দেশ বিদেশ
নিরাপদ সড়ক দিবস
সড়কে সেই আগের চিত্র
মারুফ কিবরিয়া ও হাফিজ মুহাম্মদ
২২ অক্টোবর ২০১৮, সোমবার, ৮:৪৮ পূর্বাহ্ন
আন্দোলন, নানা আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু সড়কের চিত্র সেই একই। বাংলামোটর থেকে ছবিটি তুলেছেন আমাদের আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ
নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলন এবং মাসব্যাপী ডিএমপি, বিআরটিএ, প্রধানমন্ত্রী ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাসহ নানা কর্মসূচির মাঝেও রাজধানীর সড়কে সেই চিরচেনা রূপ আর বদলায়নি। নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না চালক, যাত্রী, পথচারী কেউই। ফলে দুর্ঘটনাও ঘটছে অহরহ। সড়কে প্রতিনিয়ত ঝরছে বহু মানুষের প্রাণ। কিন্তু পুলিশের দাবি, নিরাপদ সড়কের জন্য দেয়া নির্দেশনার কিছু বাদে বেশির ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। আর বাকিগুলো বাস্তবায়নের পথে। তবে বাস্তবে এগুলোর বেশির ভাগই নির্দেশনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাস্তবায়িত আর হয়নি।
গত ২৯শে জুলাই জাবালে নূর বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পরপর শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনে সাময়িকভাবে কিছুটা পরিবর্তন এলেও এখন আগের মতোই হয়ে উঠেছে রাজধানীর সড়কের অবস্থা। যত্রতত্র বাস যাত্রী ওঠানামা করা, বেপরোয়া গতিতে বাস চলা, বাসের ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রী বহনসহ সব অনিয়ম দেখা যায় সড়কে। ডিএমপির উদ্যোগে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও কোনোটিরই ফল মেলেনি। বরং মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার চালকদের উল্টো পথে চলাচল, সাধারণ পথচারীদের রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে ফুট ওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং চিহ্নিত স্থান ব্যবহার না করা, ফুটপাথ ব্যবহার না করে মূল সড়কের ওপর দিয়ে চলাচল করাসহ নানারকম অনিয়ম প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন সবাই। সরজমিন, রাজধানীর মধ্য বাড্ডা ও গুলশান সড়কে দেখা যায়, ঝুঁকি নিয়ে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রাস্তা পারাপার হচ্ছেন শতশত মানুষ। তা ছাড়া এই সড়ক দুটিতে ফুটপাথে পর্যাপ্ত হাঁটার জায়গা থাকলেও পথচারীরা হাঁটছেন মূল সড়কের ওপর দিয়ে।
একই অবস্থা ঢাকার রামপুরা, পল্টন, কাকরাইল, বিজয় সরণি, বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, সোনারগাঁও মোড়, গুলিস্তান, শাহবাগ এলাকার। এসব সড়কের সিগন্যালে ঝুঁকি নিয়ে পথচারীরা রাস্তা পার হচ্ছেন। সড়কগুলোর কয়েকটিতে নেই জেব্রা ক্রসিং, যেগুলোতে আছে সেগুলো ব্যবহার না করে মাঝ সড়ক দিয়ে পার হতে দেখা যায় পথচারীদের। মধ্য বাড্ডায় সড়ক দিয়ে পার হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সিফাত নামে এক পথচারী বলেন, নিয়ম মানার অভ্যাসটা আমার আছে। কিন্তু এখন জরুরি সময়। তাই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার করতে পারছি না। আমি মানছি এটা আমার ভুল হয়েছে। তবে আজকের পর থেকে আর ভুল করবো না। মেরুল বাড্ডায় থানার মুখের সড়কে কোনো জেব্রা ক্রসিং নেই। এখানে কয়েকজন পথচারী অভিযোগ করেন, জেব্রা ক্রসিং না থাকায় সবাই এমনিই রাস্তা পারাপার হন।
অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে। বাসগুলোও যাত্রী ওঠানোর জন্য কার আগে কে দাঁড়াবে সেই প্রতিযোগিতায় থাকে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরানোর লক্ষ্যে ১৬ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭টি নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব নজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল ওইদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শন করে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য আগস্ট মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেয়া ১নং নির্দেশনাটি ছিল ‘ঢাকা শহরে গণপরিবহন চলাকালে সবসময় দরজা বন্ধ রাখা এবং নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা’। এই নির্দেশনাটি নিশ্চিত করতে ডিএমপি এবং বিআরটিএকে নির্দেশ দেয়া হয়। আর ২নং নির্দেশনাটি ছিল ‘গণপরিবহনে (বিশেষত বাসে) দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মোবাইল নম্বর পরিদর্শন করা।’
সরজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও পরিবহনে এসব নির্দেশনার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। রাজধানীর চিড়িয়াখানা-মতিঝিল রুটে চলাচল করে নিউভিশন পরিবহন। এ বাসটিতে করেই মিরপুর থেকে ফার্মগেট যাত্রা করেন আমাদের প্রতিবেদক। ১নং নির্দেশনাটি কতটুকু মানছে এ বাসের চালক-সহকারী সেটাই ফলো করা। মিরপুর থেকে বাসটি ফার্মগেট পর্যন্ত পৌঁছা পর্যন্ত একটি স্টেশনেও পুলিশের টাঙানো নির্দিষ্ট স্টপেজে থামায়নি। যাত্রী তুলছে যত্রতত্র। এরপরে ওই নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে যাত্রী তুলে দরজা বন্ধ করার কথা থাকলেও তা তারা মানেনি। এর মধ্যে কোথাও কোথাও ট্রাফিক পুলিশের সামনে বাসটি থামিয়ে লোক তুলছে। শুধু আসাদগেট পুলিশ বক্সের সামনে এসে মামলার ভয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আবার পুলিশ বক্স অতিক্রম করেই দরজাটি খুলে দেয়। এ নিয়ে যাত্রী এবং চালকের সহকারীর মধ্যে কয়েকবার বাকবিতণ্ডাও দেখা যায়।
দরজা বন্ধ না করার কারণে যাত্রীরা ভাড়া কম দিতে চাইলে চালকের সহকারীর সঙ্গে তর্ক লেগে যায়। এক যাত্রী বলেন, ওদের এভাবে বললে হবে না। দরকার ওদের মানসিকতার পরিবর্তন। নইলে এভাবে চলতেই থাকবে। আরেক যাত্রী বলেন এমনি যত নিয়ম করাই হোক না কেন ওদের কেউ রুখতে পারে না। এ বাসটির চালক ও সহকারীকে দরজা বন্ধ করা এবং নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস না থামনোর কারণ জানতে চাইলে বলেন, এক তো বাসে অর্ধেক সিট খালি। দরজা বন্ধ করলে তো লোক পাবো না। আর নির্দিষ্ট স্টপেজের যেখানে সাইনবোর্ড রয়েছে সেখানে কোনো লোকজনই দাঁড়ান না। যে কারণে চাইলেও স্টপেজের আগে পরে যেখানে লোক দাঁড়ানো সেখানেই বাস থামাতে হয়।
১নং নির্দেশনার কোনো কোনো স্থানে কিছুটা বাস্তবায়ন হলেও ২নং নির্দেশনার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়িত হয়নি। এই নির্দেশনায় ঢাকার গণপরিবহনে তথা বাসে দুটি দৃশ্যমান স্থানে চালক এবং হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মোবাইল নম্বর পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে বাসগুলোতে এ নির্দেশনাটি মানতে দেখা যায়নি। তবে বিআরটিসি কিছু বাস এবং ঢাকা চাকা বাসের চালক এবং হেলপারদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করা হয়েছে।
