দেশ বিদেশ

দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারার যথেচ্ছ প্রয়োগ

উৎপল রায়

২০ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ৯:১৭ পূর্বাহ্ন

কাল্পনিক ঘটনা। গায়েবি মামলা। দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারার যথেচ্ছ ব্যবহার। সরকারি কর্মচারীকে তার কাজ সম্পাদনে বাধা দান কিংবা সরকারি কর্মচারীকে কর্তব্য সম্পাদনে বাধা দানের উদ্দেশ্যে আক্রমণের বিষয় বর্ণিত রয়েছে দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারায়। অভিযোগ উঠেছে অস্তিত্বহীন আসামি ও গায়েবি মামলায় বিভিন্ন আইনের অন্যান্য ধারাসহ দণ্ডবিধির ওই দুটি ধারা যুক্ত করে মামলা দেয়া হচ্ছে একের পর এক। সাবেক আমলা, ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ, পুলিশের সাবেক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, দণ্ডবিধির ওই দুই ধারা অনুযায়ী পুলিশও সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর আওতায় পড়েন। আর সচরাচর সরকারি কাজে বাধা দান বা বাধা দানের উদ্দেশ্যে আক্রমণ বলতে যা বোঝায় এবং বর্তমানে ওই দুটি ধারায় যে ধরনের গায়েবি মামলা হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। যেখানে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কোনো কর্মসূচি নেই, পুলিশকে আক্রমণ করা দূরে থাক কোনো ঘটনাই ঘটেনি, সেখানে এভাবে কাল্পনিক কাহিনী সৃষ্টি করে মামলা দেয়া অনৈতিক। তারা আরো বলছেন, গায়েবি মামলার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত খবর আসছে। এ ধরনের মামলায় আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার ও অপ্রয়োগ হচ্ছে। তাদের মতে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের আইন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমে আসবে।
বিএনপিপন্থি একাধিক আইনজীবী জানান, বিশেষ ক্ষমতা আইন, বিস্ফোরক আইন, বে-আইনি সমাবেশ ও মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দাঙ্গা সংক্রান্ত দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারাসহ হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের ৩০৭ ধারার সঙ্গে দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারা যুক্ত করে মামলা দেয়া হচ্ছে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। দলটির শীর্ষ আইনজীবীরা বলছেন, মামলাগুলো গায়েবি ও ভুতুড়ে। যেখানে কোনো মিছিল-সমাবেশ কিংবা সড়ক অবরোধের ঘটনাই ঘটেনি সেখানে এ ধরনের মামলা দেয়া নিছক হয়রানি ছাড়া আর কিছু নয়। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেউ যদি কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কাজে বাধা দেয় কিংবা কেউ যদি কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয় এবং পুলিশ যদি শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সেই কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করতে যায় এবং বিপরীতে পুলিশের ওপর যদি কেউ বলপ্রয়োগ ও আক্রমণ করে তাহলে এ ধরনের মামলায় দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩ ধারার প্রয়োগ হবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, অনেকক্ষেত্রে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে (এফআইআর) যে তারিখ, স্থান ও ঘটনার কথা বলা হচ্ছে, সেই স্থানে কোনো ঘটনা দূরে থাক, পুলিশকে বাধা দান ও হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। অথচ পুলিশের কাজে বাধা দান বা বাধা দানের উদ্দেশ্যে আক্রমণের বিষয়টি মামলার এফআইআর-এ উল্লেখ করা হচ্ছে। এমনকি ১১ বছর আগে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিকেও এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে।
সরকারি কর্মচারীকে কাজ সম্পাদনে বাধাদানের বিষয়ে দণ্ডবিধির ১৮৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো সরকারি কর্মচারীদের সরকারি কার্যাবলী সম্পাদনে ইচ্ছাপূর্বক বাধা দান করে, তবে সেই ব্যক্তি তিন মাস পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা পাঁচশত টাকা পর্যন্ত যেকোনো পরিমাণ অর্থদণ্ডে অথবা উভয়বিধ দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ সরকারি কর্মচারীকে তার কর্তব্য সম্পাদনে বাধা দানের উদ্দেশ্যে আক্রমণ অথবা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করার বিষয়ে দণ্ডবিধির ৩৫৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি এমন অন্য কোনো ব্যক্তিতে আক্রমণ করে বা তার ওপর বলপ্রয়োগ করে, যে অন্য ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হিসেবে কর্তব্য সম্পাদনরত একজন সরকারি কর্মচারী অথবা অনুরূপ কর্মচারীকে তার সরকারি কর্মচারী হিসেবে করণীয় কর্তব্য সম্পাদনে বাধা দানের উদ্দেশ্যে তার ওপর অনুরূপ আক্রমণ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে অথবা অনুরূপ সরকারি কর্মচারী তার সরকারি কর্মচারী হিসেবে আইনসম্মতভাবে করণীয় কর্তব্য সম্পাদন ব্যবস্থিত কোনো কিছু করেছে বা করার চেষ্টা করেছে বলে তাকে আক্রমণ করে বা তার ওপর অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ করে, তবে সেই ব্যক্তি তিন বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে, অথবা অর্থদণ্ডে, এমনকি উভয়বিধ দণ্ডেই দণ্ডিত হবে।