শেষের পাতা

বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশীদের শপথ

স্টাফ রিপোর্টার

২১ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ৯:৫৮ পূর্বাহ্ন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন প্রার্থীদের ওয়াদা করিয়েছে বিএনপি। প্রথম দুইদিনের ধারাবাহিকতায় গতকালও দিনব্যাপী ধানের শীষ টিকিটপ্রত্যাশীরা মনোনয়ন বোর্ডে সাক্ষাৎকার দেন। দলের চেয়ারপারসন কার্যালয়ে এ সাক্ষাৎকারে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনার একপর্যায়ে অঙ্গীকার করানো হয় প্রার্থীদের। আহ্বান জানানো হয়, যেকোনো পরিস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ থেকে ধানের শীষের পক্ষে কাজ করার।

সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকার তাগিদও দেয়া হয়। মনোনয়ন বোর্ডে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অংশ নেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের শীর্ষ নেতৃত্ব দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও ঐক্যবদ্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। জনমত তৈরির জন্য দলের প্রত্যেক মনোনয়নপ্রত্যাশীকে নিজ নিজ এলাকায় গণসংযোগ করার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে বিগত দিনে দলের ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তৃতীয় দিন মনোনয়ন বোর্ডের মুখোমুখি হওয়া অন্তত একডজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সময় স্বল্পতার কারণে এবারের জাতীয় নির্বাচনে একক নয় গ্রুপ করে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছে বিএনপি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটি আসন মিলেই ডাকা হচ্ছে সাক্ষাৎকারে। গতকাল বিকালে সিলেট জেলার ছয়টি আসনে ৩৬ জন প্রার্থীকে মনোনয়ন বোর্ডে ডাকা হয়। এসময় দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেন, দেশে গণতন্ত্র নেই। ভোটাধিকার নেই। এই প্রতিকূল অবস্থায় আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপি এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে হবে। নেতৃবৃন্দ বলেন, অন্যায়ভাবে গণতন্ত্রের মা খালেদা জিয়াকে কারাবন্দি করা হয়েছে। নির্বাচন ও আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করতে হবে। নির্বাচনে জনগণের রায় যাতে কেউ কেড়ে নিতে না পারে সেদিকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেন, আজ বিএনপির লাখ লাখ  নেতাকর্মী নির্যাতিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। তারা বিভিন্ন মামলার আসামি। অনেকেই কারাগারে। যারা প্রার্থী হতে চাচ্ছেন তারা প্রায় সবাই একাধিক মামলার আসামি। নির্বাচনে জয়ী না হলে এই নির্যাতন চলতেই থাকবে। নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে, দেশ ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে বিএনপিকে জয়ী হতে হবে। এজন্য জনগণের রায় যাতে কেউ কেড়ে নিতে না পারে সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।

সাক্ষাৎকার শেষে সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই-শাল্লা) আসনের সাবেক এমপি নাছির চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন- দেশ, গণতন্ত্র ও দলের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ থেকে ধানের শীষকে বিজয়ী করতে হবে। এই বার্তা দেয়া হয়েছে সবাইকে। আমরা ত্যাগ ও ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে দলের মনোনয়নপ্রার্থীরা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন জানিয়ে চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনের মনোনয়ন প্রার্থী  কাদের গনি চৌধুরী বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই সবাই কাজ করবে।

কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হবো না বলে আমরা অঙ্গীকার করেছি। এ ছাড়াও দলের নীতিনির্ধারক ফোরামের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট আসনের সাংগঠনিক বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছেন। ঐক্যবদ্ধ থেকে কাজ করার জন্য প্রার্থীদের ওয়াদা করানো হয়েছে জানিয়ে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবুল কাহের চৌধুরী শামীম বলেন, আমরা সবাই ওয়াদা করেছি যাকেই প্রার্থী দেয়া হোক তার পক্ষে কাজ করবো। শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেছেন, দেশের এই দুর্দিনে, দুঃসময়ে ঐক্যের বিকল্প নেই। এই মুহূর্তে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও গণতন্ত্রের মাতা খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সবাইকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ থেকে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। সিলেট-৬ আসনের এই মনোনয়ন প্রার্থী বলেন, দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আশ্বস্ত করেছেন, বিএনপির পক্ষে মানুষের ঢল দেখে সরকার শঙ্কিত, আতঙ্কিত। এটাই প্রাথমিক বিজয়। আরেকটু ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ণ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে যেতে পারলে অচিরেই আমরা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারবো।

সিলেট-১ আসনের মনোনয়ন প্রার্থী মহানগর বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয় খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন। দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানুষ তাদের মৌলিক অধিকার ফিরে পাবেন। চট্টগ্রাম-১২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী সৈয়দ সাদাত আহমেদ বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের বলেছেন- সরকার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে স্কাইপ বন্ধ করে দিয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় তারা কতো জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নোয়াখালী-২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবেদীন ফারুক বলেছেন, তাদের সাক্ষাৎকারে দলের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য আরো সুদৃঢ় হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে এটা আরো শক্তিশালী হয়েছে। লক্ষ্মীপুর-২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ও দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেছেন, দলের হাইকমান্ড তাদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া) আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মোস্তফা নাজমুল আমিন বলেন, ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যগতভাবে এ অঞ্চলের মানুষ জাতীয়তাবাদী ঘরানার। এ আসন থেকে অতীতে একাধিকবার বিএনপির প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে। জোটের রাজনীতির কারণে বিগত দুই নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে বিএনপি। বারবার শরিক দলের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়ায় নানা বঞ্চনার কারণে লোহাগাড়া-সাতকানিয়ার বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে হতাশা। এ আসনের ভোটাররা পরিবর্তন চায়, ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী চায়। আশাকরি, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব তৃণমূলের এ প্রত্যাশার মূল্যায়ন করবেন।

ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী দলের সহ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এর মধ্যে মূল বিষয় ছিল এটা আমাদের মায়ের মুক্তির নির্বাচন। গত ১০ বছরের মধ্যে আমাদের ঐক্যে ফাটল ধরেনি। এই ঐক্য যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। ব্রাহ্মণবাড়ীয়া-৬ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী কৃষিবিদ মেহেদী হাসান পলাশ মানবজমিনকে বলেন, সাক্ষাৎকারে তারেক রহমান আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এতে আমরা ব্যাপক উজ্জীবিত। যিনি মার্কা পাবেন তার পক্ষে কাজ করার ব্যাপারে আমরা ওয়াদাবদ্ধ। আমরা শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবো, মাঠ ছাড়বো না।

এদিকে সোমবার রাত থেকে কার্যালয়ের ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। গতকাল দিনভর সে ইন্টারনেট সংযোগ চালু হয়নি। মোবাইলেও কল ড্রপ হয়েছে। গুলশান কার্যালয় এলাকায় ইন্টারনেটের পাশাপাশি মোবাইল নেটওয়ার্ক দুর্বল পাওয়া গেছে। অন্যদিনের মতো সাক্ষাৎকারকে ঘিরে বিএনপি কার্যালয় এলাকায় সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ। কার্যালয় এলাকায় প্রবেশের মূল রাস্তার দুই মোড়ে ডাইভারশন করা হয়েছে। গাড়িগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় পার্ক করা হয়।

চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেট বিভাগের প্রার্থীরা তৃতীয়দিন সাক্ষাৎকার দেন। চট্টগ্রাম বিভাগের সাক্ষাৎকার নেয়ার আগে কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত নেতাকর্মীরা চট্টগ্রাম-১২ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক এমপি গাজী শাহাজাহান জুয়েলকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করেন, আপনি কবে দেশে এলেন? দলের দুর্দিনে পাশে না থেকে এখন মনোনয়ন চাইতে এসেছেন। দীর্ঘ দশ বছর বিএনপির রাজনীতিতে অনেক নেতাকর্মী নির্যাতিত হলেও আপনাকে পাশে পাওয়া যায়নি।

তবে এ সময়ে জুয়েল কোনো প্রতিবাদ করেননি। একইভাবে চাঁদপুরসহ বেশ কয়েকটি নির্বাচনী আসনের সাক্ষাৎকারের আগে ওই এলাকার নেতাকর্মীরা মনোনয়নপ্রত্যাশী কারও কারও ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। এদিকে সাক্ষাৎকার পর্বের এক ফাঁকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সরকার সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে চায় কি না সে ব্যাপারে তাদের সন্দেহ দেখা দিয়েছে। তফসিল ঘোষণার পরেও পুলিশ একইভাবে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে।

জামিনের জন্য যারা আদালতে যাচ্ছেন বা যারা জামিন পেয়েছেন তাদের জামিনকে বিলম্বিত করা হচ্ছে। তারা কারাগারে থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না। পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে মির্জা আলমগীর বলেন, অতীতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে পুলিশ যে ভূমিকা পালন করেছে তা ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আবারো খবর পাচ্ছি বিশ্বস্ত সূত্রগুলো জানিয়েছে- পুলিশকে দিয়ে আগামী নির্বাচনে কারচুপি করার নীলনকশা তৈরি করা হচ্ছে। যে কর্মকর্তা পুলিশের সদর দপ্তরে বসে পরিকল্পনা করেছিলেন সেই একই পুলিশ কর্মকর্তা আবারো হেডকোয়ার্টারে বসে নীলনকশা তৈরি করছেন। কিভাবে নির্বাচনকে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নিয়ে আসতে হবে এবং কারচুপি করা যাবে তার পরিকল্পনা করছেন। ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে অবিলম্বে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বদলি বা ক্লোজড করার আহ্বান জানাচ্ছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা নিরপেক্ষ প্রশাসন চাই। নির্বাচনের দশদিন আগে থেকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন চাই।

খালেদা জিয়ার আসনে ১৩ মনোনয়নপ্রত্যাশী
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ফেনী-১ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার আশায় সাক্ষাৎকার দিয়েছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টুসহ ১৩ জন। এই আসনটি দীর্ঘদিন ধরে খালেদা জিয়ার জন্য রিজার্ভ থাকলেও এবার দলের নেতারা অনেকেই মনোনয়ন চাচ্ছেন। অন্যরা হলেন, ভলান্টিয়ার্স অব আমেরিকান কমিউনিটি (বাংলাদেশ)-ইউএস’র প্রেসিডেন্ট আবুল হাসেম বুলবুল, এ্যাবের মহাসচিব আনোয়ারুন নবী বাবলা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সভাপতি রফিকুল আলম মজনু, ছাগলনাইয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি নূর আহমেদ মজুমদার, বিএনপি নেতা মাহতাবউদ্দিন মিনার, সাবেক ছাত্রদল নেতা মশিউর রহমান খোকন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক জালাল আহমেদের (কারাবন্দি) পক্ষে তার স্ত্রী, অ্যাডভোকেট আমিনুল হক, পরশুরাম বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব, ভিপি ফখরুল আলম স্বপন, ব্যারিস্টার আনোয়ার হোসেন, নুর নবী ভূঁইয়া ও মানিক।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status