বাংলারজমিন

বদলে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল

আশরাফুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ থেকে

২০ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার, ৭:৫৪ পূর্বাহ্ন

এক সময়ের অন্তহীন সমস্যায় জর্জরিত কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে লেগেছে দিন বদলের হাওয়া। আইসিইউ দশা থেকে বেরিয়ে এসে হাসপাতালটি হয়ে উঠছে রোগীদের আস্থার ঠিকানা। দুর্ভোগ আর ভোগান্তির অন্য নাম হয়ে ওঠা হাসপাতালটিতে এখন সহজেই মিলছে সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা। সকাল-বিকাল সাফ-সুতরোয় অদৃশ্য এখন হাসপাতালের চিরচেনা নোংরা-আবর্জনার ভাগাড়। এসেছে আর্থিক খাতেও স্বচ্ছতা। সেবার মহান ব্রতে উজ্জীবিত যেন চিকিৎসক-নার্স, সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। এক আলাদিনের চেরাগের আশ্চর্য স্পর্শে বদলে যাচ্ছে সবকিছু। এই আলাদিনের চেরাগটি হাতে ধরে রেখে যিনি এই কর্মযজ্ঞের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি হলেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) ডা. সুলতানা রাজিয়া।
গত ২৮শে জুন কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) হিসেবে যোগদান করেন ডা. সুলতানা রাজিয়া। এর আগে তিনি ২০১৬ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর থেকে সিভিল সার্জন হিসেবে নরসিংদী স্বাস্থ্য বিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে সেখানে দায়িত্ব পালনের সময় তিনি জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত হন।
সময়ের হিসাবে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে তার কর্মকাল মাত্র তিন মাস ২০ দিনের। কিন্তু এই অল্প সময়েই তিনি বদলে দিয়েছেন হাসপাতালের চেহারা। দুর্ভোগ আর ভোগান্তির বিপরীতে সেবাগ্রহীতাদের মাঝে ফিরছে স্বস্তি। ফলে তিনি হয়ে উঠেছেন সেবাপ্রত্যাশী মানুষের আস্থা ও ভরসার মূর্ত প্রতীক। সরজমিনে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালটি পরিদর্শন করে এমন চিত্রই মিলেছে এখানে আসা রোগী-দর্শনার্থী ও সংশ্লিষ্টদের কথাবার্তায়। সরজমিনে হাসপাতালটি পরিদর্শনকালে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে, সেটি হচ্ছে হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। যে হাসপাতালটি এক সময় ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল, মাত্র অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে সেই চিরচেনা চিত্র যেন একেবারেই উধাও হয়ে গেছে। নোংরা ওয়ার্ড থেকে শুরু করে ব্যবহার অনুপযোগী টয়লেট সব জায়গাতেই লেগেছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ছোঁয়া। হাসপাতাল ক্যাম্পাসে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ ও ক্যাম্পাসের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ছাড়াও সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। তৈরি করা হয়েছে বাগান। হাসপাতালকে বৃক্ষশোভিত করতে লাগানো হয়েছে গাছের চারা। এতো গেল বাহ্যিক পরিবর্তনের কিছু চিত্র। সংস্কার ও মেরামতের মাধ্যমে প্রশাসনিক ভবনও বদলে গেছে। স্যালাইনের নল আর দড়ি দিয়ে বাঁধানো দরজা-জানালার পর্দার বদলে দরজা-জানালায় অ্যালুমিনিয়ামের পাইপে বসেছে নতুন নতুন পর্দা। সবমিলিয়ে হাসপাতালের পারিপার্শ্বিক অবস্থা হয়ে উঠেছে সেবা ও কর্মীবান্ধব।
কেবল হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে পরিবেশগত বদলই নয়। হাসপাতালে সেবাপ্রত্যাশীদের সেবা নিশ্চিত করতেও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে এসেছে বড় ধরনের পরিবর্তন। আগে যেখানে উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, আয়া-পিয়ন, বাবুর্চি আর ট্রলি বয়রা জরুরি বিভাগে চিকিৎসাসেবা দিতেন, সেখানে এখন চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। ইমার্জেন্সি বা জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টার জন্যই দেয়া হয়েছে ট্রলিম্যান। চালু করা হয়েছে ইমার্জেন্সি ওটি। একইভাবে স্বাস্থ্যসেবার পরিসর বেড়েছে আউটডোর এবং ইনডোরেও। হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার ফলে আউটডোরের কোনো কক্ষই এখন চিকিৎসকশূন্য থাকছে না। সময় মেনে আউটডোরে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত রোগী