শেষের পাতা

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জটিলতা

কূটনৈতিক রিপোর্টার

১৫ নভেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৩ পূর্বাহ্ন

শেষ সময়ে এসেও প্রত্যাবাসন নিয়ে জটিলতা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আজ শুরু হচ্ছে কী-না? তা নিশ্চিত নয়। গতকাল দিনভর ঢাকায় এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা রাত অবধি বৈঠকে কাটিয়েছেন। কিন্তু এ নিয়ে কেউই মুখ খেলেননি। তারা একেবারেই চুপচাপ। পররাষ্ট্র সচিব, কর্মকর্তা বা অন্যরা এ নিয়ে আগ বাড়িয়ে একটি শব্দও বলতে চাইছেন না। যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা ‘প্রত্যাবাসনের কোনো তথ্য নেই’ বলে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। উল্লেখ্য, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতি সম্প্রদায়ের আপত্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশ ও মিয়ানমার আজ ৩০টি পরিবারের দেড় শ’ রোহিঙ্গাকে পাঠিয়ে প্রত্যাবাসনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছে।

ওই পরিবারগুলোর সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিনিধিরা গত দুদিনে কথাও বলেছিলেন। তারা স্বেচ্ছায় রাখাইনে ফিরতে চায় কী-না সেটাই ছিল ইউএনএইচসিআর’র মূল জিজ্ঞাসা। জবাবে রোহিঙ্গারা ইউএনএইচসিআরকে কী বলেছে? বা ইউএনএইচসিআর সরকারকে কী জানিয়েছে?

তা নিয়ে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তারা মুখ খুলেননি। তবে রাতে কূটনৈতিক সূত্রে যে খবরা-খবর বেরিয়েছে তা হলো বেশির ভাগ পরিবার পূর্ণ নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব এবং তাদের ছেড়ে আসা বসত ভিটায় ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা চেয়েছে। মিয়ানমারের তরফে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে তার বাস্তবায়নের গ্যারান্টি পাওয়ার পরই তারা ফিরতে চেয়েছে। স্মরণ করা যায়- গত এক বছরের চেষ্টায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রাখাইনে বাস্তুচ্যুতদের ফেরানোর চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করে ১৫ই নভেম্বর। আজ থেকে প্রতিদিন দেড় শ’ করে টানা ১৫ দিনে ২২৬০ রোহিঙ্গাকে পাঠানোর কথা রয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে শুরু থেইে আপত্তি তুলে জাতিসংঘ, ইউএনএইচসিআর এবং অ্যামনেস্টিসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের তরফে প্রত্যাবাসনের গৃহীত দ্বিপক্ষীয় সিদ্ধান্ত স্থগিতের অনুরোধও জানানো হয়। তারপরও দুই দেশ প্রস্তুতি এগিয়ে নেয়।

প্রত্যাবাসন কমিশনার যা বললেন: এদিকে আমাদের টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, আজই প্রত্যাবাসন শুরু করার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন স্থানীয় কর্মকর্তারা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে যথাসময়েই বান্দরবানের গুমধুম পয়েন্ট দিয়ে বাস্তুচ্যুতদের পাঠানোর কথা। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য মো. আবুল কালাম জানিয়েছে, বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে দুপুরে ১৫০ রোহিঙ্গা মিয়ানমার যাবে। বুধবার (১৪ই নভেম্বর) বিকাল ৫টার দিকে তিনি এ তথ্য নিশ্চিত করেন। কমিশনার জানান, সব প্রস্তুতি শেষ। বৃহস্পতিবারই প্রত্যাবাসন শুরু হবে। দুপুরের দিকে এ কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি আরো বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের ঘুমধুমের ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে যাব। সেখান থেকে মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করবেন। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ধারাবাহিকভাবে চলবে।’ এদিকে টেকনাফস্থ কেরুনতলী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কেন্দ্রে বুধবার সকালে ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যাবাসনের জন্য অত্র কেন্দ্রটি সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে টেকনাফ নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের ইনচার্জ আবদুল হান্নানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা হবে।