ঢাকার অনেক বাসের চালক, হেলপাররা জানেনই না যে তাদের পরিচয়পত্র এবং ছবি বাসে দৃশ্যমান করতে হবে। কয়েকটি কোম্পানির বাসের চালক এবং হেলপারের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে। রাজধানীর কদমতলী-আশুলিয়া রুটে চলাচল করে এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহন। এ বাসের চালক আজমল জানান, তাদেরকে এমন কিছু্ই বলা হয়নি যে পরিচয়পত্র এবং ছবি বাসের ভিতরে লাগাতে হবে। একই কথা জানালেন গাজীপুরা-সদরঘাটে চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহনের হেলপার মহসিন। বাস মালিক এমন কোনো নির্দেনার কথা তাদেরকে বলেননি। আর পুলিশ দরজা বন্ধ না করার জন্য মামলা দিলেও তাদের কখনো পরিচয়পত্র ছবি প্রদর্শনের কথা জিজ্ঞেস করেনি।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ৪নং নির্দেশনা সব সড়কে চলমান সব পরিবহনে চালককে সিটবেল্ট পরিধান ও পরিবহনের মালিকদের সিটবেল্ট সংযোজনের নির্দেশ। ৯ ও ১০নং নির্দেশনায় স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ এবং ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোল বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালুর কোনো আলামতই দেখা যায়নি। তা ছাড়া ১১নং নির্দেশনায় যে ৩০শে অক্টোবরের মধ্যে ঢাকার সব সড়কের রোড ডিভাইডারের উচ্চতা বৃদ্ধি করে ব্যবস্থার গ্রহণ করতে বলা হয়েছে তারও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের এ নির্দেশের কয়েটির আংশিক ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন হয়ছে। নির্দেশনার ৩নং বলা হয়েছে ‘সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ দুজন আরোহী এবং তাদের হেলমেট ও ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে বাধ্য করা এই নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন হয়েছে। এ ছাড়া নির্দেশনার ৭নং যে ১৮ই আগস্টের মধ্যে ঢাকা শহরের সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং, রোড সাইন দৃশ্যমান ও সড়কের নাম ফলক দৃশ্যমান স্থানে সংযোজন করা হয়েছে।
এ নির্দেশনাটিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ফুটপাথ হকারমুক্ত, স্থাপনা উচ্ছেদ করার কথা বলা হলেও তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সামদানী খন্দকার বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অনেক অবৈধ বাস ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোনো বাসকে চুক্তিতে চলতে দেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া আমাদের মালিক সমিতি থেকে চালক ও সহকারীকে নিয়মতি মনিটরিং করা হচ্ছে। সড়কে শৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরে ঢাকার ট্রাফিকের অনেকটা কাজ হয়েছে।
আমরা বেশির ভাগ ঠিক করতে পেরেছি। ঢাকা শহরে ভালো বাস সার্ভিস চালু করতে পারলে শৃঙ্খলাটা আরো দ্রুত ফিরতো। আমরা বাস স্টপেজ নিয়ে কাজ করছি। যদিও এটা এখনো তারা মানছে না। আশা করি এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তিনি বলেন, লক্কড়ঝক্কর বাসগুলো তুলে দেয়া হবে। আমরা আগের অবস্থায় কঠোর আছি। সড়কে আইনশৃঙ্খলার জন্য আমরা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখছি। স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন দুই থেকে তিনি হাজার মামলা হয়। আর বিশেষ অভিযানের সময় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মামলা হয়। শুধু মামলা দিয়ে নয়, অন্যান্য সমস্যাও রয়েছে সেগুলো সমাধানের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরাতে হবে। এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার বিষয়ে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, আন্দোলনের পর একটা স্বস্তি যে, আমরা একটা আইন পেয়েছি। সেগুলো প্রণয়নের কাজ চলছে। অনেক সমস্যার মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আর সাধারণ মানুষের অভ্যাসটাও একদিন দুদিনে পরিবর্তন হবে না।
গত ২৯শে জুলাই জাবালে নূর বাসের চাপায় শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পরপর শিক্ষার্থীদের সড়ক আন্দোলনে সাময়িকভাবে কিছুটা পরিবর্তন এলেও এখন আগের মতোই হয়ে উঠেছে রাজধানীর সড়কের অবস্থা। যত্রতত্র বাস যাত্রী ওঠানামা করা, বেপরোয়া গতিতে বাস চলা, বাসের ওভারটেকিং, ফিটনেসবিহীন যান চলাচল, অতিরিক্ত যাত্রী বহনসহ সব অনিয়ম দেখা যায় সড়কে। ডিএমপির উদ্যোগে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও কোনোটিরই ফল মেলেনি। বরং মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার চালকদের উল্টো পথে চলাচল, সাধারণ পথচারীদের রাস্তা পারাপারের ক্ষেত্রে ফুট ওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং চিহ্নিত স্থান ব্যবহার না করা, ফুটপাথ ব্যবহার না করে মূল সড়কের ওপর দিয়ে চলাচল করাসহ নানারকম অনিয়ম প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন সবাই। সরজমিন, রাজধানীর মধ্য বাড্ডা ও গুলশান সড়কে দেখা যায়, ঝুঁকি নিয়ে ফুটওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও রাস্তা পারাপার হচ্ছেন শতশত মানুষ। তা ছাড়া এই সড়ক দুটিতে ফুটপাথে পর্যাপ্ত হাঁটার জায়গা থাকলেও পথচারীরা হাঁটছেন মূল সড়কের ওপর দিয়ে।
একই অবস্থা ঢাকার রামপুরা, পল্টন, কাকরাইল, বিজয় সরণি, বনানী কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, সোনারগাঁও মোড়, গুলিস্তান, শাহবাগ এলাকার। এসব সড়কের সিগন্যালে ঝুঁকি নিয়ে পথচারীরা রাস্তা পার হচ্ছেন। সড়কগুলোর কয়েকটিতে নেই জেব্রা ক্রসিং, যেগুলোতে আছে সেগুলো ব্যবহার না করে মাঝ সড়ক দিয়ে পার হতে দেখা যায় পথচারীদের। মধ্য বাড্ডায় সড়ক দিয়ে পার হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সিফাত নামে এক পথচারী বলেন, নিয়ম মানার অভ্যাসটা আমার আছে। কিন্তু এখন জরুরি সময়। তাই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার করতে পারছি না। আমি মানছি এটা আমার ভুল হয়েছে। তবে আজকের পর থেকে আর ভুল করবো না। মেরুল বাড্ডায় থানার মুখের সড়কে কোনো জেব্রা ক্রসিং নেই। এখানে কয়েকজন পথচারী অভিযোগ করেন, জেব্রা ক্রসিং না থাকায় সবাই এমনিই রাস্তা পারাপার হন।
