অনলাইন

ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ‘ডেঞ্জার জোন’

এম ইদ্রিস আলী, শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) থেকে

২১ অক্টোবর ২০১৮, রবিবার, ২:৫৮ পূর্বাহ্ন

ঢাকা-সিলেট আঞ্চলিক মহাসড়কের পাহাড়ী উঁচু নিচু আঁকা বাঁকা হাফ কিলোমিটার সড়কে ডাকাতদের রাম রাজত্ব চলছে। অহরহ সড়ক ডাকাতির ঘটনায় পরিবহন শ্রমিক ও যাত্রী সাধারনের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। শীত মৌসুমে পাহাড়ি এলাকায় সন্ধ্যার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় ডাকাতির মাত্রা আরও বেড়েছে। অথচ কামাইছড়া পাহাড়ি বাঁক থেকে রাবার বাগান পর্যন্ত হাফ কিলোমিটার এলাকার ৩ কিলোমিটার দূরে স্থায়ী কামাইছড়া পুলিশ ক্যাম্প। তারপরও একইস্থানে একের পর এক ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। ধরা পড়ছে না কোনও ডাকাত। মহাসড়কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সাতগাঁও হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িও ব্যর্থ।

হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলা অংশের কামাইছড়া থেকে শ্রীমঙ্গল উপজেলার প্রবেশদ্বার মুছাই পর্যন্ত আঞ্চলিক এ মহাসড়কে ডাকাতচক্রের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পণ্যবাহী গাড়ি থেকে শুরু করে যাত্রীবাহী বাস, কার, মাইক্রোবাস, সিএনজি অটোরিক্সার চালক, সাধারন যাত্রীসহ ভিআইপিরাও।

জানা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কে স্থানীয় ও পাশ্ববর্তী চুনারুঘাট উপজেলার ৪০-৫০ জনের একটি সংঘবদ্ধ ডাকাতচক্র সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে মাত্র ১২-১৩ জন ডাকাতকে সনাক্ত করেছে পুলিশ। কিন্তু কোনভাবেই তাদের ধরতে পারছে না। গাজীপুর রিজিয়নের আওতাধীন সাঁতগাও হাইওয়ে পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, গত রমজান মাস থেকে ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত এই আঞ্চলিক মহাসড়কে রাস্তার দু’পাশের গাছ ফেলে কমপক্ষে ৭টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে ডাকাতির শিকার হয়েছেন  মৌলভীবাজার-২ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল মতিনও।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, পণ্যবহনকারী গাড়ী চালক ও সহকারীর যোগসাজস রয়েছে ডাকাতদের সঙ্গে। তারা বলছেন, এরা সংখ্যায় ৪০-৫০ জন। ১০-১৫ জন করে ২-৩টি দলে বিভক্ত হয়ে মুখোশ পরে ডাকাতি করে। এ আঞ্চলিক মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন ১০-১৫ হাজারেরও বেশী যানবাহন চলাচল করে। মহাসড়কে পুলিশের পর্যাপ্ত টহল না দেয়াকে দায়ি করছেন স্থানীয় জনতা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য বলেন, পণ্যবহনকারী যানবাহনের চালক ও সহকারীর যোগসাজস আছে সংঘবদ্ধ ডাকাতদলের সঙ্গে। তারা পণ্য নিয়ে রওনা দেয়ার আগেই মোবাইল ফোনে ডাকাতদের তথ্য জানিয়ে দেয়। ডাকাতদলের সদস্যরা নিরাপদে অবস্থান নিয়ে গাছ ফেলে ডাকাতি করে। ডাকাতির পর লুট করা মালের একটি অংশ চলে যায় চালক ও সহকারীর কাছে।

র‌্যাব-৯ এর সিপিসি-২ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিমান চন্দ্র কর্মকার বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমরা অস্বস্তিতে। ঢাকা সিলেট আঞ্চলিক এই মহাসড়কে ডাকাতিতে নতুন কয়েকটি চক্র সক্রিয়। আমাদের কাছে তথ্য আছে চুনারুঘাট, বাহুবল ও শ্রীমঙ্গল- এই তিন এলাকার লোকজন এসব কাজ করছে। এ বিষয়ে আমরা কাজ করেছি। আশা করছি, শিঘ্রিই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করা যাবে।