দেখছেন চিকিৎসকরা। এর মধ্যে দেড়টা পর্যন্ত দেয়া হচ্ছে আউটডোরের টিকিট। একইভাবে ইনডোর সেবাতেও এসেছে পরিবর্তন। কনসালট্যান্টরা নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যায় ইনডোরে রোগী দেখছেন। ওয়ার্ডের পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে উন্নত হয়েছে রোগীদের খাবারের মানও। বাড়ানো হয়েছে নৈশকালীন সেবিকার সংখ্যা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার হলেও এখানে নিয়মিত ৪শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ জন রোগী ভর্তি থাকেন। এক বেডে দু’জন, ফ্লোরেও রোগী রাখতে হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে মহিলা রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে হাসপাতালে নতুন মহিলা ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। গত ৭ই আগস্ট হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. সুলতানা রাজিয়া ফিতা কেটে নতুন এই ওয়ার্ড উদ্বোধন করেন। নতুন ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় নতুন মহিলা ওয়ার্ড চালু করায় রোগীদের কিছুটা হলেও দুর্ভোগ কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মহিলা ওয়ার্ড চালু করা ছাড়াও হাসপাতালের দন্ত বিভাগকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। রহস্যজনক আগুনে পুড়ে যাওয়া ব্লাড ব্যাংক ও প্যাথলজি বিভাগ খুব অল্প সময়ের মধ্যে চালু করা হয়েছে। হাসপাতালে জরায়ু মুখের ক্যানসার নির্ণয়ের জন্য ভায়া পরীক্ষা আগে যেখানে সপ্তাহে দু’দিন হতো, এখন সেখানে সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিনই করা হচ্ছে।
এছাড়া অনুদানের মাধ্যমে হাসপাতালের সম্পদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইসিজি মেশিন, প্যাথলজির জন্য ফ্রিজ, সেন্ট্রিফিউজ মেশিন ও আরো অন্যান্য বেশ কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম যুক্ত হয়েছে হাসপাতালের সম্পদ তালিকায়। এসব অনুদানের বেশিরভাগই দিয়েছেন চিকিৎসকরা। মানবিক এসব উদ্যোগে শামিল হয়েছেন স্টাফরাও। গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে হাসপাতালে লাগানো হয়েছে প্রচুর ফ্যান।
হাসপাতালের নানাবিধ এসব পরিবর্তনের বিষয়ে উপ-পরিচালক ডা. সুলতানা রাজিয়ার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানা গেল, কেবল পারিপার্শ্বিক ও চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রেই নয়, হাসপাতালের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতার জন্যও নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। স্বচ্ছতার জন্য বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রাপ্ত টাকার বিবরণী ডিসপ্লে বোর্ডে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এছাড়া বিগত অর্থবছরের ইউজার ফি’র প্রায় ৩০ লাখ বকেয়া অর্থ জমা দেওয়ানো হয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে বদলি কামলা। এছাড়া সঠিকভাবে বাসা বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর বাইরে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের জন্য সময়সূচি নির্ধারণ করে দিয়ে সেভাবে তদারকি করা হচ্ছে। এছাড়া দালাল মুক্ত করণের জন্যও প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ডা. সুলতানা রাজিয়া বলেন, কিশোরগঞ্জ আমার নিজের জেলা। এই জেলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার দায়িত্ব পেয়ে আমি গর্বিত। এই দায়িত্ব আমার কর্তব্যকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি আমার জেলার মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে সকলের মুখে হাসি ফোটাতে চাই। কিন্তু এক্ষেত্রে বড় বাধা সীমাবদ্ধতা। হাসপাতালের নির্ধারিত শয্যার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি রোগীর সেবা নিশ্চিত করা খুবই কঠিন। এরপরও চিকিৎসক-নার্স এবং অন্যান্য স্টাফদের সঙ্গে নিয়ে আমরা আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি, কিশোরগঞ্জবাসীর সবার সমর্থন ও সহযোগিতায় কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালকে আমরা একটি সেবাবান্ধব হাসপাতাল হিসেবে পরিণত করতে পারবো। তেমনটি করতে পারলেই কেবল আমি আমার কাজের সার্থকতা খুঁজে পাবো।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status