অনেক সময় দুর্ঘটনাও ঘটে। বাসগুলোও যাত্রী ওঠানোর জন্য কার আগে কে দাঁড়াবে সেই প্রতিযোগিতায় থাকে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরানোর লক্ষ্যে ১৬ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ১৭টি নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব নজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল ওইদিন রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক পরিদর্শন করে সড়কের শৃঙ্খলা ফেরাতে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য আগস্ট মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেয়া ১নং নির্দেশনাটি ছিল ‘ঢাকা শহরে গণপরিবহন চলাকালে সবসময় দরজা বন্ধ রাখা এবং নির্দিষ্ট বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠা-নামা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখা’। এই নির্দেশনাটি নিশ্চিত করতে ডিএমপি এবং বিআরটিএকে নির্দেশ দেয়া হয়। আর ২নং নির্দেশনাটি ছিল ‘গণপরিবহনে (বিশেষত বাসে) দৃশ্যমান দুটি স্থানে চালক ও হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মোবাইল নম্বর পরিদর্শন করা।’
সরজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও পরিবহনে এসব নির্দেশনার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। রাজধানীর চিড়িয়াখানা-মতিঝিল রুটে চলাচল করে নিউভিশন পরিবহন। এ বাসটিতে করেই মিরপুর থেকে ফার্মগেট যাত্রা করেন আমাদের প্রতিবেদক। ১নং নির্দেশনাটি কতটুকু মানছে এ বাসের চালক-সহকারী সেটাই ফলো করা। মিরপুর থেকে বাসটি ফার্মগেট পর্যন্ত পৌঁছা পর্যন্ত একটি স্টেশনেও পুলিশের টাঙানো নির্দিষ্ট স্টপেজে থামায়নি। যাত্রী তুলছে যত্রতত্র। এরপরে ওই নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকে যাত্রী তুলে দরজা বন্ধ করার কথা থাকলেও তা তারা মানেনি। এর মধ্যে কোথাও কোথাও ট্রাফিক পুলিশের সামনে বাসটি থামিয়ে লোক তুলছে। শুধু আসাদগেট পুলিশ বক্সের সামনে এসে মামলার ভয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। আবার পুলিশ বক্স অতিক্রম করেই দরজাটি খুলে দেয়। এ নিয়ে যাত্রী এবং চালকের সহকারীর মধ্যে কয়েকবার বাকবিতণ্ডাও দেখা যায়।
দরজা বন্ধ না করার কারণে যাত্রীরা ভাড়া কম দিতে চাইলে চালকের সহকারীর সঙ্গে তর্ক লেগে যায়। এক যাত্রী বলেন, ওদের এভাবে বললে হবে না। দরকার ওদের মানসিকতার পরিবর্তন। নইলে এভাবে চলতেই থাকবে। আরেক যাত্রী বলেন এমনি যত নিয়ম করাই হোক না কেন ওদের কেউ রুখতে পারে না। এ বাসটির চালক ও সহকারীকে দরজা বন্ধ করা এবং নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস না থামনোর কারণ জানতে চাইলে বলেন, এক তো বাসে অর্ধেক সিট খালি। দরজা বন্ধ করলে তো লোক পাবো না। আর নির্দিষ্ট স্টপেজের যেখানে সাইনবোর্ড রয়েছে সেখানে কোনো লোকজনই দাঁড়ান না। যে কারণে চাইলেও স্টপেজের আগে পরে যেখানে লোক দাঁড়ানো সেখানেই বাস থামাতে হয়।
১নং নির্দেশনার কোনো কোনো স্থানে কিছুটা বাস্তবায়ন হলেও ২নং নির্দেশনার ছিটেফোঁটাও বাস্তবায়িত হয়নি। এই নির্দেশনায় ঢাকার গণপরিবহনে তথা বাসে দুটি দৃশ্যমান স্থানে চালক এবং হেলপারের ছবিসহ নাম, চালকের লাইসেন্স নম্বর ও মোবাইল নম্বর পরিদর্শন করার কথা রয়েছে। কিন্তু রাজধানীতে বাসগুলোতে এ নির্দেশনাটি মানতে দেখা যায়নি। তবে বিআরটিসি কিছু বাস এবং ঢাকা চাকা বাসের চালক এবং হেলপারদের পরিচয়পত্র প্রদর্শন করা হয়েছে।