এই আঞ্চলিক মহাসড়কের কামাইছড়া পুলিশ ক্যাম্প থেকে ৫শ’ গজ দূরত্বে ডেঞ্জার জোন রাবার বাগানের পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে সর্বশেষ গত ৭ই অক্টোবর রাত ৮ টা ৫০ মিনিট থেকে ৯টা ২০ মিনিট পর্যন্ত একটানা ৩০ মিনিট ডাকাতি সংঘটিত হয়। এদিন ডাকাতের কবলে পড়েন বাহুবল উপজেলার মিরপুরের চিচিরকুট গ্রামের বাসিন্দা জিতু মিয়া (৩২)। তিনি পেশায় হোমিও চিকিৎসক। সেদিনের এই ডাকাতির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, সিএনজি যোগে বাড়ি ফেরার পথে রাবার বাগানের পাহাড়ি বাঁকে ডাকাতরা রাস্তার পাশের গাছ কেটে ফেলে প্রথমে একটি বালুবাহী গাড়ি আটকায়। এরপর হবিগঞ্জের বিরতিহীন এক্সপ্রেস, এরপর আমার সিএনজি। তিনি বলেন, ডাকাতদের মুখোশ পরা ছিল। তাদের মুখে শীতের দিনের মানকি টুপি ও ধুলা আটকানোর মাস্ক পড়া ছিল। সংখ্যায় অন্তত: ২০-২২ জন। এক দু’জন ছাড়া সবার পরনে হাফ প্যান্ট। হাতে লাঠি ও দা’। জিতু মিয়া বলেন, ডাকাতরা আমাকে মারধর করে মানিব্যাগ, ভিসা কার্ড, ভোটার আইডি কার্ডসহ ২৩শ’ টাকা লুটে নেয়। ডাকাতি চলাকালে একটি করে যানবাহন ডাকাতি করে সেই গাড়ীর লাইট নিভিয়ে রাস্তায় লাইন করিয়ে রাখে। এ সময় অন্য ডাকাতরা রাস্তাজুড়ে দুই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে এদিক সেদিক হাঁটাহাটি করে। সেদিন ডাকাতির সময় রাস্তার ২ পাশে ৫০ থেকে ৬০টি যানবাহন ছিল।


কামাইছড়া পুলিশ ক্যম্পের এসআই মহরম বলেন, আঞ্চলিক এই মহাসড়কের রাবার বাগানের বাঁকের অংশটি কামাইছড়া পুলিশ ক্যাম্প থেকে দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। তার দাবি, ৭ই অক্টোবরে ডাকাতি হয়নি, ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে। আমাদের টহল পার্টি সামনে ছিল। ২ রাউন্ড গুলিও বর্ষণ করা হয়েছে ডাকাতদের লক্ষ্য করে। লাঠি চার্জও হয়েছে। ডাকাতের হাতে দা’ থাকার কারণে তাদের কাছে যেতে পারেনি পুলিশ। তিনি বলেন ‘এর আগে একই স্থানে রোজার পরে দু’বার এবং সর্বশেষ ৭ই অক্টোবর ডাকাতির চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু পাবলিক গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ায় কোনটা পাবলিক আর কোনটা ডাকাত চিহ্নিত করা যায়নি।


শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই নান্নু মন্ডল বলেন, মহাসড়কের নিরাপত্তা দেয়াই আমাদের মুল দায়িত্ব। এই আঞ্চলিক মহসড়কের মিরপুর থেকে মৌলভীবাজার পৌরসভা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার রাস্তা এই ফাঁড়ির আওতায়। এর মধ্যে মহাসড়কের বিপজ্জনক জোন হিসেবে কামাইছড়া পাহাড়ি বাঁক থেকে রাবার বাগান পর্যন্ত হাফ কিলোমিটার সড়ক এলাকা ডাকাত প্রবণ। গত রমজান মাস থেকে ৭ই অক্টোবর পর্যন্ত এই এলাকায় কমপক্ষে ৭ বার একইস্থানে গাছ ফেলে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। একই স্থানে বার বার ডাকাতি বিষয়ে তিনি বলেন, নিরিবিলি পাহাড়ি বাঁক। এক বাঁক থেকে অন্য বাঁক সহজে দেখা যায় না। রাস্তার দু’পাশে গাছ পালায় ঘেরা। রানীগাও ও চুনারুঘাট এলাকার লোকজন এসব ডাকাতিতে জড়িত। আশপাশ এলাকার লোকজনসহ চুনারুঘাট বর্ডার এলাকার সন্দেহভাজনদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।

তিনি জানান, সাতগাও হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ২২ সদস্যর জনবল থাকার কথা থাকলেও রয়েছে মাত্র ১৩ জন। এর মধ্যে সাব ইন্সপেক্টর ১ জন, এএসআই ১ জন, এটিএসআই একজন ও ৬ জন কনস্টেবল পদ বর্তমানে শূণ্য রয়েছে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status