ওদিকে কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা নিজেদের অধিকার ফিরিয়ে পেলে মিয়ানমারে ফিরতে চায়। তাদের অধিকারের মধ্যে রোহিঙ্গা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, নাগরিকত্ব প্রদান, হত্যা ও ধর্ষণের বিচার, নিজেদের ভিটা-জমি ফিরিয়ে দেয়া অন্যতম। নয়াপাড়াস্থ শালবনে (ক্যাম্প নং-২৬) এর ডি নাইন ব্লকের রোহিঙ্গা রশিদ আহমদের পুত্র মৌলভী মো. আয়ুব জানান, “আমরা বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্বাস করি, আমরা রোহিঙ্গা, আমরা বাঙ্গালী নই” সুষ্ঠু পরিবেশ থাকলে এবং রোহিঙ্গা ও নাগরিকত্ব প্রদান করলে স্বেচ্ছায় ফিরে যাব। উল্লেখ্য, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে উভয় দেশ ঐকমত্যে পৌঁছে স্মারকটিতে স্বাক্ষর করেছিল। সেই স্মারকের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে ৮ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠায়। যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমার ওই তালিকা থেকে ৫ হাজার ৫শ জনকে প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র দেয়। সেই ছাড়পত্রের মধ্য থেকে ২ হাজার ২৬০ জন রোহিঙ্গাকে স্বদেশে ফেরত পাঠাতে চায় বাংলাদেশ।

ক্যাম্পে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি সংশয় বাড়িয়েছে- গার্ডিয়ান: এদিকে স্থানীয় সূত্রের বরাতে দ্যা গার্ডিয়ান প্রত্যাবাসন নিয়ে গতকালও একটি রিপোর্ট করেছে। সেই রিপোর্টে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এটাই ইঙ্গিত করে প্রত্যাবাসন স্বেচ্ছায় নাও হতে পারে। গার্ডিয়ান তার রিপোর্টে নানা আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে জড়ো হয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। অভিযোগ উঠেছে, যেসব রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করছে না, তাদের ভয় দেখানোর। বৃটেনের ওই সংবাদপত্র তাদের প্রতিবেদনে আরো বলেছে, জামতলী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া কদর নামের ২৯ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা শরণার্থী অভিযোগ করেছেন, প্রত্যাবাসনের ভয়ে অনেক পরিবার লুকানোর চেষ্টা করছে।

এমনকি যাদের নাম প্রত্যাবাসনের তালিকায় নেই, তারাও আত্মগোপনে গিয়েছে। তিনি জানান, জামতলী ও হাকিমপাড়া শরণার্থী শিবিরের সব দিকেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অবস্থান নিয়েছে। তারা তল্লাশি করছে। এমনকি শরণার্থীদেরকে অন্য শিবিরেও যেতে দিচ্ছে না তারা। মানুষ এতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে যে তারা ঘর থেকে বের হচ্ছে না, খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে। কিছু শরণার্থী গোপন পথে শিবির ছেড়ে গেছে বলে জানায় আতঙ্কিত এই রোহিঙ্গা শরণার্থী। পালিয়ে তারা অন্য শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে, বিশেষ করে কুতুপালং শিবিরে, যেখানে প্রত্যাবাসনের এত শঙ্কা নেই। জনি নামের আরেক রোহিঙ্গা জানান, গত দুই দিনে নিরাপত্তা দ্বিগুণ করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, সূর্য অস্ত যাওয়ার পর নিরাপত্তা বাহিনী শরণার্থী শিবিরগুলোর সব প্রবেশ পথে অবস্থান নেয়। সকাল পর্যন্ত তারা এ পথ ছাড়ে না।

ব্যাংককের ডেটলাইনে নিউ ইয়র্ক টাইমসও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, যে অবস্থায় রোহিঙ্গাদের ফেরানো হচ্ছে তাতে তারা ফের গণহত্যার মাঠেই ফিরছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status