বাংলারজমিন

মদনপুরে দেড়যুগে ১৮ খুন

নূরুজ্জামান মোল্লা, বন্দর (নারায়ণগঞ্জ) থেকে

২১ নভেম্বর ২০১৮, বুধবার, ৮:৪৩ পূর্বাহ্ন

পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বন্দরের মদনপুরে ইউপি সদস্য খলিলুর রহমানকে কুপিয়ে জখম করার ঘটনা শেষ নয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুই পাশে চাঁনপুর ও ফুলহর গ্রামের মদনপুর বাসস্ট্যান্ডের নেতৃত্বের লড়াইয়ে গত দেড়যুগে দুইগ্রুপের মধ্যে দুই নারীসহ ১৮ জন খুন হয়েছেন। এই দুই গ্রামের মধ্যে প্রতিনিয়ত রক্তপাত খুনের বদলে খুন। একসময়ে আতঙ্কের নাম ছিল মদনপুর। মদনপুরের নাম শুনলেই আঁৎকে উঠতো সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। বন্দর উত্তরাঞ্চলের মদনপুর এলাকার ভয়ঙ্কর শীর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান কামরুজামান কামু ও সুরুত আলী মারা যাওয়ার পর গত ৫-৭ বছর এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড খুনখারাপি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মদনপুর এলাকার এক শিল্পপতির পৃষ্ঠপোষকতায় ফুলহর গ্রামের মৃত শরাফত আলী মেম্বারের ছেলে আমির হোসেন এক সন্ত্রাসী বাহিনী গঠন করে আস্তে আস্তে পরিবহন সেক্টর ও স্থানীয় রেলওয়ের জমিতে গড়ে ওঠা দোকানপাটের চাঁদাবাজি তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এসব সেক্টর থেকে প্রতিমাসে ৭০-৮০ লাখ টাকার চাঁদার ভাগ বসাতে খলিল মেম্বার চাঁনপুর এলাকায় এক বাহিনী গঠন করে। এরপর থেকে চাঁদার টাকা উত্তোলন নিয়ে দুইগ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এ নিয়ে খলিল ও আমির গ্রুপের মধ্যে একাধিকবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তারা দুইগ্রুপই ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট। খলিল মেম্বার মদনপুর ইউনিয়ন ৫নং ওয়ার্ডে দুইবার নির্বাচিত হন। তিনি ওই ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি। এলাকাবাসী জানান, ২০০০ সালের আগে উপজেলার মদনপুর মুরাদপুর গ্রামের কামালউদ্দিনকে ট্রাক চাপা দিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। এ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে কামালউদ্দিনের ছেলে কামরুজ্জামান কামু বদলা নিতে সন্ত্রাসী কার্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এ কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিপক্ষ গ্রুপ সন্ত্রাসী কামুকে না পেয়ে তার মা ফুলবিবিকে কুপিয়ে হত্যা করে। পিতা ও মাতার হত্যার বদলা নিতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে কামু। তার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যোগ দেয় তার ছোট ভাই নুরুজ্জামান নুরা, মনিরুজ্জামান মনু, বড় ভাই বাবুল আক্তার ও আবুল হোসেন। পুরো মদনপুর এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সন্ত্রাসী আধিপত্য বিস্তার ও পরিবহন সেক্টরের চাদাবাজির ভাগ বসাতে প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নেয় চাঁনপুর গ্রামের স্বর্ণ মিয়ার ছেলে সুরুত আলী। এ নিয়ে কামু বাহিনী সুরুত আলীর ভাই দলিল লেখক বাতেনকে হত্যা করে। এরপর থেকে মদনপুর এলাকায় একের পর হত্যাকাণ্ড রক্তপাতের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসীদের এক রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়। সুরুত আলী ও কামু দুই বাহিনীর মধ্যে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। যাকে যেখানে পাওয়া যেত সেখানেই হত্যা করা হতো। সুরুত আলী বাহিনীর হাতে কামরুজ্জামান কামুর ছোট ভাই নুরুজ্জামান নুরা ও বড় ভাই বাবুল আক্তার খুন হয়। ওই হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস পর কামুর বড় বোন নিলুফা বেগমকে তুলে নিয়ে হাত-পায়ের রগ কেটে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয় সুরুত আলী বাহিনী। এরপর কামুর ছোট বোন রেহানা বেগমকে তুলে নিয়ে লাশ টুকরা টুকরা করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। এখনো লাশের সন্ধান মেলেনি। এভাবে কামু বাহিনীর সদস্য ঘোড়া দেলোয়ার, ফুলহরের শাহজাহান ও তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মাসুদকেও খুন করা হয়। সর্বশেষ খুন করা হয়েছে ফুলহর গ্রামের ব্যবসায়ী রিপনকে। একইভাবে সুরুত আলী বাহিনীর সদস্য জুলহাস, সামছুল হক, সুমন ও তার ভাই দলিল লেখক বাতেনকে হত্যা করে কামু বাহিনী। এ ছাড়াও কামুর বড় ভাই আবুল হোসেন ও ফুলহর গ্রামের আলী আহম্মদের ছেলে মুকবুল পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। কামুর দুই ভাই ও দুই বোনের হত্যার প্রতিশোধ নিতে সুরুত আলীকে নয়াপুর এলাকায় প্রকাশ্যে হত্যা করে শরীর থেকে মাথা কেটে নিয়ে যায় কামুর বড় ভাই আবুল হোসেন। কামু স্বাভাবিক মৃত্যু ও সুরুত আলী নিহত হওয়ার পর মদনপুরের নেতৃত্ব চলে আসে আমির হোসেনের নিয়ন্ত্রণে। আমির হোসেন মদনপুরের পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করে থাকলেও খলিল মেম্বার ইতিমধ্যে চাঁদাবাজির ভাগ বসাতে ব্যর্থ হয়। খলিল মেম্বার চাঁদাবাজি নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে নিজের ব্যক্তিগত লোক মো. আবুল হাসেম সভাপতি ও মো. কামাল হোসেন সাধারণ সম্পাদক এবং মো. নাসির উদ্দিনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট বন্দর উপজেলাধীন মদনপুর রোড পরিচালনার জন্য একটি উপ-শ্রমিক কমিটি গঠন করে। গত ২৩শে সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি মো. সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক এসএম মাসুদ রানা ওই কমিটির অনুমোদন করেন। ঢাকা-প্রভাকরদী, আড়াইহাজার-গোপালদী ও এশিয়ান হাইওয়ে দিয়ে উত্তরবঙ্গের প্রায় শতাধিক পরিবহন রোডে সুষ্ঠুভাবে চলাচলের সুবিধার্থে এ কমিটি গঠন করে। খলিল মেম্বারের নেতৃত্বে উপ-কমিটি পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এ খবর পেয়ে খলিল মেম্বারের ওপর ক্ষিপ্ত হয় আমির হোসেন। এর জের ধরে হত্যার উদ্দেশ্যে রোববার সকালে খলিল মেম্বারের নিজ অফিসে ঢুকে কুপিয়ে জখম করে। মদনপুর ইউপি চেয়ারম্যান এমএ সালাম জানান, খুন খারাপি অবশ্যই আমরা চাই না। কারণ, জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের লক্ষ্য। ১৮টা বা কয়টা খুন হয়েছে। সেই অঙ্কটা আমার জানা নেই। তবে, সেসব খুনের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের প্রতি ধিক্কার ও নিন্দা জানাই এবং সব খুনের বিচার চাই। তথাপি রোববার মদনপুরে মেম্বারের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ধিক্কার জানাই এবং ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে নিন্দা জানাই। মেম্বারের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status