বাংলারজমিন

হুমকির মুখে গৌড় নগরীর ঐতিহাসিক বহু স্থাপনা

মো. তারেক রহমান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে

২০ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ৯:১৯ পূর্বাহ্ন

গৌড়ের ইতিহাসসমৃদ্ধ জেলা চাঁপাই নবাবগঞ্জ। এখানে কার্যকর উদ্যোগ আর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদাসীনতায় হুমকির মুখে বহু ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি। কয়েকশ বছর আগের এসব প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শনের বেশিরভাগই অযত্নে অবহেলায় এখন ধ্বংস হতে চলেছে। আবার অনেক নিদর্শনই এখনো প্রত্নবিভাগের তালিকার বাইরে। ছোট-পরিসরে দু-একটি পুরাকীর্তি সংস্কার করা হলেও বেশিরভাগই পড়ে আছে অযত্নে অবহেলায়। তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দাবি, প্রায়োরেটি বেসিসে একে একে প্রতিটি নিদর্শনই সংস্কার করা হচ্ছে। এমন অবস্থায় এসব ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন দ্রুত সংস্কারের দাবি জেলাবাসীর। এক সময়ের প্রাচীন জনপদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। আর জেলাজুড়েই আছে নানা প্রাচীন নিদর্শন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। এর মধ্যে অন্যতম ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদ। মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন। মসজিদের চার কোণে ৪টি অষ্টকোনাকৃতির মিনার বা টারেট এবং ওপরে ১২টি অর্ধগোলাকৃতির ও ৩টি চৌচালা আকৃতির মোট ১৫টি গম্বুজ আছে। গম্বুজগুলোতে এক সময় সোনার পিন্ড করা ছিল বলে জানা যায়। ফলে মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে সোনামসজিদ। স্থাপত্যকলা ও শৈল্পিক সৌন্দর্যের বিচারে এ মসজিদ গৌড়ের রত্ন হিসেবে পরিচিত। মসজিদটি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে ওয়ালী মুহাম্মাদ কর্তৃক ১৪৯৩ থেকে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত হয়।
ঐতিহাসিক ছোট সোনামসজিদের সামান্য দূরেই অবস্থিত তোহাখানা। ১৬৫৫ সালে শাহ সূজা এটি নির্মাণ করেন। কথিত আছে শীতকালীন তাপ নিয়ন্ত্রণ ইমারত হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়। আর এর পাশেই রয়েছে মোগল আমলের একটি মসজিদ ও হজরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রহ.) মাজার। কিন্তু নিরাপত্তা ও সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এসব ইতিহাস।
সোনামসজিদ রেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার আব্দুল মতিন জানান, জেলার যেসব ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে, মসজিদ, মন্দির, রাজবাড়ি এগুলো সংস্কার করা একান্ত প্রয়োজন। সোনামসজিদের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য এর উত্তরদিকে পুকুরপাড়ে বাউন্ডারি দরকার। এছাড়া নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো প্রহরী। তিনি আরও বলেন, ঐতিহাসিক এ মসজিদ ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হলে এর পাশ দিয়ে যে মহাসড়ক রয়েছে তা বাইপাস করা একান্ত দরকার। কারণ প্রতিদিন এই মহাসড়ক দিয়ে সোনামসজিদ বন্দর থেকে ৪০০ থেকে ৫০০ ট্রাক প্রায় ৪০ টন পণ্যবোঝাই করে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায়। এ সময় কেঁপে ওঠে মসজিদটি। অনেক দিনের পুরনো এ মসজিদটি রক্ষায় তাই বাইপাস রাস্তা জরুরি। এছাড়া ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজন রয়েছে একজন সহকারী কাস্টডিয়ান অফিসার ও কাস্টডিয়ান অফিসেরও।
জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বালিয়াদীঘি গ্রামের পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপত্য কলার আরেক নিদর্শন দারাসবাড়ি মসজিদ। মসজিদটি বাংলার মুসলিম শাসনামলের মধ্যযুগীয় স্থাপত্যকলার এক অপূর্ব নিদর্শন। মসজিদের পূর্বপাশে ছোট দীঘির পাশেই বিশাল এলাকাজুড়ে রয়েছে দারাসবাড়ি মাদরাসা। ধারণা করা হয় ১৫ শতকে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের আমলে নির্মিত এ মাদরাসাটি বাংলাদেশর সবচেয়ে প্রাচীন মাদরাসার নিদর্শন। কিন্তু সুবৃহৎ এ মসজিদটি বর্তমানে ভগ্নদশা এবং এর অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার দিন গুনছে।
