শেষের পাতা

নি র্বা চ নী হা ল চা ল টাঙ্গাইল ৪

জয়-পরাজয়ে অন্তরায় কোন্দল

শাহীন আলম, কালিহাতী (টাঙ্গাইল) থেকে

২৪ অক্টোবর ২০১৮, বুধবার, ৯:৪০ পূর্বাহ্ন

কালিহাতী উপজেলা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-৪ আসন। নির্বাচনকে ঘিরে এখানে বইছে প্রার্থীদের তোড়জোড়। ১৩টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে এ আসনে বড় দু’দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে তীব্র কোন্দল। নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে এ কোন্দল। যে দল কোন্দল মিটিয়ে এগুতে পারবে সে দলই নির্বাচনে ভালো করবে- এমনটা নেতাকর্মী ও ভোটারদের ধারণা। তারপরও নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীরা কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। সাধারণ ভোটারসহ তৃণমূল  নেতাকর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময়, গণসংযোগ, সভা-সেমিনার করছেন, দিচ্ছেন পোস্টার-ব্যানারে শুভেচ্ছা। কেন্দ্রের সবুজ সংকেত পেতে চালাচ্ছেন জোর লবিং। কালিহাতী আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিতে চলছে চরম কোন্দল ও গ্রুপিং। কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও রয়েছে আলোচনায়। এ আসন থেকে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন আমির আলী খান মোক্তার, ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ইনছান আলী মোক্তার। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। ১৯৭৯ সালে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক শাজাহান সিরাজ জাসদ থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে লতিফ সিদ্দিকীর সহধর্মিণী লায়লা সিদ্দিকী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৮, ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ও ২০০১ সালের নির্বাচনে শাজাহান সিরাজ এমপি হয়ে মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে লতিফ সিদ্দিকী এমপি হন। ২০০৮ সালে শাজাহান সিরাজ দুর্নীতির দায়ে জেল-হাজতে থাকায় এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন দেয়া হয় শিল্পপতি লুৎফর রহমান মতিনকে। তিনি ৮৬ হাজার ৯১২ ভোট পেয়ে লতিফ সিদ্দিকীর কাছে পরাজিত হন। এসময় লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী হয়ে কালিহাতীতে বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ চোখে দেখার মতো ব্যাপক উন্নয়ন করেন। সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে লতিফ সিদ্দিকী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। আবদুল লতিফ সিদ্দিকী নিউ ইয়র্কে হজ ও তাবলীগ জামাত নিয়ে আপত্তিকর বক্তব্যের কারণে মন্ত্রিত্ব হারান, দল থেকে বহিষ্কৃত হন এবং সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ২০১৭ সালের ৩১শে জানুয়ারির উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী এমপি নির্বাচিত হন।

আওয়ামী লীগ থেকে এবার মনোনয়ন প্রত্যাশী বর্তমান সংসদ সদস্য হাছান ইমাম খান সোহেল হাজারী, উপজেলা পরিষদের  চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠাণ্ডু, আওয়ামী লীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা এফবিসিসিআই’র পরিচালক আবু নাসের, উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি জেলা পরিষদের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী। এ ছাড়া লতিফ সিদ্দিকী ও তার সহধর্মিণী বেগম লায়লা সিদ্দিকী এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করছেন। তারা আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি আলোচনা আছে লতিফ সিদ্দিকীকে দলে ফেরানো হতে পারে। এদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন কালিহাতী উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য লুৎফর রহমান মতিন, মালয়েশিয়া বিএনপির সভাপতি প্রকৌশলী বাদলুর রহমান বাদল,  কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা দলের যুগ্ম-সম্পাদক কালিহাতী বিএনপির উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল হালিম, ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা বেনজীর আহমেদ টিটো, এলেঙ্গা  পৌরসভার মেয়র ও পৌর বিএনপির সভাপতি শাফী খান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি কৃষিবিদ এমএমএ খালিদ। তারা নিজ নিজ কৌশলে এলাকায় গণসংযোগ ও দলীয় কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। এ ছাড়া শাজাহান সিরাজের সহধর্মিণী বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির তাঁতী বিষয়ক সহ-সম্পাদক বেগম রাবেয়া সিরাজ দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। এ ছাড়াও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তম ও জাতীয় পার্টির (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সৈয়দ মুস্তাক হোসেন রতন দলীয় প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে শুনা যাচ্ছে। যদি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মূল আসন সখীপুর। তারপরও তার দলের নেতাকর্মীরা তাকে এ আসনে চাইছেন।

