা ও অভিযোগের কোনো অস্তিত্ব নেই। এ ধরনের মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলার যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

তিনি বলেন, আমি যখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃত্বে ছিলাম তখন আগাম জামিন নিয়ে সাত দফা নির্দেশনার বিরুদ্ধে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো তখন আমাদের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। আমরা সাধারণ মানুষকে হয়রানি থেকে রক্ষা করতে তখন রিভিউ আবেদন করেছিলাম।
গণতন্ত্র ও খালেদা জিয়া মুক্তি আইনজীবী আন্দোলনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনির হোসেন বলেছেন, বিরোধী নেতাকর্মীদের হয়রানি করতে সরকার মিথ্যা অভিযোগে গায়েবি মামলা দায়ের করছে। যারা হয়রানির শিকার হচ্ছে তাদের বেশিরভাগই নিরীহ। সুপ্রিম কোর্ট হলো দেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল। পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে মানুষ সুপ্রিম কোর্টে আসলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাদের জামিন দিয়ে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। বিচারিক আদালত জামিন যোগ্য মামলায়ও জামিন দিচ্ছে না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা আগাম জামিনের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status