মসজিদটি সম্পর্কে সোনামসজিদ এলাকার গৌড় বংশের নুরুল হুদা সাত্তারী গৌড়ীয়া জানান, বহুদিন আগেই ভেঙে গেছে মসজিদটির ছাদ। অথচ জেলায় যেসব মুসলিম শাসনামলের মসজিদ রয়েছে এটি তার মধ্যে সর্ববৃহৎ।
এক সময় মাদরাসাটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। যেখানে নদীয়া, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, দেশের উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের লোকজন উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করত। মাদরাসাটিতে ৩০০ জন শিক্ষক সে সময় শিক্ষা দিতেন। এ প্রত্নতাত্তিক নিদর্শনটি জরুরি ভিত্তিতে সংস্কারের দাবি জানান তিনি।
এদিকে, জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুরে অবস্থিত বর্তমানে সর্ব প্রাচীন প্রত্ন সম্পদ ও লুকায়িত ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানের নাম নওদা বুরুজ। স্থানীয়রা একে বলে থাকেন ষাঁড় বুরুজ। খালি চোখে দেখলে মনে হবে একটি বিশাল ঢিবি। কিন্তু অনুসন্ধানী চোখে দেখলে মনে হবে তমাশাচ্ছন্ন ইতিহাসের কালো মেঘে স্থানটি ঢাকা। এর সঠিক ইতিহাস উদঘাটনে প্রয়োজন পরিকল্পিত উৎখনন। কিন্তু আজো সেটি হয়ে ওঠেনি। উল্টো অবহেলা আর অযত্নে দিনের পর দিন খয়ে যাচ্ছে এ অপূর্ব প্রত্ন নিদর্শনটি। চারপাশে গড়ে উঠেছে বহু অবৈধ ঘরবাড়ি। ভোগদখল হচ্ছে এর আশপাশের জমিও। প্রতিবছর বর্ষায় এর মাটি গলে ক্ষয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এর চারপাশে নেই কোনো বাউন্ডারিও।
অন্যদিকে এসব ঐতিহাসিক সম্পদ সংরক্ষণে সরকার জরুরিভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এমনটাই দাবি আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষকদের।
এ বিষয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক প্রফেসর ড. মাযহারুল ইসলাম তরু জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। গৌড়ের প্রাচীন রাজধানী হিসেবে এ জেলার যে পরিচিতি, তার বহু নিদর্শন এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে অনেকগুলোই অত্যন্ত জীর্ণ অবস্থায় আছে এবং পরিছন্নতার অভাব রয়েছে।
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক জানান, জেলার অনেক পুরাকীর্তি বিভিন্ন সময় কমবেশি সংরক্ষণ করা হয়েছে। চলতি বছর সরকারের রাজস্ব আদায় এবং জাদুঘর করার জন্য তোহাখানায় টিকিট চালু করতে যাচ্ছি। তাছাড়া আমরা প্রতিটি পুরাকীর্তিই প্রায়োরেটি বেসিসে কাজ করি। যখন দেখা যায় কোনো স্থাপনার খুব খারাপ অবস্থা তখন দেখে শুনে ও গবেষণা করে সেগুলোর সংস্কার ও সংরক্ষণ করি এবং ওই মনুমেন্টগুলো যে সময়ের ও যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি সেগুলো দিয়েই সংস্কার করা হয়। এ ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি ইট, সিমেন্ট দিয়ে করতে পারি না। পারতপক্ষে আমরা চেষ্টা করি ওই সময়ের উপাদান দিয়ে সংস্কার করার। এছাড়া সামনের অর্থবছরে নতুন করে আবার কিছু সীমানা প্রাচীর ও প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করারও পরিকল্পনার কথা জানান তিনি। জেলার ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে রয়েছে, কানসাটের পুরনো জমিদার বাড়ি। বাড়িটি সম্পূর্ণই এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পরিত্যক্ত। যেখানে রাত-দিন চলে মাদকসেবীদের আড্ডা। এছাড়াও রয়েছে দাদনচক মসজিদ, খঞ্জন দিঘি বা রাজাবিবির মসজিদ, ধনিয়াচক মসজিদ, ব্রিটিস আমলে নির্মিত মাঝপাড়া বালিগ্রাম ৬ গম্বুজ মসজিদ, নবাবী আমলে নির্মিত মহারাজপুর জামে মসজিদ, ঐতিহাসিক নীলকুঠি, ভোলাহাটের চামচিকা মন্দির, গিলাবাড়ি প্রাচীন শিবমন্দির, কাজী সাহেবের মসজিদ, রহনপুরের গম্বুজ ও অতি প্রাচীন ঠাকুরবাড়ি যা মহান্ত বাড়ি নামে সমধিক পরিচিত।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status