শেষের পাতা

উত্তরখান ট্র্যাজেডি

আঞ্জু জানেন না স্বামী বেঁচে নেই

মরিয়ম চম্পা

১৯ অক্টোবর ২০১৮, শুক্রবার, ১০:০৮ পূর্বাহ্ন

বেড নং ১। আইসিইউ-বার্ন ইউনিট। ঢুকতেই চোখে পড়ে মৃত্যু পথযাত্রী সাগরের পুড়ে যাওয়া মুখটা। মুখে অক্সিজেনের মাস্ক। কিছুক্ষণ পরপর মাস্ক তুলে মুখ থেকে বের হওয়া থুথু টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করছেন সাগরের নানী। গলার নিচ থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া। শরীর কম্বলে ঢাকা। একটি মাছি একটু পর পর উড়ে এসে সাগরের পোড়া মুখের ওপর বসতে চাচ্ছে। আর তার নানী হাত দিয়ে সেটি তাড়িয়ে দিচ্ছেন। শনিবার ভোরে উত্তরখানে গ্যাস লিকেজ বিস্ফোরণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় নারী  ও শিশুসহ একই পরিবারের ৮ জন দগ্ধ হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। ইতিমধ্যে এই ৮ জনের মধ্যে ৫ জন মারা গেছে। বাকি ৩ জনও আশঙ্কামুক্ত নয়। ১২ বছরের শিশু সাগর তাদেরই একজন।

জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন সাগর। জন্মের বছর খানেক পর সাগরের বাবা তাকে ও তার মা পূর্ণিমাকে ফেলে দ্বিতীয় বিয়ে করে অন্যত্র চলে যায়। এরপর পূর্ণিমা উত্তরখানের স্থানীয় কে.এম নামে একটি গার্মেন্টে চাকরি নেয়। চাকরির সুবাদে উত্তরখানেই একটি ফ্ল্যাটের নিচতলা ভাড়া নিয়ে ৮ সদস্য একত্রে থাকতেন। তারা সবাই মামাতো ফুপাতো ভাই বোন। পূর্ণিমার একমাত্র ভরসা ছিল ছেলে সাগর। পড়ালেখা শেষে ছেলে সাগর সরকারি চাকরি করে মায়ের সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেবে এমনটাই স্বপ্ন দেখতেন পূর্ণিমা। সাগর বরাবরই পড়ালেখায় সিরিয়াস। স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সে। পারিবারিক আড্ডায় প্রায়ই সাগর বলতো, পড়ালেখা শেষে যখন বড় চাকরি করব তখন মাকে নিয়ে আমি হজ করতে যাব। সাগরের নানা আলাউদ্দিন বলেন, আমার নাতী সাগরের আর তার মাকে নিয়ে হজে যাওয়া হলো না। আমাদের বড় আশা ছিল তাকে নিয়ে। একই ঘটনায় দু’দিন আগে সাগরের মা-ও দগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এখন সাগরের বাঁচার আশাও ক্ষিণ বলে জানিয়েছেন ঢামেকের ডাক্তাররা।

গতকাল হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে কথা হয় সাগরের স্বজনদের সঙ্গে। এ সময় তার নানী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, বুধবার দুপুর ২টা পর্যন্ত সাগর আমার সঙ্গে অনেক কথা বলেছে। ওইদিন দুপুরে সাগর কর্তব্যরত নার্সদের কাছে জানতে চায়, আজ কত তারিখ। বলে, আমি স্কুলে যাব। আমার পরীক্ষা কবে। তখন নার্সরা জানায়, আর মাত্র ১১ দিন পর তার পরীক্ষা। তখন সাগর বলে মা কোথায়? নানী কোথায়? তাদের কাছে আমাকে নিয়ে যাও। আমার শরীর থেকে কম্বল ফেলে দাও। ‘মরি (মারা) গেলেতো ঠিকই সব কম্বল ফেলে দিবা’। এভাবে ঘোরের ভেতর প্রায় কয়েক ঘণ্টা কথা বলে সাগর।

অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ আঞ্জু ঘটনার ভয়াবহতার বর্ণনা দিয়ে বলেন, আমরা একটি ফ্ল্যাটে ৩টি পরিবার তিন রুমে থাকতাম। ঘটনার দিন রাতে ৮ বছর বয়সী ছেলে সৌরভ ও স্বামীকে নিয়ে আলাদা একটি কক্ষে ঘুমিয়ে ছিলাম। বোন পূর্ণিমা রাত ৪টার দিকে উঠে রান্না ঘরে গিয়ে গ্যাসের চুলা জ্বালাতে গেলে হঠাৎ রান্নাঘরে আগুন ধরে যায়। এ সময় আজিজুল হক ও তার স্ত্রী মুসলিমা দরজা খুললে তাদের রুমেও আগুনের কুণ্ডুুলি ঢুকে যায়। এ সময় আমার স্বামী ডাবলু দরজা খুললে আগুনের লেলিহান এসে ছেলে সৌরভের গায়ে ও আমার মুখে এবং ডান হাতে লাগে। পরে ডাবলু আমাকে আর সৌরভকে গোসলখানার ঝরনা ছেড়ে বসিয়ে রেখে বিভিন্নজনের কাছে ফোন দেয়। এভাবে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ঝরনার নিচে আমরা মা ছেলে বসেছিলাম। এ সময় ডাবলুর শরীরও যে আগুনে ঝলসে গেছে সে ব্যাপারে তার কোনো হুঁশ ছিল না। ওই অবস্থায়ও লড়ে গেছেন তিনি। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনিও। তবে তার স্ত্রী আঞ্জু এই দুঃসংবাদ জানেন না।

চিকিৎসাধীন আঞ্জু বলেন, আমার স্বামী ডাবলুর জন্য দোয়া করবেন। সে কেমন আছে জানি না। ছেলে বারবার তার বাবার কাছে যেতে চায়। একমাত্র ছেলে সৌরভ খুবই বাবা ভক্ত। ডাবলু উত্তরখানে অটোরিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু হাজার ব্যস্ততার মাঝেও ছেলে সৌরভকে নিজের অটোরিকশায় করে স্কুলে আনা নেয়া করতেন। সৌরভ নার্সারিতে পড়ে। সৌরভ বা তার মা আঞ্জু কেউই জানে না যে পরিবারের একমাত্র কর্তা ডাবলু আর বেঁচে নেই।


এদিকে ছেলে সৌরভ তার মাকে বলছে, আমার শরীরের ব্যান্ডিস খুলে দাও। আমি ভালো হয়ে গেছি। বাসায় চলো। আব্বুর সঙ্গে স্কুলে যাব। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জীবিত আঞ্জুর শরীরের ৩০ শতাংশ, সৌরভের ২০ শতাংশ ও সাগরের ৬৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের মধ্যে সাগরের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। শনিবার ভোরে উত্তরখানের ব্যাপারীপাড়ার ১১০/এ-১ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিনতলা বাড়ির নিচতলায় গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে আগুন লাগে। অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের নারী ও শিশুসহ আটজন দগ্ধ হন। এ ঘটনায় দগ্ধ হয়ে ওই দিন মো. আজিজুল হক ও তাঁর স্ত্রী মুসলিমা (২০) মারা যান। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সুফিয়া (৬০)। মঙ্গলবার রাতে মারা যান পূর্ণিমা (৩৫)। এবং বুধবার সকালে ডাবলু (৩৩) মারা যান।

এ বিষয়ে ঢামেক বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী সামন্ত লাল সেন মানবজমিনকে বলেন, অসাবধানতাবশত: এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। এ বিষয়ে কড়া মনিটরিং ও গ্যাস লিক কেন হয় বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ এবং কর্তৃপক্ষ তৎপর না হলে মৃত্যুর মিছিল আরো বাড়তেই থাকবে।
   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status