ঢাকার অনেক বাসের চালক, হেলপাররা জানেনই না যে তাদের পরিচয়পত্র এবং ছবি বাসে দৃশ্যমান করতে হবে। কয়েকটি কোম্পানির বাসের চালক এবং হেলপারের সঙ্গে কথা বলে এসব জানা গেছে। রাজধানীর কদমতলী-আশুলিয়া রুটে চলাচল করে এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিবহন। এ বাসের চালক আজমল জানান, তাদেরকে এমন কিছু্ই বলা হয়নি যে পরিচয়পত্র এবং ছবি বাসের ভিতরে লাগাতে হবে। একই কথা জানালেন গাজীপুরা-সদরঘাটে চলাচলকারী সুপ্রভাত পরিবহনের হেলপার মহসিন। বাস মালিক এমন কোনো নির্দেনার কথা তাদেরকে বলেননি। আর পুলিশ দরজা বন্ধ না করার জন্য মামলা দিলেও তাদের কখনো পরিচয়পত্র ছবি প্রদর্শনের কথা জিজ্ঞেস করেনি।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ৪নং নির্দেশনা সব সড়কে চলমান সব পরিবহনে চালককে সিটবেল্ট পরিধান ও পরিবহনের মালিকদের সিটবেল্ট সংযোজনের নির্দেশ। ৯ ও ১০নং নির্দেশনায় স্বয়ংক্রিয় বৈদ্যুতিক সিগন্যাল ব্যবস্থা চালুর বিষয়ে পদক্ষেপ এবং ঢাকা শহরে রিমোট কন্ট্রোল বৈদ্যুতিক সিগন্যালিং পদ্ধতি চালুর কোনো আলামতই দেখা যায়নি। তা ছাড়া ১১নং নির্দেশনায় যে ৩০শে অক্টোবরের মধ্যে ঢাকার সব সড়কের রোড ডিভাইডারের উচ্চতা বৃদ্ধি করে ব্যবস্থার গ্রহণ করতে বলা হয়েছে তারও এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের এ নির্দেশের কয়েটির আংশিক ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন হয়ছে। নির্দেশনার ৩নং বলা হয়েছে ‘সব মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ দুজন আরোহী এবং তাদের হেলমেট ও ট্রাফিক সিগন্যাল মানতে বাধ্য করা এই নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন হয়েছে। এ ছাড়া নির্দেশনার ৭নং যে ১৮ই আগস্টের মধ্যে ঢাকা শহরের সব সড়কে জেব্রা ক্রসিং, রোড সাইন দৃশ্যমান ও সড়কের নাম ফলক দৃশ্যমান স্থানে সংযোজন করা হয়েছে।
এ নির্দেশনাটিতে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে ফুটপাথ হকারমুক্ত, স্থাপনা উচ্ছেদ করার কথা বলা হলেও তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক সামদানী খন্দকার বলেন, সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অনেক অবৈধ বাস ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোনো বাসকে চুক্তিতে চলতে দেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া আমাদের মালিক সমিতি থেকে চালক ও সহকারীকে নিয়মতি মনিটরিং করা হচ্ছে। সড়কে শৃঙ্খলার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরে ঢাকার ট্রাফিকের অনেকটা কাজ হয়েছে।
আমরা বেশির ভাগ ঠিক করতে পেরেছি। ঢাকা শহরে ভালো বাস সার্ভিস চালু করতে পারলে শৃঙ্খলাটা আরো দ্রুত ফিরতো। আমরা বাস স্টপেজ নিয়ে কাজ করছি। যদিও এটা এখনো তারা মানছে না। আশা করি এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে। তিনি বলেন, লক্কড়ঝক্কর বাসগুলো তুলে দেয়া হবে। আমরা আগের অবস্থায় কঠোর আছি। সড়কে আইনশৃঙ্খলার জন্য আমরা ব্যবস্থা অব্যাহত রাখছি। স্বাভাবিকভাবে প্রতিদিন দুই থেকে তিনি হাজার মামলা হয়। আর বিশেষ অভিযানের সময় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মামলা হয়। শুধু মামলা দিয়ে নয়, অন্যান্য সমস্যাও রয়েছে সেগুলো সমাধানের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরাতে হবে। এদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরার বিষয়ে সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ বলেন, আন্দোলনের পর একটা স্বস্তি যে, আমরা একটা আইন পেয়েছি। সেগুলো প্রণয়নের কাজ চলছে। অনেক সমস্যার মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। আর সাধারণ মানুষের অভ্যাসটাও একদিন দুদিনে পরিবর্তন হবে না।