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মানবজমিনকে বলেন, ‘সাধারণত মোবাইল কোর্টে (ভ্রাম্যমাণ আদালত) ম্যাজিস্ট্রেটকে তার কাজ করতে বাধা দেয়া, কোনো ইঞ্জিনিয়ারকে রাস্তা বা স্থাপনার কাজ করতে বাধা প্রদান কিংবা অবৈধ উচ্ছেদের সময় বাধা প্রদানকে সরকারি কাজে বাধা হিসেবে মনে করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে নানা কারণে পুলিশ বিভিন্ন সময় বাধার সম্মুখীন হয়। সেটিকেও সরকারি কাজে বাধা হিসেবে দেখা হয়।’ সরকারি কাজে বাধা দান সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ওই দুটি ধারা যুক্ত করে সাম্প্রতিক গায়েবি মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ জাতীয় ঘটনা উল্লেখ করে যদি এ ধরনের মামলা হয়ে থাকে তাহলে আমি বলবো- এভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে। আর সরকারি কর্মচারী হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করা সরকারি কর্মচারী আচরণ ও শৃঙ্খলাবিধির লঙ্ঘন। পুলিশও সরকারি কর্মচারী হিসেবে গণ্য হন। পুলিশের জন্য আলাদা প্রবিধানও রয়েছে। পুলিশ যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাহলে তাদের জন্যও ব্যবস্থা নেয়ার বিধান রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিটি আইনেরই প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ রয়েছে। আইন যেমন দরকার আছে তেমনি আইনের অপপ্রয়োগ হোক তা কোনো কোনো মানুষ চায় না। কিন্তু আইনের এ ধরনের অপপ্রয়োগ অনৈতিক ও বেআইনি। পুলিশের ক্ষমতা আছে বলেই এ ধরনের কাজ করা যায় না। এখন রাষ্ট্রশক্তি যদি আইনের অপপ্রয়োগ করে তখন আসলে আদালতের কাছেই বিচার চাইতে হবে।’ ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘দণ্ডবিধির ওই দুটি ধারায় (দণ্ডবিধির ১৮৬ ও ৩৫৩) সরকারি কাজে বাধা এবং শাস্তির কথা বলা আছে। যেখানে কেউ যদি বেআইনি সমাবেশের মাধ্যমে বেআইনি কর্মকাণ্ড করে এবং পুলিশ যদি শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোনো অভিযান চালায় এবং এর বিপরীতে যদি সেখানে কেউ বাধা দেয় তাহলে এ দুটি ধারায় মামলা দেয়া হবে। কিন্তু আদতে যেসব মামলা হচ্ছে সেখানে ওই ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটছে না। দেখা গেছে, বর্তমানে যেসব ভুতুড়ে ঘটনায় মামলা হচ্ছে প্রায় সব মামলাতেই এই ধারা প্রয়োগ হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ওই ধারাগুলো জামিনযোগ্য নয়, এ কারণেই হয়তো এই ধারা বেশি দেয়া হচ্ছে। আসলে মামলা করার জন্য মামলা দেয়া হচ্ছে। এর কোনো আইনগত ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।’ খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও মামলা দেয়া হচ্ছে। আমার বিরুদ্ধে ৬টি মামলা দেয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অতীতে কখনো এ ধরনের মামলা দেয়া হয়নি। সিনিয়র আইনজীবীদের বিরুদ্ধে এভাবে মামলা দেয়া যায় না।’ তিনি বলেন, ‘মামলায় উল্লিখিত ওই তারিখে ওই জায়গায় একটি ঘটনাও ঘটেনি। একটি মামলায় যে ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে গত ৪১ বছরে আমি সেই ঘটনাস্থলে যাইনি। একটি আজগুবি ঘটনা তৈরি করে আজগুবিভাবে আসামি করা হচ্ছে।’
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সরকারি কর্মচারী বলতে পুলিশও এর আওতায় পড়ে। তিনি বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে, এই গায়েবি মামলাগুলো পূর্ব পরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক। যে ঘটনা ঘটেনি সেই ঘটনা ঘটেছে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি করা- এতে করে তারা নিজেরাই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করছে এবং এতে করে আইনেরও অপপ্রয়োগ হচ্ছে।’ গণহারে অস্তিত্বহীন মামলার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা বহিনী যদি ক্রমাগত মিথ্যাচার করে এবং ক্রমাগতভাবে জনগণের আস্থা হারায় তাহলে অবধারিত ফল হলো নিকট ভবিষ্যতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশঙ্কাজনক অবনতি। আর যে দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাষ্ট্রের পরিবর্তে সরকারের বাহিনী হয়ে যায়, সেই সব দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে না।’ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নুরুল হুদা বলেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের কাজে বাধা দেয়া, আক্রমণ করা অপরাধ। এখন কোথাও যদি আইনের অপপ্রয়োগ হয়ে থাকে তাহলে এর জন্য আদালতে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে।’ তিনি বলেন, ‘বিচার্য অপরাধের (কগনিজেবল অফেন্স) ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫১ ধারা প্রয়োগ করা যায়। এখন চলমান মামলাগুলো সৎ উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে না-কি অসৎ উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে তা বিস্তারিত না দেখে, না বুঝে বলা যাবে না। তবে, খুব বেশি মামলা হলে একটা সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।’
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status