এ আসনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে রয়েছে ব্যাপক কোন্দল। কোন্দলের কারণে কালিহাতীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি বর্তমানে দুইভাগে বিভক্ত। একভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান এমপি সোহেল হাজারী। আরেক ভাগের নেতৃত্বে আছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠাণ্ডু। সকল ধরনের দলীয় কার্যক্রম ও  সভা-সমাবেশ পৃথকভাবে করেন তারা। সম্প্রতি দু’জনের পাল্টাপাল্টি শোডাউনে থমথমে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ আসনের আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো দৃঢ় সাংগঠনিক দক্ষতায় নিয়ন্ত্রণ করতেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তার অনুপস্থিতিতে বর্তমানে দলের মূলধারার নিয়ন্ত্রক ও অভিভাবক মোজহারুল ইসলাম তালুকদার। কর্মীদের কথা- এই দুই নেতার গ্রুপিংয়ের কারণে দলের সাধারণ নেতাকর্মীদের বেকায়দায় পড়তে হয়। যদিও এমপি ছাড়া অন্যসব মনোনয়ন প্রত্যাশী একসঙ্গেই আছেন। এদিকে এ আসনে বিএনপি’র মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলছে অন্তর্দ্বন্দ্ব। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে শাজাহান সিরাজের অনুসারীরা বিএনপির প্রার্থী লুৎফর রহমান মতিনের বিপক্ষে অবস্থান নেন। ২০১৪ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান পদে বিএনপির দুইজন করে প্রার্থী থাকায় বিরোধ আরো স্পষ্ট হয়। সম্প্রতি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে দলের দুই গ্রুপে মারামারির ঘটনাও ঘটেছে।

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী বর্তমান এমপি হাসান ইমাম খান সোহেল হাজারী বলেন, আমি সরকারি এমএম আলী ও সা’দত কলেজের ভিপি, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম। কালিহাতী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে কালিহাতীর উন্নয়ন করেছি। এমপি নির্বাচিত হয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে কালিহাতীবাসীর কল্যাণে কাজ করছি। উপনির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছি দু’বছর হতে চলেছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এলাকায় ১৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। ভবিষ্যতেও এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখবো। তিনি কালিহাতীতে গ্রুপিংয়ের কথা অস্বীকার করে বলেন নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতেই পারে।    

উপজেলা চেয়ারম্যান মোজহারুল ইসলাম তালুকদার ঠাণ্ডু বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে ধারণ করে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতি করি মানুষের সেবা করার জন্য। আওয়ামী লীগ করতে গিয়ে আমার রক্ত ঝরেছে, তবুও পিছপা হইনি। দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে সারাজীবনই তার হয়ে কাজ করেছি। এবার নির্বাচনে দলনেতার কাছে জোরালোভাবে মনোনয়ন চাইবো এবং মনোনয়ন পেলে আসনটি জননেত্রীকে উপহার দেবো।

জনতা ব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও এফবিসিসিআই’র পরিচালক আবু নাসের এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ও একজন সুবক্তা হিসেবে সুপরিচিত। তিনি দলের সঙ্গে সমন্বয় করে এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। আবু নাসের ব্যাংক পরিচালক থাকাকালীন সময়ে কালিহাতীর চরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে সুদমুক্ত বিশেষ ঋণ বিতরণ, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের অনুদান প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সেট বিতরণ এবং গরিব মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছেন। আবু নাসের বলেন বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চাহিদা তথ্য-প্রযুক্তি ও অর্থনীতি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ। আমি নিজে একজন যথার্থ মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে শতভাগ আশাবাদী।

ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী বলেন- দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী হয়ে নিয়মিত গণসংযোগ করছি। অনেক আগে থেকেই সমাজ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছি। মোজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে আমরা নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই কাজ করবো।

লুৎফর রহমান মতিন বলেন, দলে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে কিছটা ভুল বোঝাবুঝি আছে, তবে গ্রুপিং নেই। বিএনপির মতো বড় দলে একাধিক যোগ্য মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকতেই পারে। কারো বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি সবাইকে নিয়েই কাজ করতে চাই। আশাকরি দল বিচার-বিশ্লেষণ করে আমাকেই মনোনয়ন  দেবে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমি অবশ্যই বিজয়ী হবো।     

মনোনয়ন প্রত্যাশী এলেঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র শাফী খান বলেন, লুৎফর রহমান মতিনের সঙ্গে তৃণমূল নেতাকর্মীদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তিনি তার ব্যবসা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন এবং এলাকায় কম আসেন। তার নিষ্ক্রিয়তার জন্যই বিএনপির এই দুর্দশা।

 শাজাহান সিরাজের সহধর্মিণী রাবেয়া সিরাজ জানান, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তিনি দলের কাছে জোরালোভাবে মনোনয়ন চাইবেন।

ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল হালিম বলেন গণসংযোগে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। কালিহাতী উপজেলা বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি শুকুর মাহমুদসহ অনেক নেতাকর্মী বলেছেন মতিন সাহেব শিক্ষানুরাগী, ভদ্র একজন মানুষ। তিনি দুঃসময়ে দলের হাল ধরেছেন। তাই তাকে ছাড়া অন্য কাউকেই এই আসনে ভাবা যায় না। তিনিই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি।

উল্লেখ্য, এ আসনে মোট ভোটার ?৩ লাখ ৯ হাজার ৮৬৪ জন। এরমধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৭০ এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৯৪ জন।
আগামীকাল: ঢাকা-১৯
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status